প্রথম পাতা

ঢাকায় যত বাগ

হাফিজ মুহাম্মদ

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ১০:১৩ পূর্বাহ্ন

নাম বিচিত্রের শহর ঢাকা। ‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি’র শহর এ ঢাকায় নামের বাহারে বাগের আধিক্য বেশি। এ বাগের সঙ্গে বাগানের একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে। নামের শুরুটা হয় মুঘল আমলে। যদিও তখন নামের শেষে বাগিচা এবং বাগান ছিল। পরবর্তীতে  তা সংক্ষেপ ‘বাগ’ সংবলিত রূপ ধারণ করে। ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের ‘ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী’ বইয়েও এসব কিছু কিছু স্থানের নামের ইতিহাস উল্লেখ রয়েছে।

রাজধানীর সব থেকে পরিচিত জায়গা শাহবাগ। এই জায়গাটার অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ ও মাজাদার। পুরনো ঢাকা ও নতুন ঢাকার সংযোগস্থল হচ্ছে এই শাহবাগ। এই জায়গার পত্তন হয় ১৭ শতকে মুঘল আমলে। ওই সময় এখানে কেবল মানুষ বসবাস করতে শুরু করে। শাহবাগের নাম ছিল তখন বাগ-ই-বাদশাহী। আর পুরনো ঢাকা ছিল সুবা বাংলার রাজধানী এবং মসলিন বাণিজ্যের কেন্দ্র। বাগ-ই-বাদশাহী ছিল ফার্সি নাম। এর অর্থ দাঁড়ায় রাজার বাগান বা বাদশাহর বাগান। মুঘলদের শাসনামলে ভারতের রাজভাষা ছিল ফার্সি। শাহবাগের নামও ফার্সি থেকেই এসেছে। মুঘল এবং মুসলিম শাসনামল পর্যন্ত তাই ছিল। শুধু শাহবাগ না তখন বেশিরভাগ নামই ছিল ফার্সি ভাষায়। পরে এই নামটি সংক্ষেপ রূপ নেয়। বাগ-ই-বাদশাহী থেকে নাম হয় শাহবাগ। ছোট নাম শাহবাগের নামটির অংশ দুটিও ফার্সি ভাষায়। ‘শাহ’ অর্থ রাজা এবং ‘বাগ’ অর্থ বাগান। এই দুটি শব্দের মিশ্রণে হয়েছে আজকের শাহবাগ। শাহবাগে ছিল বিশাল এক বাগান। আর সে বাগান থেকেই বর্তমান শাহবাগ। যদিও আজকের শাহবাগে কোনো বাগানের অস্তিত্ব নেই। শাহবাগে এখন বাগানের অস্তিত্ব না থাকলেও দোকানে সাজানো হরেক প্রজাতির ফুল চোখে পড়ে। এসব ছেঁড়া ফুলের ভিড়ে শাহবাগের ইতিহাস জানেন না অনেকেই।

শাহবাগের পাশের একটি স্থানের নাম পরীবাগ। একপাশে হাতিরপুল অন্যদিকে রমনার পিছনের পাশ ঘিরেই পরীবাগ এলাকার অবস্থান। পরীবাগ এলাকার নাম নিয়ে কয়েকটি মতবাদ প্রচলিত আছে। পরীবাগ এলাকার নামকরণ হয়েছে নবাব খান বাহাদুর আহসান উল্লাহর মেয়ে পরীবানুর নামে। পরীবানু ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহর সৎ বোন। আর এই জায়গাটি ছিল ঢাকার নবাবদের বাগানবাড়ি। তার পূর্বে পরীবাগ এলাকায় ছিল হিন্দু জমিদারদের বসবাস। নবাব সলিমুল্লাহ হিন্দু জমিদারদের কাছ থেকে এলাকাটি ক্রয় করেন। পরীবানুর আবাসস্থল হিসেবে বাগানবাড়িটি পরীবাগ নামে পরিচিতি লাভ করে।

আরেকটি তথ্য মতে নবাব সলিমুল্লাহ তার পিতাকে না জানিয়ে পাটনা বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে পরী বেগমকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। পরী বেগম পরীবাগেই বসবাস করতো বলে এলাকাটির নাম পরীবাগ হয়েছে। অনেকে আবার বলেন, পরীবানু নামে নবাব আহসান উল্লাহর এক মেয়ে ছিল। সে অনুযায়ী পরীবানুর নামে এখানে একটি বিশাল বাগান করেছিলেন আহসান উল্লাহ। সে বাগান থেকেই আজকের পরীবাগের অবস্থান। তবে বর্তমানে পরীবাগ এলাকায় বাসিন্দাদের অনেকেই জানেন না এই স্থানের ইতিহাস। তাদের অনেকেই পরীবাগ নামকরণের পরেই বাস করা শুরু করেছেন বলে জানান।

ঢাকার আজকের মালিবাগ হয়তো সবাই চিনেন। ব্যস্ত এবং জনবহুল একটি এলাকা। কিন্তু মালিবাগ নামের শুরুটা কীভাবে হয়েছে তা অনেকে জানেন না। এক সময় ছিল ঢাকা বাগানের শহর। ওই সময় বাগানের মালিদের ছিল বিশেষ কদর। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছিল বাগান। আর বিত্তশালীরা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যও বড় বড় ফুলের বাগান করতেন। মালিবাগে তখন শুধু মালিরা তাদের পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। মালিবাগের পাশেই ছিল নবাব রশিদ খাঁর বাগিচা, বাগে হোসেন উদ্দিন ও নবাব বাগিচা। মালিবাগের এই বাগিচাগুলোতে মুসলিম মালিরা ফুল পরিচর্যার কাজ করতেন এবং চকবাজারসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তারা ফুল সরবরাহ করতেন। এখনকার ঢাকায় যেসব স্থানের নামের শেষে ‘বাগ’ শব্দ এগুলো সেই বাগান-বাগিচার চিহ্ন বহন করে। মালিবাগের পত্তন না হয় মালিদের থেকে হয়েছে। কিন্তু স্বামীবাগ নামের শুরুর ইতিহাস ভিন্ন। সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ডের পাশেই অবস্থান স্বামীবাগের। এই নামটির শুরু এখানে ত্রিপুরালিংগ স্বামী নামে এক ধনী এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি সবার কাছে স্বামীজি নামেই পরিচিত ছিলেন। তার নামে এলাকার লোকজন স্বামীবাগ নামকরণ করেন।

রাজধানী ঢাকার গোপীবাগ এখন ঘনবসতি এলাকার মধ্যে অন্যতম একটি। গোপীবাগ ভিন্ন ভিন্ন লেনে বিভক্ত। গোপীবাগের পূর্বে গোলাপবাগ, পশ্চিমে টিকাটুলি, দক্ষিণে স্বামীবাগ আর উত্তরে কমলাপুর এলাকার অবস্থান। গোপীবাগে কোনো বাগিচার উল্লেখ পাওয়া না গেলেও এখানে গোপীনাথ সাহা নামে একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। এলাকাটি তার নিজস্ব সম্পত্তি ছিল। তিনি স্থাপন করেছিলেন ‘গোপীনাথ জিউর মন্দির’। তার নাম অনুসারে ওই সময় থেকে এলাকার নাম হয় গোপীবাগ। ভারতের বেলুড়ে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশনের একটি শাখা এখানে ১৮৯৯ সালে স্থাপিত হয়।

গোপীবাগের পাশের এলাকাটিই আজকের গোলাপবাগ। ঢাকার এক সময়ের বিখ্যাত রোজগার্ডেনকে কেন্দ্র করেই গোলাপবাগ নামের শুরু। মিউনিসিপ্যালিটি ঢাকার চেয়ারম্যান কাজী বশিরের স্থাপত্যশৈলী বাড়িটি রোজগার্ডেন বা গোলাপবাগ নামে পরিচিত ছিল। রোজগার্ডেনের পেছনে জনবসতি গড়ে উঠলে এলাকাটি গোলাপবাগ নামে পরিচিত হয়। তখন ওই বাড়িটিতে অনেক গোলাপ গাছ ছিল। যদিও এখন আর অস্তিত্ব নেই। তবে গোলাপের নামটির আজও পরিচিতি রয়েছে। সমপ্রতি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ রোজগার্ডেনকে পুরাকীর্তির আওতায় এনেছে।

বর্তমান ধানমণ্ডির সোবহানবাগ এলাকাটি বৃটিশ আমলে ছিল ধানক্ষেতে পরিপূর্ণ। পুরনো ঢাকার ইসলামিয়া লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক ডেপুটি প্রশাসক জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদিলের পিতামহ মাওলানা আবদুস সোবহান এলাকাটি কিনে একটি বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। তার নামেই এলাকাটির নামকরণ করা হয় সোবহানবাগ। বর্তমানের সোবহানবাগ মসজিদটি শুরুতে ছোট করে আবদুস সোবহান নিজ খরচেই নির্মাণ করেছিলেন। যদিও এখন মসজিটির অবস্থান অনেক বড় ও পরিচিত। তখন মসজিদের পাশে একটি পুকুরও খনন করা হয়েছিল। বর্তমানে তার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। ১৯৪০ সালে মাওলানা আবদুস সোবহান মারা গেলেও তার নামটি রয়ে গেছে আজও।

লালবাগ নামকরণে ইতিহাস খুঁজলে চলে আসে লালবাগ কেল্লার নাম। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তার তৃতীয় পুত্রের নামে আজম শাহ সুবেদার থাকালীন দুর্গটির কাজ শুরু করেন। এটি আওরঙ্গাবাদ দুর্গ নামেও পরিচিত। পুরাতন ঢাকা নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে দুর্গটির অবস্থান। এই লালবাগ দুর্গকে ঘিরেই লালবাগ নামকরণ হয়েছে। এছাড়া ঢাকায় আরো একাধিক স্থানের নামের শেষে ‘বাগ’ রয়েছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় এলাকাগুলো হচ্ছে- ইসলামবাগ, আরামবাগ, রায়েরবাগ, মধুবাগ, রাজারবাগ, গুলবাগ, শান্তিবাগ, টোলারবাগ, পীরেরবাগ, মীরহাজীরবাগ, মোমেনবাগ, কাঁঠালবাগসহ আরো অনেক ‘বাগ’ রয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status