দেশ বিদেশ

চিকিৎসক আন্দোলনে সংকটে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবা

পরিতোষ পাল, কলকাতা থেকে

১৫ জুন ২০১৯, শনিবার, ৯:১৪ পূর্বাহ্ন

পশ্চিমবঙ্গে নিরাপত্তার দাবিতে জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের ফলে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা সংকটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। চিকিৎসকদের আন্দোলনে গতি দিয়ে রাজ্যের কয়েকশ’ চিকিৎসক গণইস্তফা দিয়েছেন। এই তালিকায় রয়েছেন বেশ কয়েকটি হাসপাতালের অধ্যক্ষ ও সুপাররাও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হবার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গোটা বিষয়টিকে মানবিক দিকে থেকে বিচার করে চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এই সমস্যার সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসবে। সেইসঙ্গে তিনি চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলেছেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় জানা গেছে, সমাধান খুঁজতে রাজ্যের বরিষ্ঠ চিকিৎসকদের নবান্নে ডেকে পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিশিষ্ট চিকিৎসকদের মধ্যে রয়েছেন, সুকুমার মুখোপাধ্যায়, এমএল সাহা, অলকেন্দু ঘোষ, অভিজিৎ চৌধুরীর মতো চিকিৎসকরা।
এনআরএস-এ জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে শুক্রবার চতুর্থদিনেও রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পূর্ণ অচল ছিল। আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে ১৭ই জুন সোমবার ভারতের সব হাসপাতালে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (আইএমএ)। চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ সংগঠনের তরফে জানানো হয়েছে, জরুরি ও রুটিন পরিষেবা চালু থাকবে। তবে আউটডোর এবং অন্যান্য পরিষেবা বন্ধ থাকবে। গোটা ভারতের চিকিৎসকরা সংহতি জানিয়ে শুক্রবার কর্মবিরতি পালন করেছেন। দিল্লি, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ সহ বিভিন্ন রাজ্যের কয়েক হাজার চিকিৎসক ধর্মঘটে যোগ দিয়েছেন। গত সোমবারই শিয়ালদহের নীল রতন সরকার মেডিকেল কলেজে একজন বৃদ্ধ রোগীর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে একদল দুষ্কৃতকারীর হাতে নিগৃহীত হয়েছেন কতর্ব্যরত জুনিয়র চিকিৎসকরা। দু’জন চিকিৎসক গুরুতর আহত হয়েছেন। একজনের খুলির হাড় ভেঙে মাখায় ভিতরে ঢুকে গেছে। এরপর থেকেই উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর দাবিতে জুনিয়র চিকিৎসকরা ধরনায় বসেছেন। দাবি পূরণ না হলে আন্দোলনকারীরা ধরনা আন্দোলন প্রত্যাহার করবেন না বলে জানিয়েছেন্। এরফলে গত তিনদিনের মতো শুক্রবার চতুর্থদিনেও রাজ্যের সব মেডিকেল কলেজের স্বাস্থ্য পরিষেবা অচল ছিল। এর ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগী ও তাদের পরিজন হয়রানির মুখে পড়েছেন। এমনকি বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীরাও অসহায় অবস্থায় সময় কাটাচ্ছেন।  রাজ্য সরকার হুমকির মুখে আন্দোলনের মোকাবিলার পথ নেয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। শুক্রবার এনআরএস-এ চিকিৎসকদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে চিত্রপরিচালক অপর্ণা সেনসহ রাজ্যে বেশ কয়েকজন শিল্পী ও সমাজকর্মী মুখ্যমন্ত্রীকে আন্দোলনকারীদের কাছে গিয়ে কথা বলার আবেদন জানিয়েছেন। ইতিমধ্যেই রাজ্যজুড়ে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের গণইস্তফা শুরু হয়েছে। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ (এনআরএস) তো বটেই, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ, এসএসকেএম, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের মতো একাধিক হাসপাতালে গণইস্তফা দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত চার জন অধ্যক্ষ এবং ১৭০ জন চিকিৎসক ইস্তফা দিয়েছেন। নজিরবিহীন এই পরিস্থিতিতে গোটা রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গোটা পরিস্থিতির জন্য রাজ্য প্রশাসন এবং মুখ্যমন্ত্রীকেই দায়ী করেছেন  চিকিৎসক মহল। সরাসরি না বললেও ইস্তফার কারণ হিসেবে প্রশাসনিক অসহযোগিতাকেই কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন চিকিৎসকরা। আন্দোলনরত চিকিৎসকদের অভিযোগ, বারে বারে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। গত দুই বছরে ২৩৪টি চিকিৎসকদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসনিক স্তরে কোনও ব্যবস্থাই নেয়া হয় নি। শুক্রবারও কলকাতার ন্যাশানাল মেডিকেল কলেজে বহিরাগতরা চিকিৎসকদের আক্রমণ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এদিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মুখোমুখি আলোচনায় না বসার তীব্র সমালোচনা করেছেন রাজ্যের সর্বস্তরের মানুষ। বরং বৃহস্পতিবার  মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কটু মন্তব্য করার পাশাপাশি কঠোর ব্যবস্থার নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়ার পরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। আন্দোলনকারীরা আরও কঠোর অবস্থান নিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী নিঃশর্ত ক্ষমা না চাইলে তারা আন্দোলন তুলবেন না। তাদের আরও অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী নিজে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কোনও কথা বলেননি। এমনকি গুরুতর আহত জুনিয়র চিকিৎসককে দেখতে হাসপাতালেও মুখ্যমন্ত্রী যাননি বলেও আন্দোলনকারীরা প্রবল ক্ষুব্ধ। তবে রাজ্যের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী এদিন হাসপাতালে গিয়ে আহত জুনিয়র চিকিৎসক পরিবহ মুখোপাধ্যায়কে দেখে এসেছেন বলে জানা গেছে। এদিকে দ্বিতীয় দিন থেকেই  আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজ্যের  চিকিৎসক মহল। এমনকি নার্সরাও আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছেন। সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন হাসপাতালে আসা রোগীর পরিজনরাও। এসএসকেএম, বর্ধমান মেডিক্যালের মতো হাতেগোনা দু’-একটি হাসপাতালে নামমাত্র পরিষেবা চালু করা গেলেও পুরোপুরি অচল নীলরতন সরকার (এনআরএস) মেডিক্যাল কলেজ। কার্যত ফুঁসছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মী-আধিকারিকরা। এদিনও আন্দোলনকারীরা বলেছেন,  তাঁরা পরিষেবা দিতে প্রস্তুত। কর্মক্ষেত্রেই রয়েছেন। রাজ্য সরকার তাঁদের দাবিদাওয়া পূরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা ফের কাজে যোগ দেবেন। সেইসঙ্গে আন্দোলনকারীরা মুখ্যমন্ত্রীর নিঃশর্ত ক্ষমা দাবি করেছেন। শুক্রবার চিত্র পরিচালক অপর্ণা সেন মুখ্যমন্ত্রীকে এনআরএস হাসপাতালে এসে আলোচনার অনুরোধ করেছেন। আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী বয়সে অনেকটাই বড় এই আন্দোলনকারীদের  তুলনায়। তাঁকে নিজের অবস্থান থেকে সরতেই হবে। তিনি অভিভাবকস্থানীয়া। তাই তিনি যদি কোনো কথায় আঘাতও পেয়ে থাকেন, তাঁকে এসে কথা বলতে হবে ছোটদের সঙ্গে। বুঝতে হবে, এদের মনেও তাঁর প্রতি অভিমান হয়েছে। সেইসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, ডাক্তারদের কোনো নিরাপত্তা নেই। সিসিটিভি পর্যন্ত নেই। তাই এই পরিবেশে কাজ করাটা বেশ সমস্যার। এনআরএস’র আন্দেলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন অভিনেতা, নাট্যপরিচালক কৌশিক সেন, সমাজকর্মী, মীরাতুন নাহার, বোলান গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্টরা। কৌশিক সেন এদিন বলেছেন, আন্দোলনকারীদের পাশে সবার আগে এসে দাঁড়ানো উচিত ছিল মুখ্যমন্ত্রীরই। কারণ তিনি বিশেষ কোনো দলের মুখ্যমন্ত্রী নন। রাজ্যের প্রতিটি মানুষের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। কৌশিক একইসঙ্গে বলেছেন, চিকিৎসার মতো পরিষেবার জন্য প্রয়োজনে আরো বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে হবে স্বাস্থ্য দপ্তরকে, প্রশাসনকে। প্রয়োজনে ক্লাবগুলোকে লাখ লাখ রুপি দেয়া বন্ধ করতে হবে। শিল্পীদের ক্ষেত্রেও টাকা বন্ধ করে বরং সেই টাকা সাধারণ মানুষের চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হোক।


   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status