দেশ বিদেশ
মধ্যরাতে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতদের ওপর ফের হামলা
বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার
২০ মে ২০১৯, সোমবার, ১০:১১ পূর্বাহ্ন
ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর নেতৃত্বে পদবঞ্চিতদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। এতে সংগঠনটির নারী নেত্রীসহ অন্তত ১৫ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। শনিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) এ ঘটনা ঘটে। অবশ্য গোলাম রাব্বানী দাবি করেছেন, পদপ্রাপ্ত ও পদবঞ্চিতদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তিনি আর সংগঠনের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন শুধু তাদের সরিয়ে দিয়েছেন। এদিকে নারী নেত্রীসহ পদবঞ্চিতদের ওপর আবারো হামলার প্রতিবাদ ও হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে টিএসসির সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যের সামনে অনশন কর্মসূচি শুরু করেছে পদবঞ্চিতরা। যদিও পরক্ষণে তারা সেটিকে অবস্থান ধর্মঘট বলে দাবি করেছেন। পদবঞ্চিতরা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ছাত্রলীগের সাবেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন বলেন, আমরা একমাত্র নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী) দিকে তাকিয়ে। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা তা মেনে নেবো। তিনি বলেন, গতরাতে আমাদের ওপর যে হামলা হয়েছে আমরা তার বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে পদবঞ্চিত এ নেতা খোলা চিঠিও লিখেছেন। এদিকে গত সোমবার কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে পদধারীদের হামলায় আহত রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশাকে অপহরণের চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় তিনি শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
গত শনিবার বিতর্কিত নেতাদের ব্যাপারে সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে এসে পদপ্রাপ্তদের হামলার শিকার হয়েছেন পদবঞ্চিতরা। এতে পদবঞ্চিতদের মধ্যে নারী নেত্রীসহ ১৫ জনের মতো আহত হয়েছেন। আহতদের অভিযোগ, হামলার সময় সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বনী স্বয়ং তাদের এক নারী নেত্রীকে মারধর করেন। এ ঘটনার প্রতিবাদ, হামলাকারীদের বিচার ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবিতে রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছে ভুক্তভোগী পদবঞ্চিত নেতারা। তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। অনেকেই নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগেরও ঘোষণা দেন। সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া বিতর্কিতদের একটি তালিকা নিয়ে রাত ১২টার দিকে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) আসেন পদবঞ্চিতদের ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল। তারা ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পদবঞ্চিতদের সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি বিএম লিপি আক্তারকে প্রশ্ন করেন তুই আমার বিরুদ্ধে মাদক নেয়ার বিষয়ে চ্যানেলগুলোতে কথা বলেছিস কেন? লিপি আক্তার পাল্টা বলেন, আপনারাতো সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বিষয়ে খারাপ কথা বলেছেন। এটা আপনাদের কাছ থেকে শিখেছি। পরে গোলাম রাব্বানী লিপিকে বেয়াদব বলে গালি দেন। গোলাম রাব্বানীর এমন মন্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানালে লিপি আক্তারের সঙ্গে তার তর্ক বেধে যায়। একপর্যায়ে গোলাম রাব্বানী নিজেই লিপি আক্তারের গায়ে হাত তোলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে রাব্বানীর অনুসারীরাও লিপিসহ তার সঙ্গী ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের সভাপতি ফরিদা পারভীন ও সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের গত কমিটির সহ-সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহসহ অন্যদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় টিএসসির ভেতরে তাদের ওপর দুই দফায় হামলা করা হয়। হামলায় পদবঞ্চিতদের প্রায় ১৫ জনের মতো আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন তারা। এর মধ্যে রয়েছেন- নতুন কমিটির সংস্কৃৃতি বিষয়ক উপ-সম্পাদক নিপু ইসলাম তন্বী, তিলোত্তমা শিকদার, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদা পারভীন ও সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা, কবি সুফিয়া কামাল হল শাখার সাধারণ সম্পাদক সারজিয়া শারমিন সম্পা, শামসুন নাহার হল শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াসমিন শান্তা, সাবেক কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-সম্পাদক এমদাদ হোসেন সোহাগ, সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক আজমীর শেখ, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক উপ-প্রচার সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহসহ কয়েকজন। এরমধ্যে শেখ আব্দুল্লাহ’র ডান ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায়। অজ্ঞান অবস্থায় তিনি প্রায় আধা ঘণ্টা রাজু ভাস্কর্যে শুয়ে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, টিএসসিতে হামলার পর রাত তিনটার দিকে পদবঞ্চিতরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে অবস্থান নেন। এ সময় তারা সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় তারা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগেরও ঘোষণা দেন। বিতর্কিতদের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ দিতে এসে হামলার শিকার হওয়ায় তারা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ও তার কাছে বিচার চান। পরে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক টিএসসি থেকে বেরিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আসেন। এ সময় পদবঞ্চিতদের বুঝিয়ে অনশন থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু পদবঞ্চিতরা তাদের গ্রহণ করেননি। তারা মারধরের বিচার দাবি করে তাদের চলে যেতে বলেন। এ সময় গোলাম রাব্বানী তাদের উদ্দেশে বলেন, আমি দুঃখিত। তোমরা চলে যাও। আমি কাল নেত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে আসবো। কিন্তু হামলার শিকার নেতাকর্মীরা তাতে রাজি হননি। তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস না পেলে তারা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। এ অবস্থায় সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীসহ তাদের অনুসারীরা উপস্থিত ছিলেন। জানতে চাইলে পদবঞ্চিতদের নেতৃত্বে থাকা গত কমিটির প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু বলেন, আমরা যে ৯৯ জনের নামের তালিকা দিতে সভাপতি-সম্পাদক বরাবর আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী আমাদের বোন ও রোকেয়া হলের সভাপতি বিএম লিপি আক্তারকে মারধর করে। এর পর পরই তার অনুসারীরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। তিনি অভিযোগ করেন, তাদের ডেকে এনে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। তারা এই হামলার বিচার চান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চান। সাবেক সদস্য মো. তানভীর হাসান সৈকত অভিযোগ করে বলেন, আমরা বিতর্কিতদের ব্যাপারে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে গিয়েছিলাম। গতকাল সেখানেও আমরা হামলা ও লাঞ্ছনার শিকার হই। এ সময় তিনি লিপি আক্তারকে মারধর করায় গোলাম রাব্বানীকেও প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেন। নিজের গায়ে হাত তোলার বিষয়ে রোকেয়া হলের সভাপতি বিএম লিপি আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। আমরা ১২ জন লাঞ্ছিত হয়েছি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই। গোলাম রাব্বানী যে তাকে মারধর করেছিল সে বিষয়ে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে সে বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানাবো। অভিযোগের বিষয়ে গোলাম রাব্বানী বলেন, ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী কমিটিকে কেন্দ্র করে ইস্যু তৈরির চেষ্টা করছে। কারও গায়ে হাত তোলা হয়নি। সিন্ডিকেটের নির্দেশে নাটক সাজিয়ে তারা বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করছে।
ছাত্রলীগ নেত্রীকে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ: এদিকে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদবঞ্চিত হয়ে প্রতিবাদের কারণে হামলার শিকার হওয়া রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশাকে অপহরণ চেষ্টার অভিযোগ করেন তিনি। এ ঘটনায় তিনি রাজধানীর শাহবাগ থানায় গতকাল রাতে একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। জিডি নম্বর-১২০১। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করেন, বদরুন্নেছা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এস কে রিমা তাকে ফোন দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিক্ষা উপ-মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল কথা বলতে চান। সন্ধ্যায় রিমা হাতিরপুলের একটি বাসায় শ্রাবণী দিশার কাছে যান। কিন্তু রিমার আচরণ দেখে তিনি বুঝতে পারেন নওফেলের কথা বলে তাকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এ সময় তড়িঘড়ি করে রিমা বেরিয়ে যান। পরে তারা জানতে পারেন মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বর্তমানে চীনে অবস্থান করছেন। পরে এই ঘটনায় শ্রাবণী দিশা শাহবাগ থানায় জিডি করতে যান। এ সময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগের বিষয়ে সেই বদরুন্নেছা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এস কে রিমা বলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নওফেল আমার কাছে ফোন করে শ্রাবণী দিশার নম্বর চান। পরে শ্রাবণী দিশা আমাকে ফোন দিয়ে হাতিরপুলে একটি বাসায় যেতে বলেন। আমি সেখানে যাই। তার সঙ্গে আমার স্বাভাবিক কথাবার্তা হয়। অপহরণের কি হলো এখানে বুঝতেছি না। মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল দেশে অবস্থান করছেন বলেও জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে খোলা চিঠি পদবঞ্চিত নেতার: এদিকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে খোলা চিঠি দিয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন। রাজনীতির মাঠে সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি ঠাঁই পাননি। খোলা চিঠিতে তিনি লেখেন- ‘আপা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি বৃহৎ পরিবার। যে পরিবারের প্রত্যকটি সদস্য একে অন্যের বিপদের সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে, যেকোনো প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অতীতে তাই হয়েছে। না-হলে কতবার যে আমাদের পরাজয় হতো। আমরা আহত ভাইটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাজপথে চিৎকার করেছি, প্রতিবাদ করেছি কিন্তু ফেলে যাইনি। আমরা লাশ কাঁধে নিয়ে মিছিল করেছি তবুও রক্ত চক্ষু ভয় পাইনি। আমার ভাই আমার রক্ত আমার বোন আমার সাহস। কিন্তু আপা পরিতাপের বিষয় আজ সেই পরিবারের সদস্য দুই দলে বিভক্ত। আজ সেই পরিবারের সদস্য একে অন্যের রক্ত ঝরাতে ব্যস্ত। কারো মধ্যে সহমর্মিতার ছোঁয়া নয় বরং প্রতিহিংসার খড়গ। সবার মেলবন্ধনে যে পরিবার গড়ে উঠেছিল সেই পরিবার আজ ধ্বংসের পথে। আজ বোনের রক্ত ভাইয়ের হাতে। আজ ভাই ভাইয়ের শত্রু। এমনটা তো চাইনি, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। আপা আপনি জানেন একটা কমিটি হয়েছে। অনেক ত্যাগী কর্মী সেখানে স্থান পায়নি। যারা স্থান পায়নি তারা প্রতিবাদ করেছে বিদ্রোহ বিক্ষোভ করেছে। কিন্তু তাই বলে তারা বখে যায়নি। তারা প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়েছে তাদের সেখানে মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছে। সে কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য। ঘুমাতে পারি নাই আপা, কয়েক রাত ঘুমাতে পারি নাই। আপা জানেন, পরিশ্রমের সংগঠনে মূল্যহীন ভেসে আসা মানুষের স্থান হয় কিন্তু সংগঠন করা ছেলেটা ব্যক্তি স্বার্থে ছিটকে পড়ে! কিন্তু কেন? আমাদের দাবি তেমন কিছু ছিল না শুধু বিতর্কিতদের সরিয়ে দেয়ার দাবি উঠেছিল। কিন্তু না, উল্টো তাদেরই তার প্রতিদান দিতে হলো। সমগ্র নগরবাসী যখন ঘুমে অচেতন তখন আবারো আমাদের বোনগুলোকে ওরা বেধড়ক মেরেছে। সবার সামনে অপমান লাঞ্ছিত করেছে। আপা কষ্ট হচ্ছে। অনেক কষ্ট হচ্ছে। আপা আপনিই তো আমাদের সব। আপনিই তো আমাদের অভিভাবক, আমাদের পিতা-মাতা। আপনার কাছে আশ্রয় চাওয়া ছাড়া আর কোথায় যাব? কোথায় গেলে বিচার পাবো?’
গত শনিবার বিতর্কিত নেতাদের ব্যাপারে সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে এসে পদপ্রাপ্তদের হামলার শিকার হয়েছেন পদবঞ্চিতরা। এতে পদবঞ্চিতদের মধ্যে নারী নেত্রীসহ ১৫ জনের মতো আহত হয়েছেন। আহতদের অভিযোগ, হামলার সময় সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বনী স্বয়ং তাদের এক নারী নেত্রীকে মারধর করেন। এ ঘটনার প্রতিবাদ, হামলাকারীদের বিচার ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবিতে রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছে ভুক্তভোগী পদবঞ্চিত নেতারা। তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। অনেকেই নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগেরও ঘোষণা দেন। সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া বিতর্কিতদের একটি তালিকা নিয়ে রাত ১২টার দিকে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) আসেন পদবঞ্চিতদের ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল। তারা ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পদবঞ্চিতদের সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি বিএম লিপি আক্তারকে প্রশ্ন করেন তুই আমার বিরুদ্ধে মাদক নেয়ার বিষয়ে চ্যানেলগুলোতে কথা বলেছিস কেন? লিপি আক্তার পাল্টা বলেন, আপনারাতো সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বিষয়ে খারাপ কথা বলেছেন। এটা আপনাদের কাছ থেকে শিখেছি। পরে গোলাম রাব্বানী লিপিকে বেয়াদব বলে গালি দেন। গোলাম রাব্বানীর এমন মন্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানালে লিপি আক্তারের সঙ্গে তার তর্ক বেধে যায়। একপর্যায়ে গোলাম রাব্বানী নিজেই লিপি আক্তারের গায়ে হাত তোলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে রাব্বানীর অনুসারীরাও লিপিসহ তার সঙ্গী ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের সভাপতি ফরিদা পারভীন ও সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের গত কমিটির সহ-সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহসহ অন্যদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় টিএসসির ভেতরে তাদের ওপর দুই দফায় হামলা করা হয়। হামলায় পদবঞ্চিতদের প্রায় ১৫ জনের মতো আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন তারা। এর মধ্যে রয়েছেন- নতুন কমিটির সংস্কৃৃতি বিষয়ক উপ-সম্পাদক নিপু ইসলাম তন্বী, তিলোত্তমা শিকদার, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদা পারভীন ও সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা, কবি সুফিয়া কামাল হল শাখার সাধারণ সম্পাদক সারজিয়া শারমিন সম্পা, শামসুন নাহার হল শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াসমিন শান্তা, সাবেক কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-সম্পাদক এমদাদ হোসেন সোহাগ, সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক আজমীর শেখ, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক উপ-প্রচার সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহসহ কয়েকজন। এরমধ্যে শেখ আব্দুল্লাহ’র ডান ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায়। অজ্ঞান অবস্থায় তিনি প্রায় আধা ঘণ্টা রাজু ভাস্কর্যে শুয়ে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, টিএসসিতে হামলার পর রাত তিনটার দিকে পদবঞ্চিতরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে অবস্থান নেন। এ সময় তারা সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় তারা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগেরও ঘোষণা দেন। বিতর্কিতদের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ দিতে এসে হামলার শিকার হওয়ায় তারা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ও তার কাছে বিচার চান। পরে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক টিএসসি থেকে বেরিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আসেন। এ সময় পদবঞ্চিতদের বুঝিয়ে অনশন থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু পদবঞ্চিতরা তাদের গ্রহণ করেননি। তারা মারধরের বিচার দাবি করে তাদের চলে যেতে বলেন। এ সময় গোলাম রাব্বানী তাদের উদ্দেশে বলেন, আমি দুঃখিত। তোমরা চলে যাও। আমি কাল নেত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে আসবো। কিন্তু হামলার শিকার নেতাকর্মীরা তাতে রাজি হননি। তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস না পেলে তারা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। এ অবস্থায় সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীসহ তাদের অনুসারীরা উপস্থিত ছিলেন। জানতে চাইলে পদবঞ্চিতদের নেতৃত্বে থাকা গত কমিটির প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু বলেন, আমরা যে ৯৯ জনের নামের তালিকা দিতে সভাপতি-সম্পাদক বরাবর আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী আমাদের বোন ও রোকেয়া হলের সভাপতি বিএম লিপি আক্তারকে মারধর করে। এর পর পরই তার অনুসারীরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। তিনি অভিযোগ করেন, তাদের ডেকে এনে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। তারা এই হামলার বিচার চান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চান। সাবেক সদস্য মো. তানভীর হাসান সৈকত অভিযোগ করে বলেন, আমরা বিতর্কিতদের ব্যাপারে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে গিয়েছিলাম। গতকাল সেখানেও আমরা হামলা ও লাঞ্ছনার শিকার হই। এ সময় তিনি লিপি আক্তারকে মারধর করায় গোলাম রাব্বানীকেও প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেন। নিজের গায়ে হাত তোলার বিষয়ে রোকেয়া হলের সভাপতি বিএম লিপি আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। আমরা ১২ জন লাঞ্ছিত হয়েছি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই। গোলাম রাব্বানী যে তাকে মারধর করেছিল সে বিষয়ে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে সে বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানাবো। অভিযোগের বিষয়ে গোলাম রাব্বানী বলেন, ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী কমিটিকে কেন্দ্র করে ইস্যু তৈরির চেষ্টা করছে। কারও গায়ে হাত তোলা হয়নি। সিন্ডিকেটের নির্দেশে নাটক সাজিয়ে তারা বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করছে।
ছাত্রলীগ নেত্রীকে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ: এদিকে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদবঞ্চিত হয়ে প্রতিবাদের কারণে হামলার শিকার হওয়া রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশাকে অপহরণ চেষ্টার অভিযোগ করেন তিনি। এ ঘটনায় তিনি রাজধানীর শাহবাগ থানায় গতকাল রাতে একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। জিডি নম্বর-১২০১। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করেন, বদরুন্নেছা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এস কে রিমা তাকে ফোন দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিক্ষা উপ-মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল কথা বলতে চান। সন্ধ্যায় রিমা হাতিরপুলের একটি বাসায় শ্রাবণী দিশার কাছে যান। কিন্তু রিমার আচরণ দেখে তিনি বুঝতে পারেন নওফেলের কথা বলে তাকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এ সময় তড়িঘড়ি করে রিমা বেরিয়ে যান। পরে তারা জানতে পারেন মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বর্তমানে চীনে অবস্থান করছেন। পরে এই ঘটনায় শ্রাবণী দিশা শাহবাগ থানায় জিডি করতে যান। এ সময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগের বিষয়ে সেই বদরুন্নেছা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এস কে রিমা বলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নওফেল আমার কাছে ফোন করে শ্রাবণী দিশার নম্বর চান। পরে শ্রাবণী দিশা আমাকে ফোন দিয়ে হাতিরপুলে একটি বাসায় যেতে বলেন। আমি সেখানে যাই। তার সঙ্গে আমার স্বাভাবিক কথাবার্তা হয়। অপহরণের কি হলো এখানে বুঝতেছি না। মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল দেশে অবস্থান করছেন বলেও জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে খোলা চিঠি পদবঞ্চিত নেতার: এদিকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে খোলা চিঠি দিয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন। রাজনীতির মাঠে সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি ঠাঁই পাননি। খোলা চিঠিতে তিনি লেখেন- ‘আপা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি বৃহৎ পরিবার। যে পরিবারের প্রত্যকটি সদস্য একে অন্যের বিপদের সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে, যেকোনো প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অতীতে তাই হয়েছে। না-হলে কতবার যে আমাদের পরাজয় হতো। আমরা আহত ভাইটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাজপথে চিৎকার করেছি, প্রতিবাদ করেছি কিন্তু ফেলে যাইনি। আমরা লাশ কাঁধে নিয়ে মিছিল করেছি তবুও রক্ত চক্ষু ভয় পাইনি। আমার ভাই আমার রক্ত আমার বোন আমার সাহস। কিন্তু আপা পরিতাপের বিষয় আজ সেই পরিবারের সদস্য দুই দলে বিভক্ত। আজ সেই পরিবারের সদস্য একে অন্যের রক্ত ঝরাতে ব্যস্ত। কারো মধ্যে সহমর্মিতার ছোঁয়া নয় বরং প্রতিহিংসার খড়গ। সবার মেলবন্ধনে যে পরিবার গড়ে উঠেছিল সেই পরিবার আজ ধ্বংসের পথে। আজ বোনের রক্ত ভাইয়ের হাতে। আজ ভাই ভাইয়ের শত্রু। এমনটা তো চাইনি, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। আপা আপনি জানেন একটা কমিটি হয়েছে। অনেক ত্যাগী কর্মী সেখানে স্থান পায়নি। যারা স্থান পায়নি তারা প্রতিবাদ করেছে বিদ্রোহ বিক্ষোভ করেছে। কিন্তু তাই বলে তারা বখে যায়নি। তারা প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়েছে তাদের সেখানে মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছে। সে কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য। ঘুমাতে পারি নাই আপা, কয়েক রাত ঘুমাতে পারি নাই। আপা জানেন, পরিশ্রমের সংগঠনে মূল্যহীন ভেসে আসা মানুষের স্থান হয় কিন্তু সংগঠন করা ছেলেটা ব্যক্তি স্বার্থে ছিটকে পড়ে! কিন্তু কেন? আমাদের দাবি তেমন কিছু ছিল না শুধু বিতর্কিতদের সরিয়ে দেয়ার দাবি উঠেছিল। কিন্তু না, উল্টো তাদেরই তার প্রতিদান দিতে হলো। সমগ্র নগরবাসী যখন ঘুমে অচেতন তখন আবারো আমাদের বোনগুলোকে ওরা বেধড়ক মেরেছে। সবার সামনে অপমান লাঞ্ছিত করেছে। আপা কষ্ট হচ্ছে। অনেক কষ্ট হচ্ছে। আপা আপনিই তো আমাদের সব। আপনিই তো আমাদের অভিভাবক, আমাদের পিতা-মাতা। আপনার কাছে আশ্রয় চাওয়া ছাড়া আর কোথায় যাব? কোথায় গেলে বিচার পাবো?’