দেশ বিদেশ

হারিয়ে যাচ্ছে সর্ববৃহৎ চামড়া বাজার

এবিএম আতিকুর রহমান, ঘাটাইল (টাংগাইল) থেকে

১৯ আগস্ট ২০১৯, সোমবার, ৯:২২ পূর্বাহ্ন

টাংগাইলের ঘাটাইল উপজেলার পাকুটিয়াতে গড়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ চামড়া বাজার পাকিস্তানের হাট। বৃটিশ আমলের পর থেকে অবিভক্ত ভারত পাকিস্তান শাসন আমল থেকেই এই হাটটি পাকিস্তানের হাট নামে পরিচিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮১ খ্রি. থেকে নতুন করে এই হাটের নামকরণ করা হয় পাকুটিয়া চামড়া বাজার। মূলত চামড়া শিল্পকে ঘিরেই এই হাটটি বর্তমানে দেশের সর্ববৃহৎ চামড়ার বাজার পাকুটিয়া হাট নামে পরিচিত। প্রতি সপ্তাহের রোববার ও বুধবার চামড়ার হাট বসে এখানে। চামড়ার পাশাপশি ধান-পাট সহ প্রয়োজনীয় সকল কিছুই পাওয়া যায় এই হাটে। মধুপুর, গোপালপুর ও ঘাটাইল উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে এই হাটটি গড়ে উঠায় সারা দেশের মানুষ এক নামে পাকুটিয়া চামড়া বাজার হিসেবে যানে। বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর সহ বৃহত্তম ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা থেকে চামড়া বেচাকেনা করতে আসে এই হাটে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে টেনারি মালিক, বিভিন্ন কোম্পানির এজেন্ট, বড় বড় মহাজন, ঋষি, ফড়িয়া সহ মৌসুমি ব্যববসায়ীদের পদচারণায় লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে এই হাট। ঈদের সময় আরো বেশি লোকের সমাগম ঘটে এখানে। গতকাল রোববার (১৮ই আগস্ট) ছিল ঈদ পরবর্তী প্রথম হাট। কিন্তু সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। যে হাটে অন্যান্য বছর কয়েক লক্ষ্য চামড়া আমদানি হয় সেখানে এ বছর ৫০ হাজার চামড়াও আমদানি হয়নি। যৎ সামান্য যে পরিমাণ চামড়া হাটে উঠেছে সেগুলোও কেনার মতো ক্রেতা হাটে আসেনি। স্থানীয় বল্লা বাজার, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ থেকে ১০/১২টি কোম্পানির এজেন্ট, ছোটখাটো কয়েকটি টেনারির মালিক ও স্থানীয় কয়েকজন ক্রেতা ছাড়া বড় কোনো কোম্পানির মালিক বা এজেন্টদের চোখে পড়েনি। যে কয়েকজন টেনারির মালিক বা এজেন্ট এসেছে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। সরকার এ বছর আমাদের চামড়া কেনার জন্য কোনো ব্যাংক লোন দেয়নি। টাকার অভাবে আমরা চামড়া কিনতে পারছি না। সরকার চামড়ার রেট নির্ধারণ করে দিয়েছেন ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় প্রতিবর্গ ফুট চামড়া ক্রয় করতে। স্থানীয়ভাবে চামড়া ক্রয় করতে হবে ২৫ থেকে ৩৫ টাকা বর্গফুট। কারণ হিসাবে তারা বলেন- এখান থেকে চামড়া ক্রয় করে নিলে প্রতি চামড়া প্রতি আমাদের খরচ হবে আরো অতিরিক্ত ২০০ টাকা। ট্রান্সপোর্ট খরচ, লবণ খরচ, শ্রমিক খরচ সহ আরো অন্যান্য খরচ এর সঙ্গে যুক্ত হবে। মো. ইউসুফ হোসেন এসেছেন ঢাকা কেরানীগঞ্জ থেকে। ইউসুফ লেদার কর্পোরেশন নামে তার একটি লেদার ফেক্টরি রয়েছে। তিনি বেছেবেছে মোটা প্রথম শ্রেণির গরুর চামড়া ক্রয় করতে মৌসুমি ব্যবসায়ীর সঙ্গে দর-দাম মিটাচ্ছেন ও উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে চামড়া দেখছেন। জামালপুর মেলান্দ থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ী জগাই প্রতি চামড়ার দাম হাঁকছেন-১২০০ থেকে ১৪৫০ টাকা। চামড়া দেখাশুনা শেষে ইউসুফ হোসেন দাম বলছেন ৫০০ থেকে ৫৮০ টাকা। বনিবনা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বিক্রি করতে পারলেন না জগাই। এ রকম কালাম টেনারির এজেন্ট আহাম্মদ বাদশা, মঞ্জু টেনারির এজেন্ট দিন ইসলাম, হক ট্রেডার্সের এজেন্ট মো. সাইদুল হক, মাসুদ টেনারির এজেন্ট ফরিদুজ্জামান, আর. কে লেদার কোম্পানির এজেন্ট মো. মাসুম মিয়া সহ বেশ কিছু এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় খুচরা ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ দাম চাচ্ছেন তাতে চামড়া কেনা সম্ভব নয়। আমাদের বাজেটের চেয়েও দুই তিন গুণ বেশি দাম চাচ্ছেন তারা। অপর দিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুচরা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে হাটে এসেছেন।

তাদের অভিযোগ, আমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বা স্থানীয়ভাবে যে চামড়া সংগ্রহ করেছি প্রতি পিস চামড়ার পিছনে আমাদের লবণ, চামড়া ঝুলানো, ট্রান্সপোর্ট খরচ, শ্রমিক খরচ, নিজের পারিশ্রমিক সহ আমাদের প্রতি পিস চামড়া বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসতে খরচ হয়েছে অর্থাৎ পর্তা পড়েছে গড়ে ৭৫০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা। সেখানে মহাজন ও টেনারি ব্যবসায়ীরা দাম বলছেন ৫০০ টাকা থেকে ৬৮০ টাকা। আমাদের মতো অনেকেই ২০০ থেকে ৬০০ পিস করে চামড়া নিয়ে এসেছে। প্রতি পিস চামড়ায় লোকসান দিতে হবে ৯০ থেকে ২২০ টাকা। এমন আকাশ-পাতাল তফাৎ হলে চামড়া বিক্রি করবো কিভাবে। সারা বছর উপার্জন করতে পারি না বুকভরা আশা নিয়ে চামড়া বিক্রি করতে এসেছি কিছু টাকা লাভ করে পরিবার পরিজন নিয়ে ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার আশায়। সেখানে লাভতো দূরের কথা এবার চামড়ায় আমাদের পথে বসাবে, ভিটামাটি বিক্রি করে দিতে হবে, না খেয়ে থাকতে হবে। মানুষের কাছে ধার দেনা করে সুদে টাকা নিয়ে চামড়া ক্রয় করেছি। এখন যে পরিমাণ টাকা চামড়ায় লোকসান যাবে তাতে আমাদের বেঁচে থাকাও বুঝি সম্ভব হবে না। গলায় দড়ি দিয়ে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমাদের।
বর্তমানে চামড়ার বাজারে যে ধস নেমেছে- এ ব্যাপারে টেনারি মালিক, বিভিন্ন কোম্পানির এজেন্ট, খুচরা ব্যবসায়ী ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু বুঝা যায় তারা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। বিশেষ করে সরকার যে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভাবে উদাসীন সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে।
এদিকে হাট মালিকরাও বিপাকে পড়েছেন। চাহিদা মতো চামড়া আমদানি ও বেচাকেনা না হওয়ায় তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তাদের অভিযোগ, চড়া মূল্য দিয়ে হাট ডেকে আনতে হয়েছে। আর দিন-দিন, মানুষ চামড়া ব্যবসা থেকে যেভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, তাতে ভবিষ্যতে পাট শিল্পের মতই হাড়িয়ে যাবে চামড়া শিল্প। ধানের দাম ৯ টাকা কেজি, অপর দিকে চাল কিনতে হচ্ছে ৫৫-৬৫ টাকা কেজি, গরুর চামড়া ১০০-২৫০ টাকা পিস, ছাগলের চামড়া ৫-১০ টাকা পিস। অপর দিকে চামড়া দিয়ে যে জুতা তৈরি হচ্ছে তার দাম ৩০০০-৩৯০০ টাকা জোড়া। এক কাঠি বেনসন সিগারেটের দাম ১৩-১৫ টাকা। লাল চা- ৫ টাকা, দুধ চা ১০ টাকা। সবজির বাজারে আগুন, গড়ে যেকোনো সবজি ৫০-৬০ টাকা কেজি। সকল প্রকার ওষুধের দাম নাগালের বাইরে। এভাবে চলতে থাকলে চামড়া শিল্প হারিয়ে যাবে রাতারাতি। আর দেশের সর্ববৃহৎ পাকুটিয়ার এই চামড়া বাজারটি এক প্রকার হারিয়েই গেছে- যেটুকু বাকি আছে আগামীতে এই হাটের অস্ত্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status