মত-মতান্তর

প্রিয় বন্যাদির জন্মদিনে

আমীরুল ইসলাম

১৩ জানুয়ারি ২০২০, সোমবার, ১:৪৪ পূর্বাহ্ন

আমার বন্ধুবান্ধব খুব ভালো করে জানে যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,  একালের বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে অতুলনীয় এক নেত্রী ছাড়া জীবিত দুইজন নারী-ব্যক্তিত্বকে আমি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। একজন লেখক রাবেয়া খাতুন, যিনি চুরাশি বছরের তরুণী। খালাম্মা সম্বোধন করি। কিন্তু তিনি আমার বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধুর মত। আরেক ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আমাদের প্রিয় বন্যাদি।
বন্যাদি’কে ভালোবাসে না এমন সরল হৃদয়ের মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বন্যাদি সকলের প্রিয়। সকলের ভালবাসার মানুষ। প্রাণের মানুষ।
বন্যাদির সঙ্গে কাজ কর্মে, ভ্রমণে, অনুষ্ঠানে- এমনভাবে দ্রবীভূত যে তাকে নিয়ে আলাদা করে কিছু লেখা সম্ভব নয়। আমরা তো বন্যাদির বৃহৎ পরিবারের অংশ। তাই কেউ যখন বন্যাদি ও সুরের ধারা নিয়ে কিছু লিখতে অনুরোধ করে তখন খুব বিব্রত হই। অনেক ভেবেচিন্তেও কোন পূর্ণাঙ্গ লেখা তৈরি করতে পারি না। সাগর ভাইয়ের খুব প্রিয় বন্ধু বন্যাদি। বন্যাদির প্রিয়বন্ধু সাগর ভাই। সাগর ভাইয়ের স্নেহ-প্রশ্রয়ে বন্যাদির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা দিন দিন গভীরতর হয়ে উঠেছে।
বন্যাদিকে আপন দিদির মতোই জ্ঞান করি। কত অবিশ্বাস্য সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছি তার সঙ্গে তা লিখে বোঝাতে পারব না। কতভাবেই না জড়িয়ে আছি বন্যাদির জীবনের সঙ্গে। অর্ক, নয়নতারা, টুসি আপা, উর্মি আপা, প্রিয়দর্শিনী, তুহিন, দীপক দা, স্বাতী সরকার, অনুশ্রী, তনুশ্রী, আঁখি হালদার, বিমলবাবু, হেলাল ভাই, রূপাদি, সুদেষ্ণাদি, মিন্টু দাদা- এরকম অসংখ্য নাম। যারা লতায় পাতায় জড়িয়ে রাখে বন্যাদিকে। এত সব বাঁধার প্রাচীর পেরিয়ে বন্যাদির হৃদয়ে স্থান নিতে হয়। ভক্তি ও ভালবাসা দিয়ে বন্যাদির হৃদয় জয় করা সম্ভব। বন্যাদি বহুমাত্রিক চরিত্র।


বন্যাদি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বিশ্বসেরা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। যিনি নিজস্ব গায়কী, রবীন্দ্রসঙ্গীতের সম্পদ ও উপস্থাপনায় বাংলা গানকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। দেশ বিদেশের শত শত মঞ্চে শ্রোতাদের হৃদয়কে শাদা পাখির মত আকাশে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
আমার সৌভাগ্য হয়েছে অনেক বড় বড় মঞ্চে তার অনবদ্য পরিবেশনা উপভোগ করার। তার অনুষ্ঠান দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলেও সেটা একটা পূর্ণাঙ্গ বই হয়ে যাবে।
বন্যাদি সুরের ধারার পরিচালক। হাজার হাজার তার শিক্ষার্থী। তিনি একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। তিনি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছেন।
বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্যে তার দিন কাটে। কোন অবসরের ফুরসত পান না। এরই মধ্যে আড্ডা। আহার পর্ব। আত্মীয়তা। সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা সবই করেন তিনি।
বন্যাদি অনেক বড় স্বাপ্নিক। নিত্য নতুন স্বপ্ন দেখেন। হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ তারই স্বপ্ন। সুরের ধারা প্রতিষ্ঠা সেই স্বপ্নেরই বাস্তবতা। ‘শ্রুতি গীতবিতান’ আরেকটি মাইলফলক কাজ। বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ গীতবিতান ‘গীত’ হয়েছে তার নেতৃত্বে। এসবই তো চেনা বন্যাদির টুকরো টুকরো ছবি।


আরেক বন্যাদিকে নিয়ে কিছু বলা যাক। বন্যাদির ভেতর বসত করে আরেকজনা। বন্যাদি গাছপালা, লতা গুল্ম, ফুল, ফল অর্কিড খুব ভালবাসেন। বিদেশ থেকে আসার সময় যত বাধা বিপত্তি থাকুক না কেন তিনি পছন্দের অর্কিড ঠিকই নিয়ে আসবেন। আর যদি কোন পাহাড়ি এলাকায় যান পুরো বাগান তিনি তুলে নিয়ে আসবেন। তার নিজস্ব বাসভূমিতেও বাগান আছে। বৃক্ষপ্রেমে বন্যাদি একেবারে বলাইয়ের মত।
বন্যাদি খুব ভাল রাঁধুনী। বিশেষ করে ওরিয়েন্টাল রান্না। এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, হেলালের সঙ্গে যখন বিয়ে হয় তখন আমি রান্না জানতাম না। আর হেলাল আমার রান্না খেতেও চাইতো না। তখন রাগে অভিমানে বাংলাদেশ পর্যটনের রান্নার কোর্সে গিয়ে ভর্তি হলেন। নিয়মিত রান্না করেন না। কিন্তু যখন করেন অসাধারণ হয় স্বাদ-গুণে। আর যে কোন বড় ও বৈচিত্র্যময় রেস্টুরেন্টে বিদেশে যখনই খেতে বসেছি, খাওয়ার আইটেম দেখেই বন্যাদি রেসিপি বলে দেন অনর্গল। কোন খাবারের স্বাস্থ্যমান ও পুষ্টিগুণ কেমন সেটাও বলে দেন।
বন্যাদি প্রচুর বই পড়তে ভালবাসেন। ছোটবেলায় বাংলা কিশোর ক্লাসিক প্রায় পুরোটাই পড়েছেন। যে কোন বিষয়ের বই তিনি পড়তে ভালবাসেন। পেরুর সভ্যতা, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, রবীন্দ্র-জীবনী, জেমস বন্ড, সুনীল, শীর্ষেন্দু- যেকোন বইই তিনি পড়তে আনন্দ পান। আর যে কোন কাজের মতোই বই পড়াতেও তিনি সিরিয়াস। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বইটা পড়েন।
নতুন কোন বই পড়লেই শিশুর মতো উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি সব বর্ণনা দেন আমাদের।
বন্যাদি ভ্রমণে খুব আনন্দ পান। প্রতি মাসেই চার পাঁচ বার তিনি আকাশে উড়াল দেন। কলকাতা তার দ্বিতীয় বাড়ি। বন্যাদির যে কোন ভ্রমণসূচী দেখলেই আমরাও ক্লান্ত হয়ে যাই। অনুষ্ঠান উপলক্ষে লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, প্যারিস, টোকিও, দুবাই, কাতার, থাইল্যান্ড, ব্রিস্টল কোথায় না ছুটছেন তিনি। ক্লান্তিহীন ছোটাছুটিতে কিন্তু কখনোই আনন্দের ছাপ তার চেহারা থেকে দূর হয় না।
আমি ক্ষুদ্র মানুষ। বহুবার বন্যাদির ভ্রমণসঙ্গী হতে পেরেছি। মক্কা গিয়েছি ওমরাহ হজ্বব্রত পালন করতে। অনেকবার নিউইয়র্ক। ওখানে বন্যাদির একমাত্র কন্যাসন্তান প্রিয়দর্শিনী থাকেন। লন্ডনও গিয়েছি বেশ কয়েকবার। সেখানেও দিদির ছোটবোন থাকেন।
রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য মংপু গিয়েছি। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দুবাই, কাতার- এসব তো শুটিং উপলক্ষে। কলকাতা যাই নানা ছলনায়। বন্যাদির সঙ্গে সুযোগ পেলেই ছুটে গেছি কলকাতায়। একবার জীবনে মজার একটা ভ্রমণে গিয়েছি দিদির সঙ্গে। ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায়। আমি, সাগর ভাই আর বন্যাদি। সে এক আশ্চর্য ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। আদ্দিস আবাবা থেকে হাজার মাইল দূরে লালিবেলা। পাহাড়ের উচ্চ দেশে খৃস্টানদের সুরক্ষিত গির্জা। সেখানে অনেকগুলো গির্জা। পরিচালনা করে থাকেন একদার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। এসব ভ্রমণে তো বন্যাদির সাথে আমরা ছিলাম। কিন্তু বছরে একবার হলেও বন্যাদির ভ্রমণসঙ্গী মার্কিন প্রবাসী সুদেষ্ণাদি। জাহাজে করে পনেরো দিন আলাস্কা দ্বীপ ঘুরে বেড়িয়েছেন। আবার সুদেষ্ণাদির সাথে ল্যাটিন আমেরিকান পেরুর মাৎসুপিসু সভ্যতা দেখতে গেছেন। মুগ্ধ নয়নে দিদির কাছে সেই গল্প শুনেছি। ইনকা সভ্যতার উপর ছোটবেলায় প্রেমেন্দ্রমিত্রের ঘনাদার গল্প পড়েছিলাম। সেই স্মৃতি অক্ষয় হয়েছিল। কিন্তু এ জীবনে মাৎসুপিৎসু যাওয়া হলো না। বন্যাদির চোখ দিয়ে মাৎসুপিসু দেখলাম।
কদিন আগেই দিদি পুরো পরিবার নিয়ে গোয়ালিয়র ঘুরে এলেন। তার একমাত্র সন্তান অর্ক। অর্ক ফিরে এসে আনন্দ চিত্তে সেই ভ্রমণ-গল্প আমাদের শোনালো। আমি শুনেই উত্তেজিত। বন্যাদির পায়ের তলায় সর্ষে আছে। কয়েকদিনের বেশি তিনি স্থির থাকতে পারেন না। ছোটাছুটি শুরু করেন।
বন্যাদির নিকটজনেরা ছাড়া কেউ জানে না তিনি কতো বড় আড্ডাবাজ। শান্তিনিকেতন জীবন থেকে শুরু হয়েছে তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আড্ডা। সে গল্প শুনলেও তাজ্জব বনে যেতে হয়।
সময় সুযোগ পেলেই মনোমত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ পেলেই বন্যাদি আড্ডায় মত্ত হয়ে ওঠেন। সকল মতের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল থাকেন। মতান্তর ঘটলেও তা প্রকাশ করেন না। আজকাল খেয়াল করেছি- কারো ভুল তথ্যে, ভুল ব্যাখ্যায় মন খারাপ করেন না। খালি বলেন, বাদ দাও। জানে না কিছু। ব্যস এটুকুই।
ইদানিং বন্যাদি কেমন যেন সন্ন্যাসীব্রত ধারণ করেছেন। চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে ওঠা এক মানুষ।
বন্যাদির গল্প বলবার ক্ষমতা অসাধারণ। শান্তিনিকেতনের বর্ষা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-শান্তিদেব ঘোষের গল্প কিংবা নবদ্বীপের ছিন্নবস্ত্র পরিহিত বৃদ্ধা বৈষ্ণবীর ভক্তিপ্রকাশ- এসব গল্প বন্যাদির কণ্ঠে শোনা দরকার। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। বন্যাদির গল্প জীবন্ত ছবির মত। এবং প্রতিটা গল্পের ভেতরে গভীর নান্দনিকতা ও দর্শন থাকে।
সবশেষে বলতে চাই, বন্যাদির রুচিস্নিগ্ধতা। তার সারা অঙ্গে কোমলতা ছড়িয়ে থাকে। আর খুব দরদী হৃদয়ের মহিলা তিনি। তার ছাত্রছাত্রীদের উপকার করার জন্য সারাক্ষণ ব্যস্ত তিনি। কার চাকুরি দরকার, কার চিকিৎসা সুবিধা দরকার- নানা কিছু নিয়ে তার ব্যস্ততা।
বন্যাদি খুব সৌখিন মহিলা। শো পিস সংগ্রহ করতে খুব পছন্দ করেন। দেশ বিদেশ থেকে দামি দামি শো পিস সংগ্রহ করেন। ইদানিং তিনি পেইন্টিং সংগ্রহ করছেন। সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং তার বৈশিষ্ট্য। তার সুপুত্র অর্ক যেমন আমেরিকায় রান্না বিষয়ে লেখাপড়া করেছে। কিন্তু ছেলেকে তিনি বৈভব দিয়ে নষ্ট করেননি।
বন্যাদির পোশাকি রুচিও খুব অন্যরকম। আমরা কোনদিন বন্যাদিকে রুচিহীন ডিজাইনের শাড়ি পরতে দেখিনি। ৩০০ টাকা হোক কিংবা ৩ লক্ষ টাকা হোক- সব শাড়িতেই বন্যাদিকে সমানভাবে মানিয়ে যায়। লম্বা একহারা গড়ন তার। আয়তলোচন। পুরু ফ্রেমের চশমা। নিজস্বতা আছে।
গান যখন গাইতে থাকেন তখন যেন মনে হয় তিনি ঈশ্বরের সাধনায় মত্ত। যখন গান গাইতে থাকেন এক অপার্থিব সৌন্দর্য্য তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
কোন এক বসন্তের বাতাসে উড়তে থাকে তার চুলের গুচ্ছ। বিদায়ী বসন্ত। চৈত্রের শেষ সন্ধ্যা। বন্যাদি মঞ্চে গান গাইছেন।
যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন কোন দেবী। দেবী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো?
দেবী নিরুত্তর। ভুবন ভুলানো মুচকি হাসি দেন তিনি। এই আমাদের চিরচেনা বন্যাদি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status