শিক্ষাঙ্গন

সমন্বয়হীনতায় ‘ব্যর্থ’ জাবির ভিসিবিরোধী আন্দোলন

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন, জাবি থেকে

১৫ জুন ২০১৯, শনিবার, ৮:১৯ পূর্বাহ্ন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের একাংশ, বিএনপি ও বামদের তিনদলীয়  জোটের আন্দোলনে ভিসি পতন হলেও এবারে সেই সমীকরণ টিকেনি। ভিসিবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে আন্দোলনরত আওয়ামী অংশ এবারও বিএনপি ও বামপন্থিদের নিয়ে জোট করে। কিন্তু এই জোটকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘নালিশ’ করেন ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। ফলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিভিন্ন পদক্ষেপে বর্তমানে ভিসির আসন আরও পাকাপোক্ত হয়েছে।
ফলে গতবছরের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ভিসিবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থতায় রূপ নেয়। সেই সঙ্গে শেষ হয় সকাল-দুপুর পরস্পরবিরোধী সংবাদ সম্মেলন, লিফলেটে বিষোদগার, সাধারণ শিক্ষকদের নিয়ে টানাটানি। এই আন্দোলনে শিক্ষকরা বেশ কয়েকবার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচিও দেন। তাছাড়া শিক্ষকদের বিবদমান রাজনীতির কারণে ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। চলে পরস্পরকে হুমকি প্রদান, রেকর্ড ফাঁস বিতর্ক ও তদন্ত কমিটি গঠন ‘রাজনীতি’। আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভিন্ন সমন্বয়হীনতা ও একক ব্যক্তির নির্দেশনা আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে দাবি বিশ্লেষকদের। আন্দোলন সফল হলে কে পরবর্তী ভিসি হবেন এই প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারাও ব্যর্থতার আরেকটি কারণ। তাছাড়া ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম আন্দোলনরত শিক্ষকদের ক্রমশ প্রশাসন থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন। অন্যদিকে বিরোধী জোটের অন্যতম দুইজন নেতা প্রশাসনিক দায়িত্বে থেকে সকল সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন। প্রশাসনিক পদে পরিবর্তনের প্রতিবাদে ডাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে হাতাহাতিতেও জড়িয়ে পড়ে বিবাদমান দু’পক্ষ।
ভিসিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া এক শিক্ষক নেতা জানান, ‘আন্দোলন লক্ষ্যহীন ছিল। নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্রহীনতা, সমন্বয়হীনতা, অন্তর্কোন্দল ও সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল। ২৮শে জুন সিনেট অধিবেশন আটকানোর পর ভিসি ৪৫ দিনের মধ্যে সিনেট নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা সেই গতি ধরে রাখতে পারিনি। একটা বৃহৎ লক্ষ্য থেকে হঠাৎ করে আইন অনুষদের ডিন নিয়োগের মতো ক্ষুদ্র বিষয়ে চলে গেলাম। ফলে কর্মসূচিতে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ ৭০-৮০ থেকে ২০-২৫ নেমে গেল। তাছাড়া একদিকে রিট করে অন্যদিকে আন্দোলন করার যৌক্তিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।’ ২৩শে  সেপ্টেম্বর হঠাৎ করে ভিসির পদত্যাগ দাবি নিয়েও দলের মধ্যে মতানৈক্য ছিল বলে দাবি তাঁর। আওয়ামী লীগের বিভক্ত অংশের নেতা অধ্যাপক খবির উদ্দীন সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য থেকে বিভিন্ন সময় সরে গেছিলাম। আর আমরা তো রক্তে মাংসে আওয়ামী লীগ। বর্তমান ভিসি ১৯৭৩ এর এ্যাক্ট বারবার লঙ্ঘন করলেও তিনি তো আওয়ামী লীগের মনোনীত ভিসি। তাই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে অনেকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিলেন।’  তবে এখনো বিরোধী জোটে থাকা আওয়ামী লীগের একাধিক শিক্ষক দাবি করেন আওয়ামী লীগ এক হোক সেটা তারাও চেয়েছেন। কিন্তু এক হতে অযথা একটা তাড়াহুড়া ছিল। ইচ্ছে করেই তাদের ছাড়া তারা একটা পক্ষ এক হয়েছে। এর সত্যতা ভিসিজোটের একাধিক শিক্ষক স্বীকার করে বলেন এক হওয়ার প্রক্রিয়ার মাঝেই বিরোধীদের একটি ‘অবৈধ’ কমিটি করা কারো পছন্দ হয়নি। তাই আমরা আর তাদের ডাকতে আগ্রহীও ছিলাম না। যোগ দেওয়া একজন শিক্ষক নেতা বলেন,  প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ফোনের প্রেক্ষিতে ২৮শে মার্চ সকাল ১১টায় রসায়ন বিভাগে আমরা বসি। তখন দলের সিনিয়ররা সমঝোতা নিয়ে ইতিবাচক ছিলেন। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার আবার বসলে সে বৈঠকে একজন সাবেক ভিসি ও একজন প্রো-ভিসি সমঝোতাকে দল ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ’
এদিকে আন্দোলনের ব্যর্থতা ও ফের নতুন সমীকরণে সবকটি শিক্ষক সংগঠন দল পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয়তাবাদী শিক্ষক  ফোরাম, ভিসিপন্থি বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পর্ষদ, ভিসিবিরোধী আওয়ামী অংশের প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ, তিনদলের মোর্চা সম্মিলিত শিক্ষক সমাজের কমিটি দ্রুত পুর্নগঠন করা হবে বলে জানান নেতারা। তবে কোন্দলের শঙ্কায় ভিসিপন্থিরা প্রশাসনিক পদ ভাগাভাগির পর নতুন কমিটি করতে আগ্রহী।
আনোয়ার বিরোধী আন্দোলনের নেতা বিএনপিপন্থি অধ্যাপক মো. কামরুল আহসান বলেন, ‘যখনই জাহাঙ্গীরনগরের স্বার্থবিরোধী কাজ হয় তখনই স্বভাব অনুযায়ী একটি রাজনৈতিক মোর্চা তৈরি হয়। একই প্রেক্ষিতে সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ গঠিত হয়েছিল। আমি মনে করি সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ টিকবে এবং আন্দোলনও চলবে।’
এদিকে জাহাঙ্গীরনগরে আওয়ামী লীগের শিক্ষক সংগঠন ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই দুই ধারায় বিভক্ত। দলীয় রাজনীতির বাইরে এখানে সিন্ডিকেট রাজনীতিই অগ্রসর ছিল দীর্ঘদিন। এদিকে ২০২২ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সিনিয়র অধ্যাপক অবসরে যাবেন। এরপরে দলের নেতৃত্ব চলে আসবে অপেক্ষাকৃত তরুণদের কাছে। তখন রাজনীতির একটা গুণগত পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা। তবে আওয়ামী লীগের মধ্যে সক্রিয় ‘ধামরাই-মানিকগঞ্জ’ সিন্ডিকেটের হাতেই থাকছে আগামীর শিক্ষক রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status