শেষের পাতা

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন

রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ‘উপবন এক্সপ্রেস’-এর দুর্ঘটনা

ইমাদ উদ দীন, মৌলভীবাজার থেকে

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, সোমবার, ৯:৩৯ পূর্বাহ্ন

তদন্ত প্রতিবেদনেই উঠে আসলো যাত্রী ও স্থানীয়দের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার বাস্তব চিত্র। চলতি বছরের ২৩শে জুন কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নের বড়ছড়া ব্রিজের ওপর ঘটে যাওয়া উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের ভয়াবহ দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছেন ওই দুর্ঘটনা তদন্তে গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৃথকভাবে পেশকৃত তদন্ত রিপোর্টে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনাকে রক্ষণাবেক্ষণ, দীর্ঘদিনের  সংস্কারহীনতা ও কর্তব্য কাজে গাফলতির বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদন গুলোতে এই দুর্ঘটনার কারণ ছাড়াও ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা রোধে নানা সুপারিশও রেখেছেন তারা। প্রতিবেদনগুলোর রিপোর্টের সঙ্গে একমত পোষণ করে স্থানীয় বাসিন্দা ও এ রোডের যাত্রীরা দুর্ঘটনা নিয়ে রয়েছেন শঙ্কায়। কারণ চরম ঝুঁকিতে থাকা দীর্ঘদিনের জরাজীর্ণ এই রোডের রেললাইন, ট্রেন, বগি, ইঞ্জিন, স্টেশন, ছোট-বড় ব্রিজ, স্লিপার, ফিসপ্লেট, জয়েন্ট পয়েন্ট, হুক, নাট বল্টু, ক্লিপ ও সিগন্যাল সংস্কার কিংবা নতুন ভাবে নির্মাণ না হওয়াতে কিছুতেই কাটছে না তাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। স্থানীয়দের তথ্য মতে মৌলভীবাজার জেলার ভেতর ভাটেরা থেকে সাতগাঁও পর্যন্ত শুধু কুলাউড়া অংশে একমাসেই ঘটেছে পাঁচটি দুর্ঘটনা। তবে এ পাঁচ দুর্ঘটনার ধরন ছিল একই। ত্রুটিপূর্ণ লাইন ও বগির কারণে লাইচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এসব ট্রেন। দুর্ঘটনার কবলে পড়া ট্রেনগুলো হলো উপবন, পাহাড়িকা, জয়ন্তিকা ও কালনী।

এসব দুর্ঘটনার কারণে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়সহ স্টেশনে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। গতকাল ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া কুলাউড়ার বরমচাল এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপে তারা ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন শুধু ঠিকঠাক আছে রেল সড়ক। আর সবই শুধু নেই আর নেই। রেল লাইন, ফিসপ্লেট, ক্লিপ, হুক, স্লিপার, নাট, বল্টু, সিগন্যাল সহযোগী যন্ত্রাংশ সবই আছে কেবল নামমাত্রই। মেয়াদ উত্তীর্ণ ইঞ্জিন, জরাজীর্ণ বগি, শিডিউল বির্পযয় এটা হল এ অঞ্চলের রেল বিভাগের চলমান ও দৃশ্যমান দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এ থেকে উত্তরণ কেবল আশ্বাসের ফুলঝুরি। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অঙ্গহানি কিছু দিন হৈচৈ। তারপর সবই আগের মত যেই সেই। তারা জানালেন কুলাউড়ার বরমচাল বড়ছড়া ব্রিজ এলাকার উপবন ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে এখনো আছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ জরাজীর্ণ রেল লাইন। ত্যানা (পুরাতন কাপড়), সুতলি, প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে আটকানো হয়েছে ফিসপ্লেট ও নাট বল্টু। অধিকাংশ স্থানে স্লিপারের সঙ্গে রেল লাইন আটকানোর হুক ও ক্লিপ নেই। জয়েন্ট পয়েন্ট ও ক্রসিং পয়েন্টের ফিসপ্লেট ও নাট বল্টু থ্রেটহীন অকার্যকর। এককথায় এরকম সিলেট-আখাউড়া রোড নাজুক অবস্থার রেল লাইন কোনো রকম জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখা হয়েছে। তাদের জোর দাবি দ্রুত ত্রুটিপূর্ণ ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ রেল লাইন, ট্রেন, স্টেশন ও ব্রিজ মেরামত ও নির্মাণের। যাতে এই অঞ্চলের মানুষের ট্রেন যাত্রা হয় নিরাপদ।

দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট: সম্প্রতি ওই দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। এ তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন রেলওয়ে বিভাগের একধিক সূত্র। জানা যায় ওই তদন্ত রিপোর্টগুলোতে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ত্রুটিবিচ্যুতিসহ ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে নানা সুপারিশও করেছেন তারা। তদন্ত প্রতিবেদনের একটিতে বলা হয়েছে রেলপথ যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছিল। এই প্রতিবেদন জমা দেয় ওই ঘটনায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। তারা জানায় ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় রেলওয়ের ২৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। দুর্ঘটনায় পাঁচ জনকে দায়ি করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে। সমপ্রতি প্রতিবেদনটি রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেয়া হয়েছে। ২৩শে জুন রাতে সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি রাত সাড়ে ১১টার দিকে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকার বড়ছড়া ব্রিজে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এ সময় রেলপথের একটি ব্রিজ ভেঙে ২টি বগি ব্রিজের নীচে ও অন্য ৩টি বগি খাদের পাশে পড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়। ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় চারজন নিহত ও প্রায় ৩ শতাধিক যাত্রী আহত হন। ঘটনার পর রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মো. মিজানুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি এবং বিভাগীয় এবং পাঁচ সদস্যের অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে রেলপথ মন্ত্রণালয় বলেছে দুর্ঘটনাস্থলের রেলপথ ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণের সার্বিক দায়িত্বে থাকা মহাব্যবস্থাপক, প্রধান প্রকৌশলী ও বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক এই দুর্ঘটনার বিষয়ে তাদের দায় এড়াতে পারেন না। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে ও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে রেলওয়ের মহাপরিচালককে বলা হয়েছে। এদিকে মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে অপর তদন্ত কমিটি বলেছে ওই দুর্ঘটনায় যান্ত্রিক বিভাগের ২৩ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫৭ টাকা, সিগন্যাল অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের ২ লাখ ৩৯ হাজার টাকা এবং প্রকৌশলী বিভাগের ২ লাখ ৬ হাজার ৯০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয় মূলত দুর্ঘটনাস্থলের রেলপথ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়াও ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব জায়গায় রক্ষণাবেক্ষণ ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে দ্রুত সেগুলো মেরামত করা। ওয়ে অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ম্যানুয়েলের নির্দেশনা নিয়মিত এবং যথাযথভাবে সম্পাদন করা। আখাউড়া-সিলেট সেকশনে কর্মকর্তা পর্যায়ে নিয়মিত ট্রলি নিয়ে পরিদর্শন করে ত্রুটি শনাক্ত করা। মেরামত করাসহ সাত দফা সুপারিশও করেন তারা।

এদিকে বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি তিন দফা সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো- বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এমন স্থান, সেতু, রেললাইন শনাক্ত করে ত্রুটিমুক্ত করা এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ; ট্র্যাক ও কোচ রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদগুলোর শূন্যপদে জরুরি জনবল নিয়োগ এবং ট্র্যাক ও কোচ রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়াতে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বিভাগীয় পর্যায়ের কমিটির প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (এসএসএই) মো. জুলহাস ও মেট (নির্দিষ্ট এলাকায় রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি) সাইফুল আলমকে দায়ী করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে সংসদীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status