বাংলারজমিন
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
বাংলারজমিন ডেস্ক
১৬ জুলাই ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:৩৬ পূর্বাহ্ন
ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের প্রায় ২৪ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। হাজার হাজার ঘরবাড়ি, পাকা ও আধাপাকা রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। শত শত বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বিস্তারিত আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে-
পাকুন্দিয়ায় কয়েক হাজার
মানুষ পানিবন্দি, দুর্ভোগ
পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে পাকুন্দিয়া পৌর এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা, অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি নির্মাণ ও পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে ফেলায় এ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে বাড়িঘর, স্কুল-কলেজের মাঠ, ফসলি জমি, আমন ধানের বীজতলা, পানের বরজ ও ফিশারিসহ বিভিন্ন রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। এতে এলাকাবাসীর দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়াও কৃষকের প্রায় পাঁচ শতাধিক বিঘা ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানায়, ২০০৭ সালে পাকুন্দিয়া পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালে প্রথম নির্বাচনে অ্যাডভোকেট মো. জালাল উদ্দিন পৌরমেয়র নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের নির্বাচনে বর্তমান মেয়র মো. আক্তারুজ্জামান খোকন নির্বাচিত হন। পৌরসভা প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডসহ পুরো এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের মাঠ ও রাস্তাঘাটে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ায় হাঁটুপানি পেরিয়ে চলাচল করতে হয়। এ ছাড়াও পাঁচ শতাধিক বিঘা ফসলি জমি, পানের বরজ ও ফিশারিসহ বিভিন্ন ফসল তলিয়ে কৃষকের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
পৌর এলাকার চরপাকুন্দিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী রাজন সরকার বলেন, গত কয়েকদিন ধরে হাঁটু পানি ভেঙে বাসায় আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা, অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের পথ ও সরকারি খাল দখল করে ভরাট করায় এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে মেয়রের কাছে একাধিকবার দাবি জানালেও এখনো তিনি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
এ ব্যাপারে পৌর মেয়র মো. আক্তারুজ্জামান খোকনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় জমি ভরাট করে বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করায় নির্বিঘ্নে পানি চলাচল করতে পারছে না। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এই জলাবদ্ধতা নিরসনে কিছু কিছু এলাকায় ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য এলাকায়ও ড্রেন নির্মাণ করা হবে।
গাইবান্ধায় ৪ পয়েন্টে বাঁধে ধস
উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধায় প্রতিদিন তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ঘাঘটসহ সব নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সদরসহ ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জের চরসহ অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ।
প্রবল পানির চাপে সকালে ব্রহ্মপুত্র নদের গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কাতলামাড়ি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ৩শ’ ফুট ও একই এলাকায় অন্য একটি পয়েন্টে ৫০ ফুট ধসে প্রায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে দুর্গত এলাকার মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণে বাঁধ ধসের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। অন্যদিকে গাইবান্ধা শহর সংলগ্ন ঘাঘট নদীর তিনটি পয়েন্টে বাঁধ ধসে অন্তত ২৯ ঘরবাড়ি পানিতে ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শতাধিক বাড়িঘর। প্লাবিত হয়েছে আরো অন্তত ৪ ইউনিয়নের ৪০টি গ্রাম।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে দুর্গতদের জন্য ৮৫টি ফ্লাড শেল্টার খোলা হয়েছে। আবার অনেক এলাকায় দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। গাইবান্ধার বাগুড়িয়ায় বাঁধ ভেঙে হঠাৎ পানি প্রবেশ করায় তলিয়ে গেছে নতুন নতুন এলাকা। এদিকে, ফুলছড়ির কাতলামারীতে যমুনা নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ২ শতাধিক ঘরবাড়ি। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার। অনেকেই গবাদি পশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি
বিপদসীমার উপরে
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির কারণে সিরাজগঞ্জের হার্ট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ সেন্টিমিটার বেড়ে বর্তমানে বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে, যমুনা নদীর পানি কাজিপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম পানি বৃদ্ধির তথ্য জানিয়ে বলেন, আগামী ২-৩ দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে এনায়েতপুরের ব্রাহ্মণগাতী, আড়কান্দি, হাটপাচিল ও কাজিপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া, বাঐখোলা পাটাগ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার বেশকিছু বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের মানুষ। বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুরের মাছ। অনেকে বাড়িঘর নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে বাঁধের পাশে আশ্রয় নিচ্ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে চরাঞ্চলে ফসলি জমিগুলো পানিতে ডুবে যাচ্ছে। অপরদিকে, জেলা প্রশাসন বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে।
নাটুয়ারপাড়া রক্ষা বাঁধে ধস
কাজিপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কাজিপুর পয়েন্টে যমুনা বিপদসীমার ৩৪ সে.মি উপর দিয়ে বইছে। এতে করে উপজেলার নতুন নতুন এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান। আর প্রবল স্রোতে উপজেলার নাটুয়ারপাড়া এলাকা রক্ষা বাঁধের মাথায় দেখা দিয়েছে ধস। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ওই বাঁধের প্রায় ৩শ’ মিটার ধসে গেছে। পানির প্রচণ্ড ঘূর্ণাবর্তের কারণে ধসে গেছে নাটুয়ারপাড়া থেকে খাসরাজবাড়ি ইউনিয়ন যাওয়ার প্রধান রাস্তাটি। এ ছাড়া রূপসা থেকে বালিয়াকান্দি পর্যন্ত রাস্তার একাংশ ধসে গেছে। চরপানাগাড়ি থেকে জজিরা যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটিও গতকাল ভোরে ধসে গেছে। এতে নাটুয়ারপাড়া হাট-বাজারের ৪ শতাধিক ব্যবসায়ীসহ ভাঙন এলাকার জনগণ চরম আতঙ্কে রয়েছে। অনেকে বাঁধের আশেপাশের এলাকায় আশ্রয় নিচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ব্যবসায়ী দেলশাদ সরকার জানান, রোববার দুপুরে প্রবল স্রোতের আঘাতে নাটুয়ারপাড়া হাট-বাজারের পূর্ব পাশের বাঁধের মাথায় ধস দেখা দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় ২শ’ মিটার বাঁধ যমুনার নিচের দিকে দেবে যায়। বিকালে ওই বাঁধের ভাঙন দেখতে যান কাজীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সিরাজী ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার একেএম শাহা আলম মোল্লা।
শাল্লায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
শাল্লা (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জ সদরসহ উজানের পানি কমলেও অবিরাম বৃষ্টির কারণে প্লাবিত হচ্ছে ভাটির উপজেলা শাল্লা। প্রতিদিনের ন্যায় গতকাল সকাল থেকে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে উজানের পানিও নামছে ফলে নতুন নতুন গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করছে। বাড়তে শুরু করেছে শাল্লার নদ-নদী হাওরের পানি। পানি বৃদ্ধির কারণে উপজেলার চার ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি নতুন পাড়া, স্কুল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, উজানের ঢলের পানি ভাটিতে নেমে যাওয়ায় হাওর পাড়ের উপজেলাগুলোতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরো যদি বৃষ্টি হয় তাহলে পানি আরো বাড়বে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
প্রতিনিয়ত যেভাবে পানি বাড়ছে এর ফলে শাল্লার নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে বলে স্থানীয় প্রশাসন মনে করছে। আতঙ্ক উৎকণ্ঠায় সময় কাটাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন গ্রাম। পানির নিচে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন কাঁচা-পাকা সড়ক। এখন পর্যন্ত যেসব গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে সেগুলো হলো- বাহাড়া নায়াপাড়া, যাত্রাপুর, সুখলাইন নায়াহাটি, আনন্দপুর নতুনহাটি, নাছিরপুর, নওয়াগাঁও, বড়গাঁও নতুনহাটি, পুটকা, খলাপাড়া, গোবিন্দপুর, মনুয়া নতুনপাড়া, শান্তিপুর, মুক্তারপুর, আঙ্গারুয়া, হরিনগরসহ বহু গ্রাম। এসব গ্রামের মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন। এনিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল মুক্তাদির হোসেন জানান, ইতিমধ্যেই শাল্লার চারটি ইউনিয়নে চার জন অফিসারের মাধ্যমে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। আবার যেসব গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে, সেখানকার লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্র ( উঁচু স্কুলে) আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, শাল্লা উপজেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানান। গতকাল সরজমিন বন্যা পরিস্থিতি দেখতে সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা শাল্লায় অবস্থান করছেন।
ভরা যৌবনে তিস্তা
কাউনিয়া, রংপুর প্রতিনিধি: তিস্তা নদী যেন তার ভরা যৌবন ফিরে পেয়েছে। জেলেরা সারি সারি হয়ে দাঁড়িয়ে জাল দিয়ে মাছ ধরছে। অনেক জেলে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে নদীর মাঝখানে জাল ফেলে ধরছে মাছ। এমন দৃশ্য দেখে যে কারো মনে হবে জেলেদের এখন ভরা মৌসুম। আর তিস্তা নদীর পানি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসেছেন কিছুটা সময় প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। এমন দৃশ্য চলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। নিজপাড়া এলাকার মনোরঞ্জন চন্দ্র বলেন, আমাদের বাপ দাদার পেশা ছিল মাছ ধরা। এই তিস্তা নদীতে সারা বছর মাছ ধরে আমাদের সংসার চলতো। এখন বছরের বেশি অর্ধেক সময় নদীতে পানি থাকে না, তাই সেভাবে এখন মাছ ধরা হয় না।
বিন্দু চন্দ্র বলেন, এখন তিস্তা নদী দেখে মনে পড়ে সেই আগের দিনের কথা। যখন আমরা সারা বছর নদীতে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি। নদী যদি সারা বছর ভরপুর থাকতো তাহলে এই এলাকার অনেক পরিবার মাছ ধরে তাদের সংসার চালাতে পারতো।
ওসমানীনগরের ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি
ওসমানীনগর (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার সাদীপুর, পশ্চিম পৈলনপুর, বুরুঙ্গা, উমরপুর ও উছমানপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা এবং গোয়ালাবাজার, তাজপুর ও দয়ামীর ইউনিয়নের কিছু এলাকার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ। অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে গিয়ে ডাইকের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ওসমানীনগরের সাদীপুর ইউপির শেষ ও নবীগঞ্জের প্রবেশদ্বার ইসলামপুরে ডাইকের ৩০/৪০ ফুট ভেঙে যাওয়ায় এলাকাগুলো বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় সার্বক্ষণিক মনিটরিং রাখতে ওসমানীনগর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইউএনওর কার্যালয়ে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে সিলেটের ওসমানীনগরে বন্যা কবলিত এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পানিবাহিত চর্মরোগ, সর্দি-কাশি ও ভাইরাস জাতীয় জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এসব রোগে শিশু ও বৃদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ আক্রান্ত হয়েছেন। রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিন চিকিৎসকের চেম্বারে চিকিৎসা নিতে রোগীরা ভিড় করছেন। ওসমানীনগর উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, উপজেলার বন্যাকবলিত সাদীপুর ইউপিসহ অন্য ইউপিগুলোর বেশির ভাগ গভীর নলকূপ ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব দেখা দিয়েছে। ওসমানীনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকার ব্যাপারে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। আমার কার্যালয়ে কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। বিষয়টি সার্বক্ষণিক মনিটর করছি। মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। বন্যার্তদের মধ্যে এাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সাঘাটায় ৪৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ
সাঘাটা (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পানি ঢুকে পড়েছে। নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলসহ বন্যাকবলিত গ্রামগুলোর ৪৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
গত শনিবার থেকে যমুনার পানি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। উপজেলার ৪ ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সরজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পূর্বাংশে ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শনিবার থেকেই বন্যার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তায় পানি উঠতে শুরু করে। স্কুলগুলোতে পানি ওঠায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া-আসার পরিবেশ নেই। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের গোবিন্দপুর, বেড়া, গাড়ামারা, দীঘলকান্দি, পাতিলবাড়ি, গুয়াবাড়ি, কালুরপাড়া, কানাইপাড়া, কুমারপাড়া, জুমারবাড়ি ইউনিয়নের কাঠুর, থৈকরের পাড়া, পূর্ব-আমদিরপাড়া, ঘুড়িদহ ইউনিয়নের চিনিরপটল, খামার পবনতাইড়, সাঘাটা ইউনিয়নের হাটবাড়ি, গোবিন্দী, বাঁশহাটা, দক্ষিণ সাথালিয়া, হাসিলকান্দি, ভরতখালী ইউনিয়নের বরমতাইড় ও ভাঙামোড়সহ বন্যাকবলিত গ্রামগুলোর ৩৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ২টি মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
দিঘলকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম জানান, বিদ্যালয়ের মাঠ ও শ্রেণিকক্ষে পানি ওঠায় ক্লাস নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আজিজুর রহমান জানান, পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিদ্যালয় ভবনগুলোতে পাঠদানের পরিবেশ নেই। বন্যাকবলিত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গত রোববার থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান জানান, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১০৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ।
কুড়িগ্রামে ত্রাণ বিতরণ
স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে: কুড়িগ্রামে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে বানভাসিদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করলেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার। সোমবার ভোরে সদর উপজেলার মোগলবাসা ইউনিয়নের কিশামত মালভাঙ্গা, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের শেখ পালানু আশ্রয়ণ কেন্দ্র এবং চিলমারী উপজেলার চর সাকাহাতি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে ২ হাজার পরিবারকে ১৫ কেজি করে চাল বিতরণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিলুফা ইয়াছমীন, কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাব সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু প্রমুখ। সচিব গতকাল (রোববার) বিকালে কুড়িগ্রাম সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় অংশ নেন। এরপর সন্ধ্যায় তিনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে দুর্যোগ বিষয়ে মতবিনময় করেন। সোমবার ত্রাণ বিতরণ শেষে স্পিড বোটযোগে গাইবান্ধায় জেলার উদ্দেশে রওনা দেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার।
পাকুন্দিয়ায় কয়েক হাজার
মানুষ পানিবন্দি, দুর্ভোগ
পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে পাকুন্দিয়া পৌর এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা, অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি নির্মাণ ও পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে ফেলায় এ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে বাড়িঘর, স্কুল-কলেজের মাঠ, ফসলি জমি, আমন ধানের বীজতলা, পানের বরজ ও ফিশারিসহ বিভিন্ন রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। এতে এলাকাবাসীর দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়াও কৃষকের প্রায় পাঁচ শতাধিক বিঘা ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানায়, ২০০৭ সালে পাকুন্দিয়া পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালে প্রথম নির্বাচনে অ্যাডভোকেট মো. জালাল উদ্দিন পৌরমেয়র নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের নির্বাচনে বর্তমান মেয়র মো. আক্তারুজ্জামান খোকন নির্বাচিত হন। পৌরসভা প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডসহ পুরো এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের মাঠ ও রাস্তাঘাটে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ায় হাঁটুপানি পেরিয়ে চলাচল করতে হয়। এ ছাড়াও পাঁচ শতাধিক বিঘা ফসলি জমি, পানের বরজ ও ফিশারিসহ বিভিন্ন ফসল তলিয়ে কৃষকের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
পৌর এলাকার চরপাকুন্দিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী রাজন সরকার বলেন, গত কয়েকদিন ধরে হাঁটু পানি ভেঙে বাসায় আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা, অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের পথ ও সরকারি খাল দখল করে ভরাট করায় এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে মেয়রের কাছে একাধিকবার দাবি জানালেও এখনো তিনি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
এ ব্যাপারে পৌর মেয়র মো. আক্তারুজ্জামান খোকনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় জমি ভরাট করে বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করায় নির্বিঘ্নে পানি চলাচল করতে পারছে না। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এই জলাবদ্ধতা নিরসনে কিছু কিছু এলাকায় ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য এলাকায়ও ড্রেন নির্মাণ করা হবে।
গাইবান্ধায় ৪ পয়েন্টে বাঁধে ধস
উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধায় প্রতিদিন তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ঘাঘটসহ সব নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সদরসহ ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জের চরসহ অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ।
প্রবল পানির চাপে সকালে ব্রহ্মপুত্র নদের গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কাতলামাড়ি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ৩শ’ ফুট ও একই এলাকায় অন্য একটি পয়েন্টে ৫০ ফুট ধসে প্রায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে দুর্গত এলাকার মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণে বাঁধ ধসের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। অন্যদিকে গাইবান্ধা শহর সংলগ্ন ঘাঘট নদীর তিনটি পয়েন্টে বাঁধ ধসে অন্তত ২৯ ঘরবাড়ি পানিতে ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শতাধিক বাড়িঘর। প্লাবিত হয়েছে আরো অন্তত ৪ ইউনিয়নের ৪০টি গ্রাম।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে দুর্গতদের জন্য ৮৫টি ফ্লাড শেল্টার খোলা হয়েছে। আবার অনেক এলাকায় দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। গাইবান্ধার বাগুড়িয়ায় বাঁধ ভেঙে হঠাৎ পানি প্রবেশ করায় তলিয়ে গেছে নতুন নতুন এলাকা। এদিকে, ফুলছড়ির কাতলামারীতে যমুনা নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ২ শতাধিক ঘরবাড়ি। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার। অনেকেই গবাদি পশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি
বিপদসীমার উপরে
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির কারণে সিরাজগঞ্জের হার্ট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ সেন্টিমিটার বেড়ে বর্তমানে বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে, যমুনা নদীর পানি কাজিপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম পানি বৃদ্ধির তথ্য জানিয়ে বলেন, আগামী ২-৩ দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে এনায়েতপুরের ব্রাহ্মণগাতী, আড়কান্দি, হাটপাচিল ও কাজিপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া, বাঐখোলা পাটাগ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার বেশকিছু বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের মানুষ। বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুরের মাছ। অনেকে বাড়িঘর নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে বাঁধের পাশে আশ্রয় নিচ্ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে চরাঞ্চলে ফসলি জমিগুলো পানিতে ডুবে যাচ্ছে। অপরদিকে, জেলা প্রশাসন বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে।
নাটুয়ারপাড়া রক্ষা বাঁধে ধস
কাজিপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কাজিপুর পয়েন্টে যমুনা বিপদসীমার ৩৪ সে.মি উপর দিয়ে বইছে। এতে করে উপজেলার নতুন নতুন এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান। আর প্রবল স্রোতে উপজেলার নাটুয়ারপাড়া এলাকা রক্ষা বাঁধের মাথায় দেখা দিয়েছে ধস। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ওই বাঁধের প্রায় ৩শ’ মিটার ধসে গেছে। পানির প্রচণ্ড ঘূর্ণাবর্তের কারণে ধসে গেছে নাটুয়ারপাড়া থেকে খাসরাজবাড়ি ইউনিয়ন যাওয়ার প্রধান রাস্তাটি। এ ছাড়া রূপসা থেকে বালিয়াকান্দি পর্যন্ত রাস্তার একাংশ ধসে গেছে। চরপানাগাড়ি থেকে জজিরা যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটিও গতকাল ভোরে ধসে গেছে। এতে নাটুয়ারপাড়া হাট-বাজারের ৪ শতাধিক ব্যবসায়ীসহ ভাঙন এলাকার জনগণ চরম আতঙ্কে রয়েছে। অনেকে বাঁধের আশেপাশের এলাকায় আশ্রয় নিচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ব্যবসায়ী দেলশাদ সরকার জানান, রোববার দুপুরে প্রবল স্রোতের আঘাতে নাটুয়ারপাড়া হাট-বাজারের পূর্ব পাশের বাঁধের মাথায় ধস দেখা দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় ২শ’ মিটার বাঁধ যমুনার নিচের দিকে দেবে যায়। বিকালে ওই বাঁধের ভাঙন দেখতে যান কাজীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সিরাজী ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার একেএম শাহা আলম মোল্লা।
শাল্লায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
শাল্লা (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জ সদরসহ উজানের পানি কমলেও অবিরাম বৃষ্টির কারণে প্লাবিত হচ্ছে ভাটির উপজেলা শাল্লা। প্রতিদিনের ন্যায় গতকাল সকাল থেকে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে উজানের পানিও নামছে ফলে নতুন নতুন গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করছে। বাড়তে শুরু করেছে শাল্লার নদ-নদী হাওরের পানি। পানি বৃদ্ধির কারণে উপজেলার চার ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি নতুন পাড়া, স্কুল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, উজানের ঢলের পানি ভাটিতে নেমে যাওয়ায় হাওর পাড়ের উপজেলাগুলোতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরো যদি বৃষ্টি হয় তাহলে পানি আরো বাড়বে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
প্রতিনিয়ত যেভাবে পানি বাড়ছে এর ফলে শাল্লার নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে বলে স্থানীয় প্রশাসন মনে করছে। আতঙ্ক উৎকণ্ঠায় সময় কাটাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন গ্রাম। পানির নিচে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন কাঁচা-পাকা সড়ক। এখন পর্যন্ত যেসব গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে সেগুলো হলো- বাহাড়া নায়াপাড়া, যাত্রাপুর, সুখলাইন নায়াহাটি, আনন্দপুর নতুনহাটি, নাছিরপুর, নওয়াগাঁও, বড়গাঁও নতুনহাটি, পুটকা, খলাপাড়া, গোবিন্দপুর, মনুয়া নতুনপাড়া, শান্তিপুর, মুক্তারপুর, আঙ্গারুয়া, হরিনগরসহ বহু গ্রাম। এসব গ্রামের মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন। এনিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল মুক্তাদির হোসেন জানান, ইতিমধ্যেই শাল্লার চারটি ইউনিয়নে চার জন অফিসারের মাধ্যমে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। আবার যেসব গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে, সেখানকার লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্র ( উঁচু স্কুলে) আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, শাল্লা উপজেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানান। গতকাল সরজমিন বন্যা পরিস্থিতি দেখতে সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা শাল্লায় অবস্থান করছেন।
ভরা যৌবনে তিস্তা
কাউনিয়া, রংপুর প্রতিনিধি: তিস্তা নদী যেন তার ভরা যৌবন ফিরে পেয়েছে। জেলেরা সারি সারি হয়ে দাঁড়িয়ে জাল দিয়ে মাছ ধরছে। অনেক জেলে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে নদীর মাঝখানে জাল ফেলে ধরছে মাছ। এমন দৃশ্য দেখে যে কারো মনে হবে জেলেদের এখন ভরা মৌসুম। আর তিস্তা নদীর পানি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসেছেন কিছুটা সময় প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। এমন দৃশ্য চলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। নিজপাড়া এলাকার মনোরঞ্জন চন্দ্র বলেন, আমাদের বাপ দাদার পেশা ছিল মাছ ধরা। এই তিস্তা নদীতে সারা বছর মাছ ধরে আমাদের সংসার চলতো। এখন বছরের বেশি অর্ধেক সময় নদীতে পানি থাকে না, তাই সেভাবে এখন মাছ ধরা হয় না।
বিন্দু চন্দ্র বলেন, এখন তিস্তা নদী দেখে মনে পড়ে সেই আগের দিনের কথা। যখন আমরা সারা বছর নদীতে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি। নদী যদি সারা বছর ভরপুর থাকতো তাহলে এই এলাকার অনেক পরিবার মাছ ধরে তাদের সংসার চালাতে পারতো।
ওসমানীনগরের ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি
ওসমানীনগর (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার সাদীপুর, পশ্চিম পৈলনপুর, বুরুঙ্গা, উমরপুর ও উছমানপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা এবং গোয়ালাবাজার, তাজপুর ও দয়ামীর ইউনিয়নের কিছু এলাকার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ। অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে গিয়ে ডাইকের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ওসমানীনগরের সাদীপুর ইউপির শেষ ও নবীগঞ্জের প্রবেশদ্বার ইসলামপুরে ডাইকের ৩০/৪০ ফুট ভেঙে যাওয়ায় এলাকাগুলো বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় সার্বক্ষণিক মনিটরিং রাখতে ওসমানীনগর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইউএনওর কার্যালয়ে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে সিলেটের ওসমানীনগরে বন্যা কবলিত এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পানিবাহিত চর্মরোগ, সর্দি-কাশি ও ভাইরাস জাতীয় জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এসব রোগে শিশু ও বৃদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ আক্রান্ত হয়েছেন। রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিন চিকিৎসকের চেম্বারে চিকিৎসা নিতে রোগীরা ভিড় করছেন। ওসমানীনগর উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, উপজেলার বন্যাকবলিত সাদীপুর ইউপিসহ অন্য ইউপিগুলোর বেশির ভাগ গভীর নলকূপ ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব দেখা দিয়েছে। ওসমানীনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকার ব্যাপারে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। আমার কার্যালয়ে কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। বিষয়টি সার্বক্ষণিক মনিটর করছি। মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। বন্যার্তদের মধ্যে এাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সাঘাটায় ৪৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ
সাঘাটা (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পানি ঢুকে পড়েছে। নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলসহ বন্যাকবলিত গ্রামগুলোর ৪৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
গত শনিবার থেকে যমুনার পানি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। উপজেলার ৪ ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সরজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পূর্বাংশে ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শনিবার থেকেই বন্যার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তায় পানি উঠতে শুরু করে। স্কুলগুলোতে পানি ওঠায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া-আসার পরিবেশ নেই। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের গোবিন্দপুর, বেড়া, গাড়ামারা, দীঘলকান্দি, পাতিলবাড়ি, গুয়াবাড়ি, কালুরপাড়া, কানাইপাড়া, কুমারপাড়া, জুমারবাড়ি ইউনিয়নের কাঠুর, থৈকরের পাড়া, পূর্ব-আমদিরপাড়া, ঘুড়িদহ ইউনিয়নের চিনিরপটল, খামার পবনতাইড়, সাঘাটা ইউনিয়নের হাটবাড়ি, গোবিন্দী, বাঁশহাটা, দক্ষিণ সাথালিয়া, হাসিলকান্দি, ভরতখালী ইউনিয়নের বরমতাইড় ও ভাঙামোড়সহ বন্যাকবলিত গ্রামগুলোর ৩৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ২টি মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
দিঘলকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম জানান, বিদ্যালয়ের মাঠ ও শ্রেণিকক্ষে পানি ওঠায় ক্লাস নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আজিজুর রহমান জানান, পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিদ্যালয় ভবনগুলোতে পাঠদানের পরিবেশ নেই। বন্যাকবলিত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গত রোববার থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান জানান, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১০৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ।
কুড়িগ্রামে ত্রাণ বিতরণ
স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে: কুড়িগ্রামে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে বানভাসিদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করলেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার। সোমবার ভোরে সদর উপজেলার মোগলবাসা ইউনিয়নের কিশামত মালভাঙ্গা, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের শেখ পালানু আশ্রয়ণ কেন্দ্র এবং চিলমারী উপজেলার চর সাকাহাতি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে ২ হাজার পরিবারকে ১৫ কেজি করে চাল বিতরণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিলুফা ইয়াছমীন, কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাব সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু প্রমুখ। সচিব গতকাল (রোববার) বিকালে কুড়িগ্রাম সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় অংশ নেন। এরপর সন্ধ্যায় তিনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে দুর্যোগ বিষয়ে মতবিনময় করেন। সোমবার ত্রাণ বিতরণ শেষে স্পিড বোটযোগে গাইবান্ধায় জেলার উদ্দেশে রওনা দেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার।