প্রথম পাতা

সন্তানের দিকে নজর দিন

কেন বিপথে কিশোরেরা?

মরিয়ম চম্পা

২০১৮-০৬-০৬

প্রযুক্তি বদলে দিয়েছে বহুকিছু। গ্রাম থেকে শহর। কিশোর-তরুণদের আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। কমেছে খেলার মাঠ, বিনোদনের জায়গা। যৌথ পরিবার ভেঙে তৈরি হয়েছে একক পরিবার। একই ভবনে বসবাস করা এক পরিবারের কাছে অন্য পরিবার অচেনা। পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতা আর প্রযুক্তির আগ্রাসন তৈরি করেছে নানা সংকটের। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের একটি বড় অংশ জড়িয়ে   পড়েছে নানা অপরাধে। মাদকাসক্তি, ইভটিজিং, খুনাখুনিসহ নানা অপকর্মে উঠছে তাদের নাম। পশ্চিমা আদলে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং।
শিশু-কিশোরদের অপরাধ কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে পারিবারিক বন্ধন জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, মূলত পরিবারের যতেœর অভাবেই শিশু-কিশোররা বিপথে চলে যাচ্ছে। সমাজও এক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, সন্তানের সঠিক পরিচর্যা, তাদের হাত খরচ, নিয়মিত স্কুলে যায় কি না, তারা কোথায় কি করছে এসব বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বাবা ব্যস্ত থাকলে মাকে দায়িত্ব নিয়ে সন্তানের সব ভালো মন্দের খোঁজ রাখতে হবে। সমাজে যেসব সন্তান আজ প্রতিষ্ঠিত তাদের প্রত্যেকের পেছনে বাবা মায়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যেসব বাবা মা তাদের সন্তানদের পেছনে নিবিরভাবে লেগে থাকেন তাদের সন্তানরা বিপথে যাওয়ার সুযোগ পায় না। একই সঙ্গে ঢাকা শহরের প্রত্যেকটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিকদের প্রত্যেকটি ভবনে বাচ্চাদের খেলার জন্য একটি নির্দিষ্ট প্লে গ্রাউন্ড রাখার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, নিজ সন্তানের প্রতি নজর রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের ভেতরে পরে। তাই বাবা মায়ের উদ্দেশ্যে একটাই মেসেজ থাকবে সন্তানের সঙ্গে মিশুন, তার কথা শুনুন এবং আপনার ব্যক্তিগত কিছু সুখ দুঃখের গল্প বা বিষয় বন্ধুসুলভ আচরণ নিয়ে শিক্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করুন। এতে করে বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের আস্থা ও বিশ্বাস বাড়বে। একইসঙ্গে আপনার সন্তানের যদি ব্যক্তিগত কোনো অভাব, আকাক্সক্ষা, না পাওয়ার বেদনা, ক্ষোভ থাকে সেটাও সে অনায়াসে আপনার সঙ্গে শেয়ার করবে। এতে করে সন্তান বিপথে যাবে না। এক কথায় সন্তান ও বাবা মায়ের মধ্যে কোনো গ্যাপ থাকবে না।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির বলেন, আমার সন্তানের দিকে আমাকেই নজর দিতে হবে। আপনার সন্তানের দিকে আপনার। এটা অনেক আদি সময় থেকেই চলে আসছে। যার যার সন্তান তার তার সম্পদ। কাজেই নিজের ব্যক্তিগত সম্পদকে আমি কিভাবে নিরাপত্তা দেবো সেটা আমার উপর নির্ভর করে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. নাসরীন ওয়াদুদ বলেন, কিশোর সন্তানকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে বাবা মা দু’জনেরই বাচ্চাকে সময় দিতে হবে। তাদের নিয়ে সপ্তাহ অন্তর ঘুরতে যেতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। তারা কি বলতে চায় সেটা মন দিয়ে শুনতে হবে। কোনটা তাদের জন্য ভালো, কোনটা মন্দ সেটা তাদের বুঝাতে হবে, দেখাতে হবে, শিখাতে হবে। কারণ একটা বাচ্চা মানুষ করা সোজা কথা নয়। সত্যি বলতে আমরা নিজেরাই কনফিউজড যে বাচ্চাকে আমরা বুকে জড়িয়ে ধরে মানুষ করবো, নাকি ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে। বর্তমান সময়ে আমরা বাবা মায়েরা এতো বেশি আধুনিক আর ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকি যে বাচ্চাকে প্রপার টাইম দেয়ার মতো যথেষ্ট সময়ই থাকে না। প্রত্যেক বাবা মায়েরই উচিত নিজ নিজ বাচ্চার কাছে একজন মডেলে পরিণত হওয়া। যেন তারা বড় হয়ে বাবা মায়ের মতোই হতে চায়। আর বাচ্চারা যদি কোনো মডেল বা আইডলই না পায় তাহলে তারা বড় হবে কিভাবে, আর স্বপ্নই দেখবে কিভাবে।
সমাজ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইদানিং শিশু কিশোরদের একটা বিশাল অংশ, যারা ছোট্টবেলা থেকেই স্মার্টফোনে আসক্ত। দেড় দুই বছরের বাচ্চা বাবা মায়ের ফোন নিয়ে গেম ডাউনলোড করে খেলছে। বাবা-মা ভীষণ গর্বিত। সেই বাচ্চারা নিজের বাসায় সারাক্ষণ ফোনে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। এমনকি আত্মীয় বন্ধুর বাড়িতে গিয়েও ফোনখানা নিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে খেলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার বদলে বাবা মা কী পায়? পায় নিরবচ্ছিন্ন আড্ডার সুযোগ। সন্তান তাদের বিরক্ত করে না। তার বদলে ভবিষ্যতে বাবা মা এমন একটি ছেলে বা মেয়ে পায় যে প্রযুক্তি ও পণ্য আসক্ত, কল্পনাশক্তিহীন এবং বইপাঠে অনিচ্ছুক। আজ যে স্মার্টফোনটা সে ব্যবহার করে, কাল নতুন ফোনের জন্য তার বায়না খুব স্বাভাবিক। আজ যে বাচ্চাটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করার কোনো কারণ নেই, তারই একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকে ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামে। অথচ যে বয়সে সন্তানের হাতে তুলে দেয়ার কথা রঙবেরঙের বই, রঙিন পেন্সিল, সেই বয়সে তারা তুলে দেন স্মার্টফোন আর ওয়াইফাই কানেকশন। এখানে অসুবিধা একটাই রঙিন বই, খাতা আর রং পেন্সিল দিয়ে বসিয়ে সেগুলো ব্যবহারের সময় সন্তানের পাশে থেকে তাকে সময় দিতে হয়। কিন্তু স্মার্টফোনে তো তা না করলেও চলে। ফলে ফোনটি তার হাতে দিয়ে নিজেদের জগতে চলে যাওয়া খুব সহজ। কিন্তু তারা জানেনও না, কত বড় ক্ষতি তারা সন্তানের করেন।
নাবিল আল নাহিয়ানের বয়স মাত্র চার বছর। পশ্চিম তেজতুড়ি বাজারের এ্যঞ্জেলস হাইস্কুলের নার্সারির শিক্ষার্থী। সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে পথ চলা তার। ছোট্ট নাহিয়ানের পছন্দের খাবার হচ্ছে দুধভাত আর চকোলেট। চকোলেট খাওয়ার আশির্বাদে মুখের দাঁত প্রায় সবগুলোতেই পোকা ধরেছে। বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মা সরকারি কর্মকর্তা। বড় ভাই খুশবু ক্লাস সেভেনে পড়েন। বাবা মা দু’জনেই চাকরিজীবী হওয়াতে প্রায় সময় দুই ভাই খুশবু আর নাহিয়ানকে একা বাসায় থাকতে হয়। খুশবু সবসময়ই একটু লাজুক ও চুপচাপ প্রকৃতির। এদিকে নাহিয়ান পুরোটাই তার বিপরীত মেরুতে অবস্থান। দুষ্টুমি আর চঞ্চলতা যেন তার রক্তে মিশে আছে। সম্প্রতি তার শখ জেগেছে নিজস্ব একটি ফোন ও সিম চাই। সবার ফোন আছে তাদের ফোনে অনেকেই ফোন দেয় কিন্তু নাহিয়ানের ফোনতো নেই এমনকি তাকে কেউ ফোন দেয় না। সরকারি কর্মকর্তা ছোট মামা তুষারকে একদিন কানে কানে বললো মামা আমার একটি ফোন চাই। ভাগনের ছোট্ট এই আবদার রাখতে মামা কিংবা বাবা মা কেউই না করেনি। এখন নাহিয়ানের নিজস্ব একটি ফোন হয়েছে। পরিচিত কেউ কেউ মাঝে মধ্যে তাকে ফোন দিলে সে রিসিভ করে কথা বলে। বাকিটা সময় সে ফোনে গেমস খেলাতেই ব্যস্ত সময় পার করে। ছোট্ট এই বয়সে নাহিয়ানের রয়েছে আলাদা ডেক্সটপ এমনকি ওয়াইফাই সংযোগ। যেটাতে সে মন চাইলেই কার্টুনসহ বিভিন্নভাবে ভার্চুয়াল জগতে ব্যস্ত থাকতে পারে। একটা সময় বিকাল হলেই তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গেলেও আজকাল সে প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকেই বেড় হয় না। হয়তো এমন করে একদিন সে ভুলে যাবে তার প্রিয় খেলার মাঠটিকে। বিকালে মা অফিস থেকে ফিরে হয়তো নাহিয়ানকে যে সময় দেয় সেটা তার জন্য পর্যাপ্ত নয়। রাতে বাবা যখন বাসায় ফিরে তখন হয়তো প্রায় রাতেই ঘুমিয়ে থাকে ছোট্ট নাহিয়ান। নাহিয়ানের মতো অনেক শিশু-কিশোরই বড় হচ্ছে অনেকটা সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষ হিসেবে।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status