বাংলারজমিন

ডেঙ্গু টেস্টে ভিন্ন রিপোর্ট

খুলনায় লাল রক্তের কালো ব্যবসা

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা থেকে

১৮ আগস্ট ২০১৯, রবিবার, ৮:৫৪ পূর্বাহ্ন

রেজাউল হোসেন (৩৬)। গত শনিবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। রোগীর বড় ভাই আফজাল হোসেন বলেন, গত ১৪ই আগস্ট খুমেক হাসপাতালে তার ছোট ভাইয়ের প্লাটিলেট টেস্ট করানো হলে ১ লাখ ৪০ হাজার কাউন্ট হয়। পরের দিন সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একই টেস্ট করলে রিপোর্ট আসে মাত্র ১৭ হাজার। তারপর আসে ২৮ হাজার। একই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের টেস্টেও ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট আসে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে, রোগীর প্লাটিলেট কমে ১৭ হাজার নেমে এলে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি বেশি থাকে। একই অভিযোগ করেন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বাদশা ও ভগ্নিপতি রুহুল কুদ্দুস।
এ বছর মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। ডেঙ্গুর কারণে মানুষের শরীরের প্লাটিলেট কমে যায়। এ সমস্ত রোগীরা ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাটিলেট হচ্ছে রক্তের এক ধরনের ক্ষুদ্র কণিকা বা অণুচক্রিকা, যা রক্ত জমাট বাঁধতে ও রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে। স্বাভাবিক মানুষের রক্তে প্লাটিলেটের হার প্রতি ১০০ মিলিলিটারে দেড় লাখ থেকে চার লাখ। এই পরিমাপের চাইতে প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি দেখা দেয়। ২০ হাজারের নিচে প্লাটিলেটের সংখ্যা নেমে এলে কোনো প্রকার আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে।
সোনাডাঙ্গা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মমতাজুল হক বলেন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের টেস্ট নিয়ে ভুল রিপোর্ট দিয়েছে সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টার। রোগীদের সঙ্গে ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকদের হট্টগোল হয়। ভুল রিপোর্ট দিয়েছে রোগীদের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে দু’জনকে থানায় আনা হয়। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ (আরপি) ডা. শৈলান্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির প্লাটিলেট টেস্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট। একজন সুস্থ ব্যক্তি প্লাটিলেট দেড় থেকে ৫ লাখ কাউন্ট করা হয়। কারো যদি প্লাটিলেট কাউন্ট ১৭ হাজার নেমে আসে তাহলে সেই রোগী ঝুঁঁকিপূর্ণ হিসেবে থাকে। এসব রোগীর কোনোরকম আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ শুরু হবে। তখন রোগী ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। জানা গেছে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অধিকাংশ মেডিসিন ইউনিটে রোগীদের টেস্টের জন্য তাদের মনোনীত সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠাচ্ছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে কিছু অসাধু ডাক্তার টেস্টের নামে কমিশন বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন। যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বেশি কমিশন দেবেন সেখানেই রোগীদের টেস্টের জন্য চিকিৎসকরা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাদের মনোনীত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে টেস্ট না করানো হলে রিপোর্ট দেখেন না, রিপোর্ট ছুঁড়ে ফেলে দেয়ারও নজির রয়েছে। নৈতিক অবক্ষয়ের চক্রে পড়ে একশ্রেণির চিকিৎসক গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন কমিশনের জোয়ারে। তারা এখন সামান্য জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য লিখে দিচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির চিকিৎসকের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্ট-বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। ডায়াগনস্টিক প্রতারণার শিকার হচ্ছেন মানুষজন। একাধিকবার অভিযোগ মিললেও প্রতিকার মিলছে না। রোগী তার পছন্দমতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে চিকিৎসক সেই রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। তিনি তার নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টার তাকে কমিশন দেয়। কমিশন নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চিকিৎসা মেলে। পরীক্ষার ফি বাবদও আদায় করা হচ্ছে ইচ্ছেমাফিক টাকা-পয়সা। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করিয়েও সঠিক রোগ নির্ণয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।
সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে লাল রক্তের কালো ব্যবসার অভিযোগ: সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টগুলো ভুল বলে রোগীদের অভিযোগ। এরা ডাক্তারকে মোটা অঙ্কের কমিশন দিয়ে এখান থেকে টেস্ট করাতে বলেন রোগীদের। ডাক্তারও সন্ধানীতে টেস্ট করার জন্য পরামর্শ দেন। আবার তাদের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে টেস্ট না করালে রিপোর্ট ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেন।
রোগীর স্বজন আফজাল হোসেন সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে খুলনার সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। র‌্যাব-৬ এর একটি টিম তাকে নিয়ে ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যান।
সোনাডাঙ্গা মডেল থানার ডিউটি অফিসার এএসআই বিশ্বজিৎ বলেন, রোগীর স্বজন আফজাল হোসেন সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
খুলনা সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড ক্লিনিকের সহকারী ম্যানেজার বলেন, আমাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্টাফ অশিষ রায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এসে রোগীদের রক্ত নিয়ে আসে। রিপোর্টও পৌঁছে দেয়। এখানকার ডাক্তারদের অনুমতি নিয়ে রোগীদের রক্ত নিয়ে আমাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করেন। কয়েকজন রোগীর প্লাটিলেট ১৬ হাজার নেমে আসে আমাদের রিপোর্টে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টেস্ট করলে তাতে আসে ১ লাখ ১০ হাজার। রিপোর্টটি আমাদের ভুল কিনা, তা জানার জন্য ডাক্তার সুকুমার সাহাকে ফোন দিলে তিনি আমাকে বলেন, অন্য আরেক জায়গায় ওই রোগীকে টেস্ট করাতে। আমার রিপোর্ট ভুল না বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ল্যাব এ্যাসিসটেন্ট অশিস রায় ও তার ভাই দেবাশীষকে সোনাডাঙ্গা থানা পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের প্যাথলজিস্ট ডা. সুকুমার সাহা আমাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টগুলো করেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status