মত-মতান্তর

আমি রাফি বলছি

শামীমুল হক

১১ এপ্রিল ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৬:২৭ পূর্বাহ্ন

আমি রাফি। নুসরাত জাহান রাফি। হ্যাঁ, আমিই আজকের বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ আমাকে নিয়ে কাঁদছে। আমার শোকে কাতর। আমি পরপার থেকে অন্য এক বাংলাদেশ দেখছি। যে বাংলাদেশ নিয়ে আমি গর্ব করছি। সতীর্থদের বলছি, দেখে যাও আমার জন্মস্থান। যেখানে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে  জ্বলছে  রাফি আগুন। যে আগুনের তাপ আমাকে দেয়া আগুনের চেয়েও শতগুণ বেশি। আজকের বাংলাদেশের রূপ দেখে দীর্ঘ পাঁচদিন যমে আর ডাক্তারের যে টানাটানি তা ভুলে গেছি।

হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণার কথা ভুলে গেছি। আমার শুধু মনে পড়ছে একটিই কথা- মরণের পর যে বাংলাদেশ দেখছি, মরণের আগে কেন তা দেখলাম না। আফসোস, এমন দেখলেতো আমি বেঁচে থাকতাম বাঁচার মতো। জানেন, আজ আমার খুব করে মনে পড়ছে সেই কথা। আমি যখন হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছি। দগ্ধ শরীর নিয়ে যখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। যখন চিরতরে চোখ বুঝে আসছিল। গোটা বাংলাদেশ যখন আমার দিকে তাকিয়ে, ঠিক তখনই সোনাগাজীর রাজপথে শিক্ষক নামের কলঙ্ক সিরাজের পক্ষে তার পোষা কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছিল। সেই ঘেউ ঘেউ যখন আমার কানে শেল হয়ে বিদ্ধ হচ্ছিল নিজেকে আর সামলাতে পারছিলাম না। এক শয়তান যখন আরেক জালিমের মুক্তি চাইছিল তখন হৃদয়টা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় আমার। ভাবি, আমি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছি। এ অবস্থায় যেখানে শয়তানগুলো ভয়ে জবুথবু হয়ে থাকবে সেখানে দেখলাম ওদের আস্ফালন। এ আস্ফালন আমাকে আরো কাবু করে দেয়। শক্তিহীন করে ফেলে আমাকে। ওরা সমাজের কিট। বিবেকহীন। অমানুষ। পশুর চেয়েও অধম।

যেখানে আমার সঙ্গে করা ঘটনার প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার কথা সেখানে নির্লজ্জের মতো কাপুরুষের পক্ষে স্লোগান ধরেছে। ছিঃ ছিঃ। এমন সমাজই কি আমাদের? পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে যখন লড়াই চলছিল, তখন দেখছি গোটা বাংলাদেশ আমার পক্ষে। সান্তনা খুঁজেছি এখানেই। ওই ক’জন জালিমের পক্ষে নিলেই কি হবে? বাংলাদেশতো আমার পক্ষে। প্রধানমন্ত্রীতো নিজে আমার খবর রাখছেন। নির্দেশনা দিচ্ছেন। আমাকে বাঁচানোর সকল চেষ্টার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সাধারণ মানুষের হৃদয়েতো রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। আমি স্বস্তির  নিঃশ্বাস  ফেলি। আমার বড্ড অভিমান হয়। কেন জানেন? পিতা মাতার পরই যে শিক্ষকের স্থান সেই শিক্ষকই যখন আমার শরীরের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেন। আমার শরীরে যখন তার কামুক হাত পড়ে। তখনইতো আমি মরে গেছি।

তারপর আমি স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। জালিমের শক্তিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। এতেই ক্ষেপে যান ওই জালিম সিরাজ। কামুক সিরাজ। নষ্ট সিরাজ। নির্লজ্জ সিরাজ। যে হায়েনা তার মেয়ের ইজ্জতে থাবা দেয় সে কি করে শিক্ষক হয়। ওতো নর্দমার কিট। রাস্তার কুকুর। বনের হিংস্র প্রাণীর চেয়েও ভয়ঙ্কর। পরপার থেকে এমন নর্দমার কিটের কি বিচার হয় তা দেখার অপেক্ষা করছি। আমি জানি, এ বিচার পেতে আমার পরিবারকে অনেক হেনস্তা হতে হবে।

তবে,  বিশ্বাস করি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যেখানে আমার পাশে আছেন সেখানে ওই হায়েনারা পিছু হটবেই। আর গোটা দেশের মানুষ কেউ সন্তান, কেউ বোন হিসাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। আমাকে নিয়ে আমার পরিবারেরও স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্নই আজ চাপা পড়েছে পাহাড়ের তলে। সিরাজ নামক এমন পাহাড় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে। শেষ মুহূর্তে আমি অনুরোধ করবো এসব পাহাড়ের পাশে কেউ দাঁড়াবেন না। এদের বিতাড়িত করুন। শাস্তি নিশ্চিত করুন। তাহলেই আমার আত্মা শান্তি পাবে। অনেক কিছু বলার ছিল। কিন্তু আর এগুতে পারছি না। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সেই প্রতিষ্ঠানই হলো আমার যম! থাক আর নয়...।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status