বাংলারজমিন

‘সারা রাত দুয়ারে মাইনসের পায়ের তলোত বসি রাত কাটালাম’

সিদ্দিক আলম দয়াল, উত্তরাঞ্চল থেকে

২১ জুলাই ২০১৯, রবিবার, ৮:৪৯ পূর্বাহ্ন

‘মোক এ্যানা থাকার জাগা দিলো না। সারারাত দুয়ারের পাশে মাইনসের পায়ের তলোত চিপার মদে বসি রাত কাটালাম। কী মানুষ বাহে বুড়া ছ্যাড়া কেউ মোর কতা এ্যানা কলো না। সেই জন্যে মোক এক থাল ভাত আর এক টুকর ডিমও দিলো না। মাইনসের এ্যাটাসেটা খায়া আছোম চিপার মদে।’ এ কথাগুলো বলেন, বৃদ্ধ হামিদা বিবি। গাইবান্ধা শহরের দক্ষিণ বানিয়ারজান গ্রামের বাসিন্দা। স্বামী মোকলেস মিয়া মারা গেছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। তখন তিনি তিন ছেলে আর এক মেয়ের মা। ঘরবাড়ি গরু-বাছুর ছাগল হাঁস-মুরগিসহ ভরা সংসার তার। তিন বেলা ভাতের যোগাড় হয় তিন ছেলে কামাই রোজগার থেকে। ছেলেরা সবাই বিয়ে করে আলাদা হলেও মাকে বাদ দিয়ে খেতে পারে না সোলায়মান আলী। মেয়ে আছমার বিয়ে হয়েছে পলাশবাড়ীর নুনিয়াগাড়ী। বাড়িতে ভালোই কাটছিল। কিন্তু আলাই নদীর পানি উপচে পানি প্রবেশ করে গাইবান্ধা পৌর এলাকায়। হঠাৎ পানি এসে বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে বানিযারজানসহ বিভিন্ন এলাকা। পানির কারণে মাকে রেখে ছেলে আকবর, সোলেমান, আশরাফ বউ নিয়ে চলে যায় শ্বশুরবাড়ি। তারা রাস্তার পাশে রিকশাভ্যান রেখে চলে যায়। পাহাড়ায় থাকতে দেন বৃদ্ধ মা হামিদাকে। হামিদা বেগম একাই বাড়িতে ১২ তারিখ থেকে বন্যার পানিতে পাহারা দেন। রান্নাবান্না আর খাওয়া। পানি যতোই বাড়তে থাকে চারপাশের বাড়ির মানুষ ততই ছেড়ে যেতো থাকে ঘরবাড়ি। ২০ তারিখ থেকে শূন্য হয়ে পড়ে হামিদা বিবির গ্রাম। তখন হামিদা বিবির ঘরেও এক বুক পানি। বাধ্য হয়ে এক মাইল দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বুক পানি ডিঙিয়ে হামিদা বিবি আসেন জুবিলী সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ে। পরনের কাপড় ছাড়া সব ফেলে রেখে আসতে বাধ্য হন তিনি। ভেজা গায়ে ক্লান্ত হয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় খালি হাত পায়ে পৌঁছেন সেখানে। ওই আশ্রয় কেন্দ্রে তখন অন্তত ৪ শ’ পরিবার জায়গা করে নিয়েছে। ছাদ, মেঝে, বারান্দা কোনো জায়গা ফাঁকা নেই। তারপরও চেনা মানুষ দেখে বসে পড়েন দরোজার পাশে। বসার জায়গাটুকুও কেউ ছাড়তে রাজি নয়। তাই দূর দূর করে তাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন অনেকেই। বলেন, হামারে জাগা নাই, আর তুমি কোটে থাকপেন? যাও এটে থাকি। সুমন নামের এক যুবক বলেন, আমরাই থাকি এক রুমে ১৫ ফ্যামিলির ৪৬ জন। তোমাক কোটে জাগা ছাড়ি দেমো? কথা শুনে নির্বাক হামিদা বিবি। তিনি উত্তরে বলেন, খাই না খাই এ্যাত্তি থাকমো। শনিবার সকালে গিয়ে তার সঙ্গে কথা হলো। তিন ক্যামেরা আর সাংবাদিক দেখে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, বাবা মোক তোমরা কবরত থুইয়া আসো। এতো মানুষ শুতি ঘুমালো। মোক এ্যানা শুতপার দিলো না। সারারাত দরজার টিপাত বসি রাত পার করলাম। সগলোকে অর্ধেক ডিম আর ভাত দিলো মোক কিছু দিলো না। না খায়া আছিলাম সারারাত। এ্যার চায়া দোজখের আজাবও ভালো । সকালে একজনে দেখিয়া কয় দাদী এখন তুমি শুতি থাকো হামার কাম আছে।
এ আশ্রয়কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবক মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলী জানান এই কেন্দ্রে সাড়ে ৪ শ’ নারী শিশু বৃদ্ধর আশ্রয় হয়েছে। ছাদেও জায়গা নাই, সিঁড়িতেও জায়গা নাই। তাই নতুন কোনো মানুষের হয়তো কারো জায়গা নাও হতে পারে। তবে হামিদা বিবির ঠাঁই দেয়ার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status