বিশ্বজমিন

লাতিন আমেরিকায় বইছে নতুন হাওয়া

অনিম আরাফাত

৯ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৭:১৫ পূর্বাহ্ন

সামপ্রতিক সময়ে লাতিন আমেরিকার দেশ চিলি ও ইকুয়েডরে বামপন্থিদের নেতৃত্বে নব্য উদারবাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলন দেখা গেছে। আন্দোলনগুলো দেশ দুটিতে ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। আবার লাতিন আমেরিকার আরো দুই দেশ বলিভিয়া ও আর্জেন্টিনায় নতুন করে ক্ষমতায় এসেছে বামপন্থি সরকার। অন্য যেসব দেশে ডানপন্থি সরকার টিকে আছে তাদেরকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে বিভিন্ন গণআন্দোলনের। অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মহাদেশটিতে আবারো উত্থান ঘটতে চলেছে বামপন্থি রাজনীতির।

এই শতকে লাতিন আমেরিকাই হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র অঞ্চল যেটি নিওলিবারেলিজম বা নব্য উদারবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পেরেছে। মহাদেশটির বিভিন্ন দেশ শাসন করেছেন জনপ্রিয় বামপন্থি নেতারা। এরমধ্যে রয়েছে, ভেনিজুয়েলার হুগো চ্যাভেজ, ব্রাজিলের লুলা দা সিলভা, আর্জেন্টিনার ক্রিশ্চিনা কির্শনার, উরুগুয়ের পেপে মুজিকা, বলিভিয়ার ইভো মোরালেস ও ইকুয়েডরের রাফাতেক কোরেরা। এটিই ছিল এই শতকে মহাদেশটির প্রথম দশক। এসময় বিশ্বের অন্যতম বৈষম্যপূর্ণ এ মহাদেশটি ক্ষুধা ও দরিদ্রতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে ছিল।

তবে দ্বিতীয় দশকটা ছিল অন্যরকম। বিভিন্ন দেশে রক্ষণশীল ডানপন্থি দলগুলোর উত্থান ঘটতে থাকে। এরমধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও ইকুয়েডর। এসব দেশে বামপন্থিদের সমর্থন কমে গিয়ে ফের উত্থান ঘটে নব্য উদারবাদের। তবে বিশেষজ্ঞরা তাকে বলছেন, এই উত্থানের পেছনে কোনো শক্তি ছিল না, সমর্থন ছিল না। ছিল শুধু অর্থের খেলা। এই দশকের শেষ অংশে এসে তার প্রমাণ মিলতে শুরু করেছে। মেক্সিকোতে ক্ষমতায় এসেছেন প্রগতিশীল লোপেজ ওবরেডর। বলিভিয়াতে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন ইভো মোরালেস। আবার আর্জেন্টিনায়ও ডানপন্থি ম্যাকরিকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন আলবার্তো ফার্নান্দেজ।

ম্যাকরিকে হারতে হয়েছিল অর্থনীতিতে তার নিওলিবারেল মডেলের কারণে। এর ফলে আর্জেন্টিনাকে টানা তিন বছর অর্থনীতির শ্লথগতিতে ভুগতে হয়েছিল। একইসঙ্গে আশঙ্কাজনকহারে দেশটিতে বাড়তে শুরু করে বেকারত্বের হার। তিনি মধ্যবিত্তের সমর্থনও হারিয়েছিলেন। আর্জেন্টিনার মানুষ ও সংগঠনগুলো আবারো সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিনার অভাব অনুভব করতে শুরু করে। লাতিন আমেরিকা বিশেষজ্ঞদের দাবি, এখন যদি ব্রাজিল ও ইকুয়েডরে নির্বাচন হয় তাহলে সেখানেও বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হারাবে। অর্থাৎ, এ শতকের তৃতীয় দশকে আবারো উত্থান হতে চলেছে রক্ষণশীল ডানপন্থি বিরোধী সরকারগুলোর। ব্রাজিলের শিক্ষাবিদ ও অধিকারকর্মী এমির সাদেরের ভাষায়, এটা কোনো আশাবাদী বক্তব্য নয়- এটাই বাস্তবতা।

সাদের মনে করেন, ব্রাজিলের বর্তমান ডানপন্থি শাসক জেইর বলসোনারো দেশে ক্রমশ অজনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। তবে তাকে ফ্যাসিস্ট বলতে নারাজ তিনি। সাদেরের মতে, বলসোনারো একইসঙ্গে বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী ও অজনপ্রিয়। কিন্তু গত শতাব্দীতে ইউরোপের ফ্যাসিস্ট শাসকদের মতো তার সেনাবাহিনী ও জনগণের সমর্থন নেই। তিনি বড়জোর একজন বাজে শাসক। ক্ষমতায় এসেই তিনি তার এক সন্তানকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। অন্য সন্তানদের বিরুদ্ধে থাকা নানা অভিযোগ থেকে তাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। বহির্বিশ্বেও তার ভাবমূর্তি ভয়াবহ। এমনকি কঠোর নব্য উদারবাদী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ব্রাজিলে বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। আমাজন বন নিয়ে তার নীতির কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দূরে সরে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ব্রাজিলীয় পণ্য বয়কটের ডাক উঠেছে। বলসোনারো এখন গণমাধ্যমকে ক্রমাগত আক্রমণ করে যাচ্ছেন। সেটিও এখন আর তাকে সমর্থন দিচ্ছে না।

এদিকে লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ ভেনিজুয়েলাতেও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। সেখানে ক্ষমতায় রয়েছেন সমাজতান্ত্রিক নেতা নিকোলাস মাদুরো। সর্বশেষ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন তিনি। তবে সে নির্বাচনকে প্রশ্নবিধ্য হিসেবে দাবি করেছে দেশটির বিরোধী দল ও পশ্চিমা দেশগুলো। মাদুরোর বিরুদ্ধে নিজেকেই ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদো। তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। এ ছাড়া গুয়াইদো সমর্থন পাচ্ছেন লাতিন আমেরিকার ডানপন্থি সরকারগুলোরও। তারপরও সেখানে শক্তভাবেই টিকে আছেন মাদুরো। তার পেছনে রয়েছে চীন, কিউবা ও রাশিয়ার সমর্থন। তবে তার শক্তির সব থেকে বড় উৎস দেশটির জনগণের সমর্থন। লাতিন আমেরিকাজুড়ে ডানপন্থার বিরুদ্ধে যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে তার রেশ রয়েছে ভেনিজুয়েলাতেও। সমপ্রতি কিউবা সফর করেছেন মাদুরো। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি নেতা রাউল ক্যাস্ত্রো ও কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেলের সঙ্গে এক সম্মেলনে তিনি বলেন, লাতিন আমেরিকায় নতুন বাতাস বইতে শুরু করেছে।

তারই প্রমাণ মেলে চিলিতে। বামপন্থি শ্রমিক সংগঠনগুলোর ডাকা ধর্মঘট থেকে নব্য উদারবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে বিশাল এক জনসমুদ্রের সৃষ্টি হয় রাজধানী সান্তিয়াগোতে। একই স্থানে জড়ো হয় ১০ লক্ষাধিক মানুষ যা দেশটির জনসংখ্যার ৫ শতাংশেরও বেশি। দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্যতা প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে এ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এটি ছিল গত কয়েক দশকের মধ্যে দেশটির সব থেকে বড় বিক্ষোভ। এর আগে ১৯৮৮ সালে বামপন্থি সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসা সামরিক স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোচেটের বিরুদ্ধে এত বড় জনসমাবেশ হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের স্লোগানে ছিল, লাতিন আমেরিকায় নব্য উদারবাদের উত্থান হয়েছিল এই চিলি থেকেই আর এর পতনও শুরু হবে চিলি থেকেই।

স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মনে হয়েছিল এখন একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে টিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল চীন রয়েছে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে। রাশিয়া রয়েছে সামরিক পরাশক্তি হিসেবে। এই রাষ্ট্র দুটি এখন বিশ্বজুড়ে মার্কিন শাসকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। আগামীর মাল্টিপোলার বিশ্বের ভ্রুণ লুকিয়ে আছে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে নানা প্রচেষ্টা, টেকনোলোজিতে অগ্রগতি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার ক্ষমতার কারণে দেশটির প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন লাতিন আমেরিকার নেতারাও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়ার কিছুই নেই। ফলে বর্তমানে মহাদেশটির প্রধান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগী রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে চীন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status