দেশ বিদেশ

পুলিশ যোদ্ধার মুখে ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতের কাহিনী

সাখাওয়াত হোসেন হৃদয়, পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) থে

২৬ মার্চ ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:৩০ পূর্বাহ্ন

 নূরুল ইসলাম। পিতা মৃত শামছুল হক। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দুর গ্রামে তার বাড়ি। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া একজন বীর  সৈনিক। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধকারী পুলিশ সদস্যদেরও (হাবিলদার) একজন। ২৫শে মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সসহ ঢাকার কয়েকটি স্থানে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পুলিশ সদস্যরা। ওই সময় বেঁচে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজন হলেন নূরুল ইসলাম। পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৫শে মার্চের ভয়ঙ্কর সেই রাতের করুণ কাহিনী। নূরুল ইসলাম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশেনা করে ১৯৬৫ সালে তৎকালীন ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্‌) চাকরি নেন। ১১ মাস পর চাকরি ছেড়ে চলে আসেন। ১৯৬৮ সালে পুলিশে চাকরি নেন। প্রশিক্ষণ শেষে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে যোগ দেন। ছয় দফা দাবির আন্দোলন নিয়ে দেশ তখন উত্তপ্ত। এ নিয়ে পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে চলে দফায় দফায় বৈঠক। কিন্তু ছয় দফা দাবির ব্যাপারে কোনো ফয়সালা আসেনি। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই জনসভায় পুলিশ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নূরুল ইসলাম। ওই ভাষণের পর ছয় দফা দাবির আন্দোলনে দেশ আরো উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। ২১, ২২ ও ২৩শে মার্চ ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউজে আবারো দুই দেশের মধ্যে বৈঠক বসে। বৈঠকে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন ইয়াহিয়া, ভুট্টো, নিয়াজী ও টিক্কা খান। আর পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে অংশ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তখন প্রেসিডেন্ট হাউজের সামনের ফটকে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন পুলিশ সদস্য নূরুল ইসলাম। পরপর তিন দফায় বৈঠক করেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। এতে জনগণের মাঝে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করে। ২৪শে মার্চের দুপুরের পর থেকেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাসহ অনেক পুলিশ সদস্যই যার যার মতে পালিয়ে যেতে শুরু করেন। ওইদিন সকাল ৭টায় রোলকল (হাজিরা) হলেও বিকাল ৪টা ও সন্ধ্যা ৭টায় কোনো রোলকল না হওয়ায় পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দুপুরে খাবার খেলেও রাতে মেসে কোনো রান্না হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে নূরুল ইসলামসহ বেশ কিছু পুলিশ সদস্য পুলিশ লাইন্সে রয়ে যান। তারা সিদ্ধান্ত নেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রাগারে তাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়েই আত্মরক্ষা করবেন। কিন্তু কোথাও অস্ত্রাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আর.আই)কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় ৩০ মিনিট খোঁজার পর রিজার্ভ ইন্সপেক্টরকে খুঁজে পান তারা। তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে অস্ত্রাগার খুলেন। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই সকল পুলিশ সদস্যরা রাইফেল নিয়ে যার যার অবস্থানে সরে পড়েন। নূরুল ইসলাম বলেন, এ সময় বাইরের কিছু সাধারণ লোকজনও অস্ত্রাগারে ঢুকে অস্ত্র নিয়ে যায়। রাত নয়টার পর থেকে পুরো ঢাকা শহর অন্ধকার হয়ে যায়। কোথাও কোনো আলো নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিরব, নিস্তব্দ রাত। ১০টার দিকে সকল সরকারি অফিসে একযোগে সাইরেন বেজে ওঠে। তখন গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের চারতলা ভবনের ছাদে অবস্থান নেন নূরুল ইসলাম। ওই সময় ছাদ থেকে পার্শ্ববর্তী ইপিআর সদর দপ্তরসহ, সদরঘাট ও আশেপাশের এলাকা স্পষ্টভাবে দেখা যেত। তিনি জানান, পাকিস্তানি সেনাদের ৪-৫টি জিপ ইপিআর সদর দপ্তরে (পিলখানা) প্রবেশ করে। মুহূর্তেই অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় পাকিস্তানি সেনারা। পৌনে ১১টার দিকে লাইটবিহীন কয়েকটি জিপ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকে। পুরো এলাকাজুড়ে মেশিনগান দিয়ে গোলাবর্ষণ শুরু করে। গোলাবর্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একটি কুকুরও তখন বাঁচতে পারেনি। এ সময় পাল্টা গুলি শুরু করে পুলিশ লাইন্সের পুলিশ সদস্যরাও। এতে প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। ফজর পর্যন্ত চলে বিরামহীন পাল্টা গোলাগুলি। পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ লাইন্সের গেটে সামনের চারটি টিনশেড ব্যারাক পুড়িয়ে দেয়। গোলাগুলির একপর্যায়ে নূরুল ইসলামের বাম কাঁধ ঘেঁষে একটি গুলি চলে যায়। এতে আহত হন তিনি।
তার কাছে মজুদকৃত গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ছাদ থেকে নিচে নেমে আসেন। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্যের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। পুলিশ লাইন্সের গাড়ির গ্যারেজের পেছন দিক দিয়ে চামেলীবাগ দিয়ে বেরিয়ে আসেন। রাস্তায় না ওঠে বাসাবাড়ি ডিঙিয়ে তিনি মগবাজার ওয়ারলেস কলোনীতে তার এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন। সেখানে রাত্রিযাপন করে পরের দিন রামপুরা হয়ে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় তাজউদ্দীনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এরপর সেখান থেকে তিনি নিজ বাড়ি পাকুন্দিয়ায় চলে আসেন। ২৫শে মার্চের সেই ভয়ঙ্কর রাত্রির কাহিনী বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন নূরুল ইসলাম। তিনি বলেন, অলৌকিকভাবে আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। তবে স্বাধীনতার ২৬ বছর পর ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার মুক্তিযুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পুলিশ সদস্যদের স্মরণ করেন। তাদের সম্মানিত করেন। পরবর্তীতে আবারো ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালে পুলিশকে স্বাধীনতা পদক পুরস্কার প্রদান করেন এবং ২০১৫ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে শহীদ পুলিশ সদস্যদের এককালীন পাঁচ লাখ টাকা ও জীবিত পুলিশ সদস্যদের চার লাখ টাকা করে প্রদান করেন। সেজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status