বাংলারজমিন

ডিমের গ্রাম সোনারায়

সিদ্দিক আলম দয়াল, গাইবান্ধা থেকে

৮ নভেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ৮:১০ পূর্বাহ্ন

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সোনারায় গ্রামের আয়শা, মর্জিনা, সাজেদা, শ্যামলী ও লালবানুরা এখন স্বাবলম্বী। অর্থাৎ বাড়ি-বাড়ি, ঘরে-ঘরে খামার। পাশাপাশি হাঁস-মুরগির খামারকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে হাঁস-মুরগির খাবারের দোকান। এ কারণে খামারিদের হাঁস-মুরগির খাবারের চাহিদাও মিটে এই গ্রাম থেকেই। এখান থেকে প্রতিদিন অন্তত ৩ থেকে ৪ লাখ ডিম পাইকারদের মাধ্যমে ঢাকা, বগুড়া, রংপুর, কুড়িগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়। তবে খামারিরা দাবি করেন এই গ্রামে স্থানীয় ভাবে ডিমের আড়ত বা কেনা-বেচার বাজার থাকলে খামারিরা আরো বেশি লাভবান হতেন।
আবুল হোসেন বলেন, প্রথমে আমি হাঁসের ব্যবসা করি, পরে ডিম ফুটাই। প্রতিদিন গড়ে আমার ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় আসে। হ্যাচারিতে ডিম ফুটাই সংসার আমাদের ভালো চলে। ব্যাংক আমাদের ঋণ দিলে আমরা ব্যবসা আরো বড় করতে পারতাম। আগে বেকার ছিলাম। চাকরির চেয়ে এ পেশা অনেক স্বাধীন। আমি নিজে করি। আমার বেকারত্ব দূর হয়েছে। প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ লাখ ডিম উৎপন্ন হয় এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় যায়। এখানে হাঁসের খাদ্য, মাছের খাদ্য, মুরগির খাদ্য বিক্রি করা হয়। আমরা সবাই কাজ করে খাই। এই গ্রামে কোনো বেকার নেই। এখানে একটি ডিমের আড়ৎ থাকলে ভালো হতো। আমরা আরো বেশি লাভবান হতাম।
এই গ্রামের একজন খামারির নাম ফরিদ মিয়া। অভাবের তাড়নায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে কুড়ি বছর আগে চলে আসেন সুন্দরগঞ্জের সোনারায় গ্রামে। অন্যের জমিতে হালচাষ করে ও কামলা দিয়ে দিনের পেটের খাবার জোগাড় করতেন। তারপর আস্তে আস্তে অন্যের জমিতে মজুরি দিয়ে কেনেন ৩টি হাঁস। এই হাঁস বদলে দেয় ফরিদ মিয়ার জীবন। সোনালী জাতের তিনটি হাঁস পালন করে। প্রতিদিন ডিম দেয় ৩টি করে। এই ডিম বিক্রির টাকায় ফরিদ মিয়া দিনাজপুর থেকে নিয়ে আসেন আরো কয়েকটি হাঁসের বাচ্চা। তারপর ১৬টি হাঁস দিয়ে শুরু হয় তার খামারি জীবন। প্রতিদিন ১০টি করে ডিম দেয়া হাঁস তদারকি করতে থাকেন। পাশাপাশি অন্যের জমিতে কাজ করাও বাদ দেয়নি। প্রতিদিন ডিমের টাকা দিয়ে জমিয়ে জমি কিনেন ৬ শতক। এক পাশে করেন হাঁসের খামার আর এক পাশে নিজেরা বাস করেন। এক সময় ফরিদ মিয়ার হাঁসের খামার ভরপুর হয়ে ওঠে। তার হাঁসের খামারে ১০ হাজার ডিম পাড়া মুরগি এবং ১০ হাজার হাঁস। প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার ডিম তার ঘরে আসে। ডিম বিক্রির আয় রোজগার থেকে তিনি আশেপাশে কয়েক বিঘা জমি কিনেন। তারপর হাঁস-মুরগির খাবার তৈরির মেশিন, মিল স্থাপন করেন। তাকে অনুসরণ করেই কুমিল্লা থেকে অন্তত ২০ হাজার পরিবার গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে আসেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই করে ফরিদ মিয়ার কাছে পরামর্শ নিয়ে গড়ে তোলেন হাঁস-মুরগির খাবার। তাকে দেখেই আশেপাশের গ্রামের অধিকাংশ ব্যক্তি হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তোলেন। তার কাছে নেন ডিম, শিখে নেন ডিম ফুটানোর মতো দেশীয় পদ্ধতি। তারপর তারাও ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা ফোটান। হাঁস ও মুরগির বাচ্চাও বিক্রি করেন। প্রতিটি হাঁসের বাচ্চা ২৫ টাকা হিসাবে বিক্রি করে এই এলাকার অনেকেই এই ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বর্তমানে ফরিদ মিয়া হাঁস-মুরগির ব্যবসা করে কোটিপতি বনে গেছেন। তিনতলা বাড়ি গাড়ি, মিল কারখানা, একাধিক খামার, মাছের পুকুরসহ কোটি টাকার ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত লাভ করেন। শুধু তাই নয়, এলাকার ডিম যাতে সঠিক দাম পাওয়া যায় এজন্য ফরিদ মিয়া ডিমের আড়ৎ গড়ে তোলেন। ডিমের আড়তে প্রতিদিন এলাকার শ শ খামারি ডিম বিক্রি করে থাকেন। আর এই খামার থেকে প্রতিদিন গড়ে ৬ লাখ ডিম ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ট্রাক যোগে চলে যায় পাইকারি আড়ৎগুলোতে। ফরিদ মিয়া বলেন, আমার স্বপ্নের গ্রাম আমি গড়তে সক্ষম হয়েছি। খামারি হওয়ার কারণে আশেপাশের কয়েক গ্রামে কোনো বেকার নারী-পুরুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। যারা বেকার ছিলেন তারাও এখন বাড়িতে খামার গড়ে তুলেছেন। যে ব্যক্তি এক সময় রিকশা চালাতো তিনি এখন মোটরসাইকেল চালান। তার বাড়িতে একাধিক মোটরসাইকেল ট্রাক দেখতে পাওয়া যায়। এরচেয়ে সুখের খবর আর কোথায় পাবেন।
দোকানি রহমান মিয়া বলেন, প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ডিম ক্রয় করি। এই ডিম দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেমন পার্বতীপুর, কুড়িগ্রাম, সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় দেই। রহমান মিয়ার মতো অন্তত ৫০ জন ব্যক্তি এখন ডিম কেনা বেচার আড়ৎ খুলে বসেছেন। তারা প্রতিদিন ডিম কেনা বেচা করেন।
জাতীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, খামার গড়ে অন্তত ৩০ হাজার পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সুন্দরগঞ্জের মানুষের উন্নয়নের জন্য গোটা সুন্দরগঞ্জকে বদলে দিতে চাই। সুন্দরগঞ্জে শিশু পার্ক, নদী ভাঙন রোধ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, বিভিন্ন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে তুলে সুন্দরগঞ্জবাসীর মুখে হাসি ফোটাতে চাই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status