মত-মতান্তর

‘তিন প্রহরের বিল’ অনেক অনেক দূর!

রফিকুজজামান রুমান

২৫ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১২:৫৮ অপরাহ্ন

আজ কেবলই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কেউ কথা রাখেনি কবিতাটির কথা মনে পড়ছে। কথা না-রাখাদের বয়ানে সুনীল এক জায়গায় বলেছেন,
        মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
        তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো।
        সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে।

        নাদের আলী, আমি আর কতো বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?  

ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতির বৃত্তের বাইরে থাকা অধিকাংশ মানুষই আজ এক একজন ‘সুনীল।’ ক্ষমতায় বসে থাকা ‘নাদের আলী’দের কাছে আমাদের প্রাত্যহিক জিজ্ঞাসা, আমরা আর কতো সয়ে যাব? রাজনীতি আর ক্ষমতার বাইরে যে একটি মানবিক জীবন আছে, তা আর কত ক্ষতবিক্ষত হলে আমরা ঘুরে দাঁড়াব? আমাদের মানবিক বোধ আর কত নিচে নামলে আমরা থমকে দাঁড়াব? হাহাকারের দেয়াললিখনে ভরে গেছে সমস্ত নগর। বায়ুমণ্ডলে মানুষের অসহায় দীর্ঘশ্বাসের জমাট আঁধার। নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকা সকালগুলো আরো বেশি মেঘে-ঢাকা নিকষ কালো। অপেক্ষায় কাটে আমাদের দিনগুলো, এই বুঝি ফুরালো রাত। সোনালি সকাল আর আসে না। আমরা তো ক্ষমতা চাইনি। আমরা তো চাইনি সবকিছু আমাদের মতো করে হোক। আমরা তো চাইনি ‘গণতন্ত্র না উন্নয়ন’ এই অনন্ত বাহাস। আমরা সংবিধানের কোনো ব্যাখ্যা চাইনি। আমরা ভুলেও মানিক মিয়া অ্যভিনিউর ঐ ধূসর ভবনটির ভেতরে যেতে চাইনি। বর্ষার স্নিগ্ধতায় গণভবনের সবুজ চত্বরে কী মায়াবী প্রাণ! কিন্তু আমরা তো গণভবনের দিকে কোনোদিনও পা বাড়াইনি। সবুজ দেখার ইচ্ছে হলে ছুটে গিয়েছি নিজের গ্রামে। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস- এর ব্যাখ্যা তো কোনোদিনও আমরা চাইনি। আমরা তো শুধু চেয়েছিলাম ‘তিন প্রহরের বিল’ দেখতে। আমরা তো আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবনগুলো যাপন করতে চেয়েছিলাম। আমরা তো চেয়েছিলাম আমাদের মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক হোক। আমরা তো একটি রাষ্ট্র চেয়েছিলাম, যেখানে জীবন সবচেয়ে দামী!
অথচ কী অবলীলায় এখানে মৃত্যু নেমে আসে চারিধারজুড়ে! জীবনের পরাজয়ের কী নিদারুণ ক্যানভাস বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রটি। দিনগুলো কী নির্মম এই জনপদে। রাতের গায়ে লেপটে থাকে অন্ধকারের চেয়েও নিকষ কোনো কালিমা। ভোরের সূর্যোদয়কে মনে হয় মরীচিকা। সূর্যের সমস্ত গা জুড়ে থাকে দুই বছরের ধর্ষিতা শিশুর লাল রক্ত। কে নিরাপদ এই দেশে? এমন ভয়াবহ অরাজকতার মধ্যে প্রত্যেকেই এক একজন মানসিক রুগি। সন্তানকে স্কুলে/কলেজে/বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে নিশ্চিত নন বাবা-মা। দুর্ঘটনার ভয়। তার চেয়েও বেশি ভয় শিক্ষক নিজেই! কোন ছাত্রীকে দেখে শিক্ষকের অবদমিত ‘পৌরুষত্ব’ জেগে ওঠে! ‘পরিমল’ তো শুধু একজন নয়। নিরাপদ নয় ছাত্রও। এমনকি মাদ্রাসাও কখনো কখনো খবর হয়। কী এক আদিম উন্মত্ততায় মোড়ানো সময় আমরা অতিক্রম করছি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হলো নিষ্পাপ শিশুর নির্মল হাসি। রাষ্ট্র সেই হাসির মূল্য নির্ধারণ করতে পারেনি। শিশুও নিরাপদ নয় যেই রাষ্ট্রে, সেখানে গোলাপ ফোটে না। চারিদিকে তাই মাকালের চাষ। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম ১৫দিনেই কমপক্ষে ৪০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।  ২০১৮ সালে ৩৫৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, যার মধ্যে মারা গেছে ২২ জন। স্কুলে, মাদ্রাসায়, কোচিং সেন্টারে, বাসে- সর্বত্র ধর্ষণের মিছিল। টঙ্গীতে ১২ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে জন্মদাতা বাবা! এই কালো সময়কে আপনি কি দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন?

বাবার যাবজ্জীবন হয়েছে। বেঁচে গেছে সমাজ, সংস্কৃতি আর রাষ্ট্র। যে সমাজ এমন বাবাদেরকে তৈরি করেছে, যে সংস্কৃতি বাবাদেরকে এমন অমানুষ বানিয়েছে, যে রাষ্ট্র এর বিপরীত কোনো সংস্কৃতির অনুশীলন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তার বিচার করবে কে? ছেলের হাতে মা খুন হচ্ছে। পরকীয়ায় জড়িয়ে নিজের হাতে মা খুন করছে ছেলেকে। পাষণ্ড যুবক শিশুকে জবাই করে বিচ্ছিন্ন মাথা ব্যাগে ভরে নিয়ে যাচ্ছে। আরো কত অভাবনীয় ঘটনা প্রবাহে লিখিত হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিদিনের ইতিহাস। কিন্তু যে ‘সময়’ এমন অমানুষ তৈরি করছে, তার পরিপূর্ণ পোস্টমর্টেম ছাড়া শুধু অপরাধীকে গালি দিলে সমাধান মিলবে না। ঐ বাবার হাতেই হয়ত পর্নোগ্রাফিতে ভরা মোবাইল ফোন। ঐ মা-ই হয়ত টেলিভিশন সিনেমায় পরকীয়ার রমরমা কাহিনী দেখে দেখে উদ্বুদ্ধ। ঐ যুবক হয়ত লোভাতুর কোনো প্রলোভনের শিকার। আমরা যন্ত্র বানিয়েছি; যন্ত্র ব্যবহার করার মন্ত্র শিখিনি! লোভে, পাপে, কামনায় জর্জড়িত দমবন্ধ করা সময় আমরা অতিক্রম করছি।

আহা, তাসলিমা বেগম রেনু! ছেলেধরা সন্দেহে সাপের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো এই মাকে। মানুষ আর একজন মানুষকে পিটিয়ে মারছে শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে! ছোট্ট মেয়ে তুবার প্রতি ফোটা কান্নার যে অভিশাপ, তাতে শুদ্ধ হবে চলমান এই সময়? হবে না। আমাদের সামষ্টিক পাপের প্রায়শ্চিত্য এতো সহজে হবে না। আমাদের আরো অনেক কান্না বাকি আছে। আরো অনেক দুর্ভোগ আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে আছে। “তিন প্রহরের যে বিল” আমরা দেখতে চেয়েছিলাম, তা অনেক অনেক দূর।

 লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status