প্রথম পাতা

ঢাকায় জয়শঙ্করের ব্যস্ত দিন

এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়

কূটনৈতিক রিপোর্টার

২১ আগস্ট ২০১৯, বুধবার, ৯:১২ পূর্বাহ্ন

আসামের বহুল আলোচিত নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশে তৈরি হওয়া উদ্বেগ ‘উড়িয়ে দিয়ে’ সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর বলেছেন, এটি একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। মঙ্গলবার দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন ছিল আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) থেকে অনুপ্রবেশের কথিত অভিযোগে ৪০ লাখ ভারতীয় বাদ পড়া এবং তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে মর্মে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রিপোর্টের প্রেক্ষিতের যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, এ নিয়ে বৈঠকে কোন আলোচনা হয়েছে কি-না? সেখানে জবাব না দিলেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন পরে নিজ দপ্তরে ফিরে পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, না, বৈঠকে এনআরসি নিয়ে কোন কথা হয়নি। দুই মন্ত্রীর কথায় উঠে আসে বৈঠকে বাংলাদেশের বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি সইয়ের বিষয়ে ‘ইতিবাচক’ আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সইয়ের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি আছে কি-না, যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সরাসরি এমন প্রশ্নে দিল্লির বিদেশমন্ত্রী ড. জয়শঙ্কর বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের একটি প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। দুই দেশের ৫৪ নদীর পানি বণ্টনের ‘ফর্মুলা’ বের করতে সম্মত বাংলাদেশ ও ভারত জানিয়ে তিনি বলেন, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের দু’পক্ষই লাভবান হয়, এমন একটি ফর্মুলা বের করার জন্য আমরা আলোচনায় সম্মত হয়েছি। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার ওই সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ-ভারত শক্তিশালী অংশীদারিত্বের প্রেক্ষিত এবং বাস্তবতা, একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে যেসব বিষয়ে মোটাদাগে আলোচনা হয়েছে তার খানিকটা তুলে ধরেন ড. জয়শঙ্কর। বলেন, আমাদের সম্পর্ক আজ কৌশলগত অংশীদারিত্বে রুপান্তরিত হয়েছে। ব্রিফিংয়ে তিনি তার সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, আমার সফরের দু’টি উদ্দেশ্য।

প্রথমতঃ আমাদের দুই দেশের অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্টোবরের ভারত সফরের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা। মন্ত্রী বলেন, আমরা তাকে (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে) দিল্লিতে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় আছি। আগামী ২২ শে আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার প্রস্তুত রয়েছে বাংলাদেশ। চীনের মধ্যস্থতা ও ভারতের উৎসাহে সেই প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। বাস্তচ্যুতদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বৈঠকে যে আলোচনা হয়েছে সেই প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে বাস্তুচ্যুতদের দ্রুত প্রত্যাবাসন চায় ভারত। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের জাতীয় স্বার্থেই প্রত্যাবাসন হওয়া জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বাস্তুচ্যুতদের আরও সহায়তা প্রদান এবং রাখাইন রাজ্যের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করতেও তাদের প্রস্তুতি থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। জানান, প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে ভারত এরই মধ্যে ২৫০টি বাড়ি তৈরি করেছে এবং তা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। প্রতিবেশী প্রথম নীতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ায় ‘রোল মডেল’ হিসেবে উল্লেখ করে জয়শঙ্কর বলেন, আমরা এখন গোল্ডেন এইজ বা সোনালী অধ্যায় পার করছি। এর সূচনা করেছে  প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারা যে রুপরেখা ঠিক করেছেন সেটির সঙ্গে তিনি আগে পররাষ্ট্র সচিব এবং বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে যুক্ত থাকতে পেতে গর্বিত। বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য ক’টি খাত এবং অগ্রগতিও তুলে ধরেন তিনি। যার মধ্যে ছিল নিরাপত্তা, কানেক্টিভিটি, পানি বণ্টন সহযোগিতা, মানুষে-মানুষে যোগাযোগ ইত্যাদি। নিরাপত্তা ইস্যুতে দুই দেশের যে যৌথ প্রয়াস তার সুফল উভয় দেশের জনগন পাচ্ছে উল্লেখ করে  জয়শঙ্কর বলেন, আমরা এ নিয়ে আজকের বৈঠকেও আলোচনা করেছি। নিরাপত্তা বিষয়ে সহযোগিতা যত বাড়বে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা ঠেকানো এবং অপরাধ ততই নিয়ন্ত্রণে থাকবে। জ্বালানি নিরাপত্তা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করে জয়শঙ্কর বলেন, এ খাতে আমাদের দুই দেশের সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রজেক্ট ও সহযোগিতা রয়েছে। এটি আরও বাড়বে।

আমরা এ নিয়ে আলোচনা করেছি, এটি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। যোগাযোগ-কানেক্টিভিটির বিষয়ে তিনি বলেন, আকাশ, স্থল ও নৌ যোগাযোগে পারস্পরিক সহযোগিতায় আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এটি আরও বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা সব সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে চাই। ভারতীয় মন্ত্রী জানান, বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো, যা ভারতের স্বার্থেও অন্তর্ভুক্ত তা বাস্তবায়নে তারা সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা দিতে চান। জয়শঙ্কর বলেন, দু’দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ অভিন্ন ইতিহাস রয়েছে। তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনে অংশ নেয়ার অপেক্ষায় আছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে  সম্পর্ককে ভারত কতটা  গুরুত্ব দেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের আগে বিদেশমন্ত্রীর সফর এর অন্যতম উদাহরণ। দুই দেশের মানুষে-মানুষে সংযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারতের সবচেয়ে বড় কনস্যুলার সেবা এখন বাংলাদেশে পরিচালিত হচ্ছে এবং এ নিয়ে ভারত গর্বিত। জয়শঙ্কর বলেন, আমরা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে গর্ব বোধ করি।

সংবাদ সম্মেলনে ‘দারুণ বৈঠক’ হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। বলেন, সব বিষয়েই আমরা কম-বেশি মতৈক্যে পৌঁছেছি। বৈঠক শেষে তার সম্মানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার কথা হয়। চলতি বছরের মে মাসে ভারতের ৩৮তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এটি জয়শঙ্করের প্রথম বাংলাদেশ সফর। তিন দিনের সফরে সোমবার রাতে ঢাকায় পৌঁছান তিনি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। ঢাকায় নেমেই জয়শঙ্কর সম্পর্ক  বাড়ানোর বার্তা দেন। বলেন, ‘আমাদের মধ্যে ভালো ও দূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। আমরা এটাকে আরও উচ্চ পর্যায়ে নিতে চাই। এ জন্য আমাদের আলোচনার অনেক বিষয় রয়েছে। মঙ্গলবার দিনের শুরুতে ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে সফরের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের সূচনা করেন তিনি। বিকেলে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। রাতে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাসের নৈশভোজে অংশ নেন। তিন দিনের সফর শেষে আজ সকালে তার কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। উল্লেখ, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনার জন্য আগামী অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করবেন। ৩ ও ৪ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটে যোগ দেবেন তিনি। বহুপক্ষীয় ওই আয়োজনের পাশাপাশি দিল্লি শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হবে। এ সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গতকাল সন্ধ্যায় হস্তান্তর করেন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর। সরকার প্রধানের আসন্ন দিল্লি সফরে ডজনখানেক চুক্তি সইয়ের কথাবার্তা চলছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status