ষোলো আনা

অনলাইনে ঝুঁকছেন বাজিকররা

পিয়াস সরকার

২৫ জানুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ৯:২৫ পূর্বাহ্ন

বিপিএলের ষষ্ঠ আসরে মাঠে চলছে দর্শক খরা। কিন্তু উল্টো চিত্র বাজিকরদের মাঝে। তারা অনলাইনে বাজি খেলছেন দেদারছে।

গ্লোবাল ভিলেজখ্যাত এই বিশ্বে দেশীয় বাজিকররা যোগাযোগ করতে সক্ষম হচ্ছেন বিশ্ববাজিকরদের সঙ্গে। বাংলাদেশিরা বেট ৩৬৫ ও বেট এশিয়া ৩৬৫ এই দুটি সাইটে অধিক ব্যবহার করছেন। তবে বেট এশিয়ায় আগ্রহ আরো বেশি। কারণ এই সাইটে বিকাশের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করা যায়। আর বেট ৩৬৫ এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হয় ডেভিড কার্ড, ক্রেডিট কার্ড।

এদের মধ্যে বেটিং সাইট ৩৬৫ ডটকম যেকোনো ধরনের খেলার বাজির জন্য জনপ্রিয়। বাজিকররা বিনগো, ভেগাস, পোকার, লাইভ ক্যাসিনো, ক্যাসিনোতেও টাকা ঢালতে পারেন। বিশ্বের ১৮৮টি দেশে প্রায় ২ কোটি গ্রাহক রয়েছে তাদের। তবে এসব সাইটের পাশাপাশি রেবটওয়ে ডটকম, বেটফ্রিড ডটকম, ডাফাবেট ডটকম, বেটফেয়ার ডটকম, সাইট ৩৬৫ ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম, ইউনিবেট ডটকম, বেট ভিক্টর ডটকম, নেটবেট ডটকম, টাইটানবেট ডটকম, উইনার ডটকম ও পেডি পাওয়ার ডটকম বাংলাদেশে প্রচলিত। সম্প্রতি বিপিএল বাজি বন্ধ করতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি দমন ইউনিট ১২টি বিদেশি বেটিং সাইট বাংলাদেশে বন্ধের জন্য চিঠি দিয়েছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ও নিরাপত্তা বিভাগকে। সাইবার ক্রাইম ইউনিট সেসব সাইট বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে অবগত করেছে। এই সাইটগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে বন্ধ করে দিলেও ভিপিএন, প্রক্সি সার্ভার ও অ্যাপ দিয়েও তা চালানো সম্ভব হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ও নিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। প্রক্সি দিয়ে চালালে তা আটকানো কষ্টকর। তবে এগুলো আটকানোর জন্য বিপিএল কমিটি চাইলে পুলিশ তাদের সাহায্য করবে। পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি সোহেল রানা বলেন, বিপিএল নিয়ে মাঠে ও মাঠের বাইরে জুয়া চলছে আমরা অবগত। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এ নিয়ে তৎপর আছে কাউকে আটক করা হলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাংলাদেশি বাজিকররা সাধারণত ক্রিকেটে বেশি আগ্রহী।

একাধিক অনলাইন বাজিকরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। এসব সাইটে অর্থ প্রাপ্তিতে কোন সমস্যা হয় না। তাই তারা এসব সাইটে বেশি আগ্রহী। আর বাজি খেলতে বেট এশিয়ায় সর্বনিম্ন ২০ টাকা দিয়েও খেলা যায়। কোন দলের জয়ের মুহূর্তেও বাজি ধরা যায় এটাও আরেকটি প্রধান কারণ। অর্থাৎ জয় নিশ্চিত ম্যাচেও অধিক অর্থের বিনিময়ে পাওয়া যায় সামান্য কিছু টাকা। যেমন, একটি দলের প্রয়োজন ২০ বলে ৫ রান। এরকম সময়েও ১ হাজার টাকা লাগিয়ে ২০-৩০ টাকা প্রাপ্তি সম্ভব। একজন বাজিকরের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, অনেকে ভাগ্য পরীক্ষার জন্য এই ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। কারণ, এই সময়ে ১শ’ টাকার বিপক্ষে কয়েক গুণ অর্থাৎ ৫শ’, ৬শ’ কিংবা অধিক টাকাও পাওয়া যায়। আবার এই একটি খেলায় একসময়ে জয় পরাজয়ের পাশাপাশি ১৯টি পয়েন্টে বাজি খেলা সম্ভব। যেমন টস, প্রথম বলে রান, প্রথম ওভারে রান, প্রথম ৬ ওভারে রান, কোনো ব্যাটসম্যানের জোড়া-বেজোড়া রান, সর্বাধিক স্কোরার, সর্বাধিক উইকেট প্রাপক, ব্যাটসম্যানের আউটের ধরন ইত্যাদিতে বাজি ধরা সম্ভব।

রাজধানীর মিরপুরে ২১শে জানুয়ারি বিপিএল’র দ্বিতীয় খেলা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা ডাইনামাইটস বনাম চিটাগং ভাইকিংস এর মাঝে। এই সময়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, টসের আগে দুই দলের হয়ে পাওয়া যাবে ১.৮০ হারে টাকা। অর্থাৎ ১শ’ টাকা ধরলে বিপরীতে জয় পেলে পাওয়া যায় ১৮০ টাকা। লাভ ৮০ টাকা। ঢাকার জয়ের রেট ১.৫৭ ও চট্টগ্রামের ছিল ২.১২। অর্থাৎ একজন বাজিকর ঢাকায় ১শ’ টাকা লাগিয়ে জয়ে পেতেন ১৫৭ টাকা। লাভ ৫৭ টাকা। যদিও এই ম্যাচে ঢাকা হেরেছে ৩ উইকেটে। অপরদিকে চট্টগাম নেয়া বাজিকররা ১০০ টাকায় ২১২ টাকা। লাভ ১১২ টাকা। বাজিকরদের  আরেকটি আগ্রহের স্থান প্রতি বলে বাজি খেলা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আদনান আহমেদ (ছদ্মনাম) বলেন, আমি লুকিয়ে এই বাজি খেলি। আমি চাইলেও কোনো দোকানে গিয়ে বলপ্রতি বাজি খেলতে পারবো না। তাই অনলাইনে অনায়াশেই বলপ্রতি বাজি খেলতে পারছি।

খোঁজ নিয়ে দেশে বাজির ৪৪টি অনলাইন ক্লাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলো হলো শিপ ক্লাব, ক্লাব ইয়েরি, লায়ন ক্লাব, বেট এশিয়া ক্লাব, বিডি স্পোর্টস, বেঙ্গল বেট, উইনারস ক্লাব, ফ্রেন্ডস ক্লাব, স্টারস ক্লাব, অনলাইন বেটিং ক্লাব, এসআর ক্লাব, বেট ৩৬৫ ক্লাব, বেট ইন্ডিয়া, রয়েল ক্লাব, ঢাকা ক্লাব, এলিট ব্যাটিং ক্লাব, রেমেদিয়া ক্লাব, বিডি ফাইটার, বাংলাদেশ ক্লাব, ডিআরপি, গ্রিন টেবিল, প্রিমিয়ার ক্লাব, টাইটানস ক্লাব, স্টার ওয়ারস, প্রেস ক্লাব, অনলাইন ক্লাব বিডি, পাওয়ার ক্লাব, এশিয়া ৩৬৫, হোয়াইট ক্লাব, চাইনিজ ক্লাব, ডিজিটাল ৩৬৫, ন্যাশনাল ক্লাব, ক্লাব টোয়েন্টি ফোর, বিডি নিউ ক্লাব, বয়েজ ক্লাব, রাইডার্স ক্লাব, উইন বেট, শর্ট থারটি নাইন, সেভেন স্টার ক্লাব, রোবট ক্লাব, বাংলা ক্লাব, ডে নাইট। এই ক্লাবগুলোর সদস্য সংখ্যা ৫০ থেকে ৫০০ জন পর্যন্ত।

আবার আলাপ আলোচনা করে সবাই মিলে বাজি ধরার ম্যাসেঞ্জারে বেটিং গ্রুপও রয়েছে। এই গ্রুপের সদস্যরা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বাজি ধরেন। জয় পেলে ভাগ করে নেন এবং পরাজয়েও টাকাও করেন ভাগ। আবার তাদের নিজস্ব অর্থ রয়েছে। এই অর্থের পরিমাণ ২ লাখ থেকে ৫ লাখ পর্যন্ত। খুঁজে পাওয়া ম্যাসেঞ্জারে গ্রুপের নামগুলো হচ্ছে ঢাকা ক্লাব, স্পোর্টস লাভার, আমরা আমরাই তো, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, চিলি সস বেটিং, সুইট অকটাগন, টাইগার্স টেরিটরি, ব্যাট বল, যোদ্ধা  ইত্যাদি। এসব দলে সাধারণত সদস্য সংখ্যা থাকে ১৫ থেকে ২০ জন।

বেট এশিয়া ৩৬৫-তে টাকা লোড করবার জন্য দেয়া আছে বিকাশ নম্বর। মূলত দুটি বিকাশ নম্বর থেকে এই অর্থগুলো অ্যাকাউন্টে আসে। আবার টাকা উত্তোলনের সময় সাইটে আবেদন করলেই কিছুসময়ের মধ্যেই চলে আসে সেই টাকা। অ্যাকাউন্ট খুলে মাত্র ৫০০ টাকা দিয়েই যুক্ত হওয়া সম্ভব এই সাইটে। এই নম্বর দুটোতে একাধিকবার একাধিক নম্বর থেকে ফোন করা হলেও কেউ ফোন ধরেননি। নিয়মিত বাজি খেলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহি। তিনি এবারই প্রথম বিপিএল-এ বেটিং শুরু করেছেন অনলাইনে। তিনি বলেন, এশিয়া কাপে আমার প্রাপ্য ৮০ হাজার টাকা এখনো পাইনি। আবার পেটিসখোরদের (বাজির মধ্যস্থতাকারী বা দালাল) দৌরাত্মতো আছে। তিনি বলেন, তাৎক্ষণিক টাকা প্রাপ্তি ও ঝামেলা এড়াতেই এই সাইটে এখন বিপিএল খেলি।

আরেকজন বলেন, এই সাইটে সমস্যাও রয়েছে। অনেক সময় অ্যাকাউন্টে অধিক টাকা থাকলে অধিক অর্থ ধরতে ইচ্ছা করে। এই কারণে প্রায়ই ঝুঁকি নিয়ে ধরে ফেলি অধিক অর্থ। এবার আশা যাক এই সাইটের কারণে লেখাপড়া হারাতে বসা এক শিক্ষার্থীর কথা। এই শিক্ষার্থী সাইটে ১৫ হাজার টাকা বাজি খেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভুলে ধরেন ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আবার সেই ম্যাচটি হেরেও যান। এই টাকাটা মূলত ছিল এই ক্লাবের। এই টাকা পরিশোধ করতে বিক্রি করতে হয়েছে ল্যাপটপ, মোবাইল। তিন সেমিস্টার থেকে লেখাপড়া বন্ধ। বাড়ি থেকে টাকা আনছেন আর সেই টাকা পরিশোধ করছেন। তিনি বলেন, এত দিনের বন্ধু সবাই কিন্তু আমার একটি ভুলের সময় কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। টাকার কাছে সবাই পর।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status