ষোলো আনা

চকবাজার ট্র্যাজেডি

যেভাবে প্রাণে বাঁচলেন তারা

হাফিজ মুহাম্মদ

১ মার্চ ২০১৯, শুক্রবার, ৯:২০ পূর্বাহ্ন

চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াল ট্র্যাজেডির পোড়া দাগ এখনো মোছেনি। রাস্তার ওপরে আগুনে ভস্ম হওয়া রিকশার কাঠামো, গাড়ির অংশবিশেষ অঙ্গার হয়ে পড়ে আছে। পোড়া ভবনগুলোয়র গাঁয়ে কালো দাগ। প্রতিদিন দেখতে আসা দর্শকরা দেখছেন, ছবি তুলছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা চুড়িহাট্টা মোড়ের চারপাশের সড়কে বেরিক্যাড দিয়ে আটকে রেখেছেন। এরইমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর বাসিন্দারা আসতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ থাকলেও অনেকে আবার স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মনে এখন সব সময় অজানা আতঙ্ক কাজ করছে। ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতের চিত্র চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। এরইমধ্যে দেখা যায়, স্থানীয় কয়েকজন পোড়া ভবনের সামনের সড়কে চেয়ার দিয়ে বসে আছেন। সেদিন রাতে আগুন লাগা ভবন থেকে তারা বেচে ফিরতে পেরেছিলেন। তাদের একজন মো. ইরফান। বয়স ৭০। বুধবার রাত তার পরিবারের সামনে এক বিভীষিকা হয়ে এসেছিল। যার পুরো বর্ণনাও তিনি দিতে পারছেন না। চুড়িহাট্টার ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানশনের পাশের বিল্ডিংয়ে ভাড়ায় থাকেন মো. ইরফান। তিনি ৬৫/৬৬ নম্বর বাড়ির ৩য় তলায় থাকতেন। আগুন লাগার সময় তারা ভবনেই ছিলেন। হঠাৎ একটি বিকট শব্দ পান তিনি। এরপরে সামনে শুধু আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পান। আর কান্নার শব্দ। এ সময় তিনি, তার স্ত্রী এবং এক ছেলে ও ছেলে বউ বাসায় ছিলেন। আগুন দেখতে পেয়ে সবাইকে বাসা থেকে বের করে দেন। সামনে আগুন দেখে পেছনের পকেট গেট দিয়ে বের হয়ে যান। তিনি আগুন লাগার ১৫ মিনিট পরে বের হন। তিনি যখন বের হন তখন আগুনের তাপ তার দিকে ধেয়ে আসছিলো। তিনি ও তার পরিবার এখন চুড়িহাট্টার কাছেই মেয়ের বাসায় থাকেন। তার বাসার আসবাবপত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি বলেও জানান। তবে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বন্ধ করে দিয়েছে। কবে খুলবে তাও তাদের জানা নেই। তবে পুরাণ ঢাকায় নিরাপদ বসবাস চান। বলেন, কেমিক্যাল এবং মানুষ এক সঙ্গে চলতে পারে না।

ওয়াহেদ ম্যানশনের উল্টো পাশের ১৬নং ভবনের মালিক মো. মাইনুদ্দিন। ৬৬ বছরের এ বৃদ্ধা জানান তার আগুন থেকে বেঁচে যাওয়ার গল্প। তিনি একা বাঁচেননি, তার চার ভাইয়ের পরিবারকে বের করে নিয়েছেন। এ ছাড়া আগুনে পুড়ে যাওয়া পাশের ১৬/১ নং ভবনের বাসিন্দাদের তার ছেলেরা দোতলার জানালা ভেঙ্গে ভবন থেকে বের করে এনেছেন। এ দুঃসাহসিক যাত্রা মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটেছে। মাইনুদ্দিন বলেন, আগুন লাগার সর্বোচ্চ এক মিনিট আগে আমি রাস্তা থেকে বাসায় যাই। যখন বাসায় যেয়ে দাঁড়াই এরইমধ্যে বাসার লোকজন ভূমিকম্প বলে চিল্লাচিল্লি শুরু করে। বাইরে বের হয়ে দেখতে পাই আগুনের লেলিহান শিখা। এত ভয়ঙ্কর তাপ আসতে ছিলো যে ওইদিক থেকে গেলে আমি পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখি। আমি বুদ্ধি করে সবাইকে পেছনের গেট দিয়ে বের করার চেষ্টা করি। আমার ছেলেরা কয়েকটা বাড়ির গেট ভেঙে তারপরে পেছনের গলি থেকে ওদেরকে বের করে দেয়। তিনি ১৬/১ ভবনের দোতলার ভাঙা ছাদ দেখিয়ে বলেন, আগুনের পরে বাসার মহিলাদের বের করে আমি এবং আমার ছেলেরা ওই বাসার বাসিন্দাদের বের করে পেছন থেকে নিয়ে আসি।

অনেকে আবার ওই ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নেমে আসেন। আগুনে আমার ভাতিজা ওয়াসি উদ্দিন মাহিদ প্রাণ হারায়। তারা অন্য বাসায় থাকতো। মাইনুদ্দিন আরো বলেন, আমার পাশের ১৮নং বিল্ডিং। এটি সামনে থেকে পুড়ে গেলেও পেছনে ছিলো কেমিক্যালের গুদাম। সেখানে আগুন লাগলে তাদের বিল্ডিং কোনোভাবেই বাঁচানো যেত না বলেও জানান। তিনি চান, তার এলাকার কোনো কেমিক্যাল যেন না থাকে। এতগুলো মানুষের জীবন যেভাবে তার চোখের সামনে চলে গেল সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে না হয়।

মাইনুদ্দিনের ছোট ছেলে মো. আলিম উদ্দিন সংগীত। তার বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় তিনিও এসে পাশে এসে দাঁড়ান। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের এ শিক্ষার্থী তার চোখের সামনে ভয়ঙ্কর আগুনের চিত্র বর্ণনা করছিলেন। তিনি বলেন, আমি হায়দারবক্স লেনে মসজিদের পাশেই ছিলাম। আগুন দেখে আমি আর বাসায় আসতে পারিনি। চোখের সামনেই আগুনে এতগুলো প্রাণ নিভে গেল ভাবতেও পারি না। সেখানে থেকে দুই একজনকে বাঁচাতে সহযোগিতা করেছি। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ৬৫/৬৬ বাড়ির মালিকের এক ছেলে মো. ওয়াসিম বলেন, আগুন লাগার আগেও আমি এখানে আড্ডা দেই। আমি একটু পাশে গেলাম আর দেখলাম আগুন আর ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি আর ভেতরে আসতে পারিনি। এরইমধ্যে দেখি আমাদের বিল্ডিংয়েও আগুন ধরে গেছে। আমার পরিবার এবং ভাড়াটিয়ারা কোনোভাবে বের হয়ে এসেছে।

একইভাবে বাড়ির পেছনের পকেট গেট ভেঙ্গে বের হয়ে আসেন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ১৪, ১৬/১, ১৭ এবং ১৮নং বাড়ির বাসিন্দারা। তাদের কেউ কেউ বিল্ডিংয়ের ছাদে যেয়ে পানির পাইপ বেয়ে নেমে আসেন। অনেকে বাসার সামনের অবস্থা দেখে পেছনের জানালা, দরজা ভেঙ্গে নেমে আসেন। এসব বাড়ির মালিকরা বাসায় আসা শুরু করলেও ভাড়াটিয়ারা এখনো আসেননি বলে জানান তারা। গায়ে গায়ে লাগানো এসব ভবন থেকে কেমিক্যাল জাতীয় সকল দাহ্য পদার্থ দ্রুত সরানোর জন্য সরকারের কাছে তারা আবেদন জানান। তারা বলেন, সরকার কেমিক্যাল শুধু সরালেই হবে না। সঙ্গে সঙ্গে কড়া নজরদারি রাখতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status