শেষের পাতা

‘ফিরোজের কাছে ফিরে আসবো’

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

১৮ অক্টোবর ২০১৯, শুক্রবার, ৯:০৭ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশি যুবক ফিরোজের ভালোবাসায় ‘পাগল’ ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া নারী কারেংশু। সে স্বামী, সন্তান ও নিজের জমিদারি ছেড়ে চলে এসেছে বাংলাদেশে। টানা ৫ দিন তাকে নিয়ে সীমান্তে ঘটেছে নানা নাটকীয়তা। অবশেষে প্রেমিক ফিরোজের সঙ্গে পলাতক থাকা খাসিয়া নারী কারেংশুকে আটকের পর গতকাল তুলে দেয়া হয়েছে বিএসএফের হাতে। ফেরত যেতে চায়নি কারেংশু। প্রেমিক ফিরোজের সঙ্গ ছাড়তে রাজি নয় সে। এ কারণে ভারত যাওয়ার প্রাক্কালে দু’দেশের সীমান্তবাহিনী ছাড়াও উপস্থিত শ’শ’ মানুষের সামনে বলেছে- ‘আমি ফিরোজের কাছে ফিরে আসবো। ও আমার সব।’- গতকাল দুপুরে জৈন্তাপুরের টিপরাখলা সীমান্তে পতাকা বৈঠকে উপস্থিত হয়ে বিজিবি ও বিএসএফ’র সামনেই এ কথা বলে ভারতের শিলং রাজ্যের খাসিয়া নারী কারেংশু খাসিয়া।

তবে- তার কথায় কান দিলেন না কেউ। পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে বিজিবি সদস্যরা তাকে বিএসএফ’র হাতে তুলে দিলেন। তুলে দেয়ার সময়ই জবরদস্তি করছিল খাসিয়া নারী কারেংশু। ভারতে যাবে না। স্বামী-সন্তান উপস্থিত থাকলেও তার মন গলেনি। অবশেষে পতাকা বৈঠকের পর কারেংশু খাসিয়াকে হস্তান্তরের পর জোর করেই ভারতীয় খাসিয়া তাকে নিয়ে যায়। কারেংশু খাসিয়াকে ফেরত দেয়ার পর আটক বাংলাদেশি বাসিন্দা ও ধরে নেয়া গরু ফিরিয়ে দিয়েছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ। গত শনিবার ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডাউকির হেওয়াই এলাকার বাসিন্দা কারেংশু খাসিয়া নামের খাসিয়া নারী বাংলাদেশের জৈন্তাপুরের টিপরাখলা সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা ফিরোজের হাত ধরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ওপারে কারেংশু খাসিয়ার স্বামী চংকর খাসিয়া ও ৫ সন্তান রয়েছে। তাদের রেখেই বাংলাদেশের যুবকের প্রেমের টানে সে এপারে চলে আসে। এরপর থেকে ফিরোজও তার প্রেমিকা কারেংশু খাসিয়াকে নিয়ে উধাও হয়ে যায়। ফিরোজের বাড়িতেও তার স্ত্রী ও এক সন্তান রয়েছে। দুই দেশের নারী-পুরুষের পরকীয়া ও পলায়নের ঘটনা প্রকাশ পায় শনিবার পলাতক হওয়ার পর থেকে। এ ঘটনায় ডাউকির খাসিয়ারা চরম ক্ষুব্ধ হয়। আর এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তারা মঙ্গলবার বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে শতাধিক গরু ও বাংলাদেশের জৈন্তাপুরের টিপরাখলা গ্রামের নুর উদ্দিন ওরফে আব্দুন নূরকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর খাসিয়ারা আল্টিমেটাম দেয়- কারেংশু খাসিয়াকে ফেরত না দিলে তারা আটক গরুর ও বাংলাদেশের বাসিন্দা নূরকে ছাড়বে না। এ নিয়ে মঙ্গল ও বুধবার সীমান্তে কোম্পানি পর্যায়ে পতাকা বৈঠক হয়। কিন্তু কারেংশু খাসিয়ার সন্ধান না পাওয়ায় এ ঘটনার মীমাংসা হচ্ছিল না।

এ নিয়ে ওপারে ভারতের খাসিয়ারা ও এপারে বাংলাদেশের বাসিন্দারা মুখোমুখি অবস্থায় ছিলেন। তবে- বিজিবি ও বিএসএফ’র পক্ষ থেকে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত ছিল। এই অবস্থায় গত বুধবার সন্ধ্যায় খোঁজ মিলে কারেংশু খাসিয়ার। মৌলভীবাজারের জুড়ি এলাকা থেকে পুলিশ তাকে আটক করে জৈন্তাপুর পুলিশে দেয়। রাতে জৈন্তাপুর পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা তাকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করে। কথা বলে সাংবাদিকদের সঙ্গেও। এ সময় কারেংশু খাসিয়া জানায়- হেওয়াই এলাকার তার স্বামী রয়েছে। তার ৫ সন্তান রয়েছে। এরপরও সে বাংলাদেশি যুবক ফিরোজকে ভালোবাসে। এ কারণে শনিবার সে ফিরোজের হাত ধরে বাংলাদেশে চলে এসেছে। কারেংশু জানায়- ফিরোজের কোনো দোষ নেই। সে নিজের ইচ্ছায় ফিরোজের সঙ্গে এসেছে। এখন সে ফিরোজের সঙ্গে বাংলাদেশে থেকে যেতে চায়। এদিকে- ফিরোজের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করে কারেংশু খাসিয়া। ফিরোজের বাড়ি সীমান্তের এপারে। মধ্যখানে সীমান্ত বর্ডার। অনেক আগে থেকেই ফিরোজ কাজের জন্য তার বাড়িতে যেত। কারেংশু খাসিয়া হচ্ছে হেওয়াই এলাকার জমিদার মহিলা। তার নিজের তিনটি বাগান রয়েছে। এসব বাগানের দেখাশোনা কারেংশু নিজেই করে। ফিরোজ কাজের জন্য প্রায় ১০ বছর আগে কারেংশুর বাগানে যায়। তখন থেকে ফিরোজের সঙ্গে তার সম্পর্ক।

ফিরোজকে ভালোবেসে ফেলে কারেংশু। আর ফিরোজও কারেংশুকে ভালোবেসে ফেলে। এই প্রেমের সম্পর্ক তাদের দৈহিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায়। কারেংশুর বাড়িতেই তারা মিলিত হতো। বিষয়টি হেওয়াই এলাকার বাসিন্দারা জানতেন। টের পেয়েছিল কারেংশুর স্বামী চংকর খাসিয়া। এ কারণে বেশ কয়েকবার ফিরোজকে তারা মারধর করে। ফিরোজকে মারধর করায় আরো বেশি ক্ষেপে যায় কারেংশু। স্বামী ও সমাজপতিদের সঙ্গে সে ফিরোজকে নিয়ে লড়াই করে। এতে লাভবান হতে না পেরে সে ফিরোজের হাত ধরে বাংলাদেশে চলে আসে। এ কারণে কারেংশু খাসিয়াকে নিয়ে ফিরোজের ওপর রেগে উঠেছিল ভারতীয় খাসিয়ারা। কারেংশুকে ফেরত পেতে তারা বাংলাদেশি বাসিন্দা ও মাঠে চড়ানো অবস্থায় শতাধিক গরু মঙ্গলবার ধরে নিয়ে যায়। এদিকে- গতকাল সকালে কারেংশুকে ফেরত দিতে ও বাংলাদেশি মানুষ ও গরুর ফেরত আনতে পতাকা বৈঠকের আহ্বান করা হয়। বেলা ২টার দিকে জৈন্তাপুরের টিপরাখলা সীমান্তে বিজিবি কারেংশুকে নিয়ে যায়। আর বিএসএফ নূরসহ গরু নিয়ে আসে। এ সময় উভয় দেশের শ’শ’ মানুষ উপস্থিত হন।

সবার সামনেই কারেংশু ভারতে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। জোর করেই তাকে ফেরত পাঠানো হলেও যাওয়ার সময় কারেংশু বলে যায়- ফিরোজকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না, আবার চলে আসবো। স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডার আবদুল কাদের পতাকা বৈঠক শেষ হওয়ার পর সাংবাদিকদের জানান- আমরা কারেংশু খাসিয়াকে ফেরত দেয়ার পর তারা নূরসহ গরু ফেরত দিয়েছে। এ ব্যাপারে উভয় দেশের নাগরিকদের স্বাভাবিক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন- কারেংশু ফেরত দেয়ার মাধ্যমে এ ঘটনার নিষ্পত্তি হলো। ফেরত আসা আব্দুন নূর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর একটি বাড়িতে আটকে রাখে। তবে- কোনো মারধর করা হয়নি। গতকাল সকালে তাকে ভারতের মুক্তাপুর পুলিশে সোপর্দ করা হয়। মুক্তাপুর পুলিশ তাকে নিয়ে এসে বিএসএফ’র হাতে তুলে দেয়। এরপর বিএসএফ তাকে ফেরত দিয়েছে। এদিকে- কারেংশু খাসিয়াকে জুড়ি পুলিশের কাছে ফেরত দিলেও আড়ালে রয়েছে কারেংশু খাসিয়ার প্রেমিক বাংলাদেশের জৈন্তাপুরের টিপরাখলা এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ মিয়া। কারেংশুকে ফেরত যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করলেও সে পতাকা বৈঠক কিংবা তার আশপাশে উপস্থিত ছিল না। পরিবারের সদস্যরাও জানেন না ফিরোজ এখন কোথায় আছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status