মিডিয়া কর্নার

থ্যাক ইউ মিঃ মিটার

৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১:১৫ পূর্বাহ্ন

প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের দেখা বহুল বঠিত গ্রন্থ ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’। ওই বইয়ের ৮ম অধ্যায় থ্যাংক ইউ মিঃ মিটার:

এমন অনেক মানুষ আছেন, যাদের জীবন তাস খেলার পরিম-লের মধ্যে কঠিন রজ্জুতে বাঁধা। শুধু কি তাই। কেউ কেউ জীবনের শেষ মুহূর্তেও তাস হাতে করেই অতিক্রম করেছেন। বেশী দিনের কথা নয়, আমাদের পরিচিত এক প্রাক্তন রাজনীতিক-মন্ত্রী বিখ্যাত এক ক্লাবের টেবিলে তাস হাতে করেই বিদায় নিলেনÑ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। আমরা প্রচার করলাম মেডিক্যাল কলেজে তিনি প্রাণত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ তাসের টেবিলে পরলোগমন খুব একটা গৌরবের কথা নয়। আমাদের ডাক্তার বন্ধু বদরুল আলম (রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী) ছাত্রাবস্থা থেকেই তাস খেলেছেন সারা জীবন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে, প্রায় দু’বছর, তিনি ও আরো দুজন অধ্যাপক-ডাক্তার, বন্ধু মুকুল ও আমি তাঁরই বাসায় তাস খেলছিলাম। এক পর্যায়ে ডাঃ বদরুল আমার পাশেই টেবিল থেকে একটা তাস তুলে নিয়ে স্থির হয়ে বসে রইলেন। নির্বাক কক্ষ। কেউ কেউ অতি বিলম্বের দরুন বিরক্তি প্রকাশ করলেন। কিন্তু ডাঃ মান্নান (তখন তিনি পিজি-র প্রধান) ধরে ফেললেন ব্যাপারটা। তিনি বুঝলেন হার্ট-এ্যাটাক। পাশের শয়ন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। দ্রুত ওষুধ দিয়ে ও চিকিৎসা করে সে যাত্রা তাকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। আমরা অপরাধীর মতো একে একে তাসকক্ষ বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে আসি। আর কোন দিন আমরা ডাঃ বদরুলের সাথে এমন ঝুঁকি নিয়ে তাস খেলতে বসিনি। কিছুদিন পর সেই রোগে আক্রান্ত হয়েই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
তাস খেলতে গিয়েই যে এ জাতীয় ভয়ানক রোগে অনেকে মারা যাচ্ছেন, তা তো নয়। বরং একথাটাই সঠিক হতে পারে যে, অন্য পাঁচটা কাজের মতো যখন তারা তাস খেলছিলেন, তখনই আক্রান্ত হয়েছিলেনÑ রোগটা ছিল পূর্ব থেকেই, তাসে গভীর মনোযোগ আক্রমণ তরান্বিত করে থাকতে পারে। তাস থেকে এমন মর্মান্তিক ঘটনা যেমন একদিকে, তেমনি আবার অগণন মানুষ প্রত্যহ, দিবারাত্রি, অবসর বিনোদন, আনন্দ লাভ বা আর্থিক লাভের জন্যে অনবরত তাস খেলে যাচ্ছেন। অনেকের অফুরন্ত অর্থ ও সময়Ñ কোন সাংস্কৃতিক জীবন হয় তো নেই বা জনকল্যাণকর কোন কাজে নিয়োজিত হতে ইচ্ছুক নন বলেও তারা শেষ পর্যন্ত নির্মল আনন্দ বা অর্থ লাভের আশায় তাস খেলে দিনকে সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যাকে রাত্রি করেন।
রাজধানীতে আমাদের প্রেসক্লাব দীর্ঘস্থায়ী তাস খেলার জন্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে! এককালে এখানে এক পয়সার স্টেকে খেলা হতো। বার্ষিক তের থেকে আঠারো পার্সেন্ট ইনফ্লেশনের যুগে স্বাভাবিকভাবেই স্টেক বেড়েছে। ফলে অনেকে ফতুর হয়ে বিদায় নিয়েছি তাসের টেবিল থেকে। তাস খেলার তীব্র আকর্ষণ এমন শক্তিধর যে, অনেক সময় নিজের অজান্তেই তাসের টেবিলে গিয়ে বসতে হয়। ঢাকার সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত ক্লাবগুলোতে এমন অনেক সদস্য আছেন, যারা স্বগৃহে ফেরার মতো অভ্যাসের নির্দেশে তাসের টেবিলের পাশে এসে বসেন। ঢাকার সম্পাদকদের মধ্যে সালাম ভাইকে দেখেছি (বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবদুস সালাম) তাস খেলার ইচ্ছে হলে তিনি কক্ষে প্রবেশ করে স্থান না পেলে যে কোন টেবিলে যে কোন সদস্যের হাত ধরে খেলা শুরু করতেন। এই ক্লাবের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম জনাব খায়রুল কবীর ষাটের দশকে এক সময় পাকিস্তান ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি পি-ি বা করাচী থেকে এসেই যেন তাসকক্ষে একটি আসন লাভ করতে পারেন, সে জন্যে আমাকে একশ’ টাকা দিয়ে যেতেন খেলতে। অর্থাৎ তাঁর পক্ষ থেকে খেলে যেতে হবে। ঢাকায় এলেই আমার খেলার হাতটা হতো কবীর ভাইয়ের। এ দু’জন সম্পাদক তাস খেলায় নির্মল আনন্দ উপভোগ করতেন। কিন্তু ইত্তেফাক সম্পাদক জনাব তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার তাস খেলার প্রতি ছিল বৈরাগ্য। এমন কি তাস খেলোয়াড়কে শাস্তিও দিয়ে ছেড়েছেন তিনি। তাস খেলার বিপত্তির এক কাহিনী। এক সময় ইত্তেফাকের একজন ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক প্রেসক্লাবে দিবারাত্রি তাস খেলায় মশগুল হয়ে গেলেন। অফিস ও বাসা দু’জায়গাতেই অনিয়ম চলল। এ অবস্থা তো দীর্ঘদিন চলতে পারে না। ক্রমান্বয়ে অর্থশূন্য সেই সাংবাদিক গৃহে সঞ্চিত অলঙ্কার সম্পদে হাত দিলেন। এমনি এক পর্যায়ে তাঁর স্ত্রী খেলা বন্ধ করার শেষ উপায় হিসাবে অভিযোগ করলেন সম্পাদকের কাছে। মানিক ভাই রাগের মাথায় সেই সিনিয়র সাংবাদিককে দিলেন বরখাস্ত করে। সেদিন রাত্রে তাস খেলার পর অফিসে গিয়ে বন্ধু-সাংবাদিক চাকরিমুক্তির খবর পেয়ে স্তম্ভিত। অনেক খড় পোড়াবার পর সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক তাঁর চাকরি ফিরে পেয়েছিলেনÑক্রোধে প্রোজ্বলিত সম্পাদক সাংবাদিকপতœীর উপকার করতে গিয়ে সাংবাদিককে যে বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিলেন, তার ফল সাংবাদিক-পতœীকেও ভোগ করতে হয়েছে। অবশ্য সেই সাংবাদিক সংশোধিত হয়ে ছিলেন। তাসের প্রচ- মোহের তীব্রতা কোন কোন ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে: ফলে এই সংশ্লিষ্ট ঠা-া মেজাজের খ্যাতিমান সাংবাদিকটিও পথভ্রষ্ট হতে চলেছিলেন। (তাস ধ্বংস হয়ে যাবার দৃষ্টান্ত অগণন।)
তাস খেলায় যে সব সময়ই বিপর্যয় তা নয়। সব তাসই যে পয়সা দিয়ে খেলতে হবে বা সব তাসের খেলাই যে পয়সার খেলা, সে কথাও সঠিক নয়। ব্রিজকে সাধারণতঃ বুদ্ধিবৃত্তির খেলা বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। তবে সেখানেও বাজী আছে। কিন্তু বাজী বা স্টেক থাকুক বা না থাকুক অনেকভাবেই তাস খেলাটাকে সময় ক্ষেপণ অথবা আনন্দ লাভের অবলম্বন বলে নেয়া যেতে পারে। আমাদের বন্ধু-সাংবাদিক হাসানুজ্জামান খান তো সঙ্গী না পেলে বা পকেটে টাকা না থাকলে ধৈর্যের খেলা প্যাশেন্স খেলে সারাদিন কাটিয়ে দিতে পারেন। ব্রিজের এই দক্ষ খেলোয়াড় ‘কার্ড ফর সিট’ করে টেবিলের স্থান গ্রহণ করেন এবং একাই খেলতে থাকেন। এ এমন এক খেলা, যেখানে প্রতিপক্ষ দরকার হয় না। গৃহে ঝগড়া হলে, অফিসে কাজ বেশী থাকলে, পকেট শূন্য হলে, এ খেলার জুড়ি নেই এবং হারলে লজ্জা নেই, জিতলে আনন্দলোকে। তাই তিনি কোন একটি টেবিলের কোণে একাই খেলতে খেলতে জিতে হেসে উঠেন।
যে কোন বিজয়ে তৃপ্তি লাভ হয়। তাসেও। কিন্তু বিশেষ না হারলে যেন আনন্দ নেই, যেন সঠিকভাবে নিজের দক্ষতা পরিমাণ করা যায় না। প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ও সুদক্ষ প্রশাসক জনাব শামসুর রহমান, বাঁকে ডক্টর জনসন নামে বন্ধুরা ডাকতে ভালোবাসেন, এক কালে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক ছিলেন। তিনি ঢাকার সরকারী কাজে আসলে প্রেসক্লাবে একবার ঢু দিতেনইÑ তাস খেলতেন। আর যেদিন তিনি আমাদের কাছে হেরে যেতেন, সেদিন তাঁর আনন্দ দ্বিগুণ। এই সংস্কৃতিবান ব্যক্তির কণ্ঠে প্রায়শঃ বুদ্ধিদীপ্ত বাক্য উচ্চারিত হয়ে থাকে। তাসে হেরে তিনি উজ্জ্বল হয়ে উঠতেন। রহস্যটা কোথায়? রাজশাহীতে সাধারণতঃ যাদের সাথে তাঁকে খেলতে হয়, তারা ‘স্যার’কে হারতে দেন নাÑছোট শহরে নিয়ম যেন এটাই। দুঃখ করতে করতে তারা হেরে যান। এ সমস্ত নিয়মিত খেলোয়াড়দের স্যারকে সন্তুষ্ট করার ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পারেন বলেই প্রেসক্লাবে সত্যিকার পরাজয়ে উল্লসিত হয়ে উঠতেন।
সামরিক আইন আমাদের এখন সহ্য করতে কোন বিশেষ অসুবিধে হয় না। ব্যাপারটা সেই পঁচিশ বছর পূর্ব থেকে শুরু হয়েছে কি না। আইয়ুবের মার্শাল ল’ এলো প্রচ- বেগে। এমন একটা অপরিচিত পরিস্থিতির মোকাবিলা তো আমরা এর আগে কারিনি। নির্দেশ এলো পথ ধরোÑ অর্থাৎ রাজনৈতিক দিক থেকে যাঁরা আশ্রয়ের স্থান করে রেখেছেন, তারা ভূতলবাসী হলেন। আমাকেও যেতে হলো গায়েব হয়ে। কিন্তু তাস খেলার জন্যে হাত নিসপিস করতো। ভূতলে বাস করার যাদের চিরন্তন অভ্যাস আছে, তাদের এসব বদ অভ্যাস নেই। পুলিশের তাড়ার মধ্যে মাঝে মাঝে আমি ক্লাবে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়ে তড়িৎগতিতে তাস খেলে উধাও হতাম। বন্ধু মুসা ব্যঙ্গ করে বলতঃ আস্তে কথা বলো, ওতো আন্ডারগ্রাউ-ে! এভাবে আর কতো দিন চলে। ব্যস, এক রাতে আশ্রয় নিতে এসে এই ক্লাবেই পুলিশের হাতে পাকড়াও। যা’ হয়, সোজা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। (যার অংশ বিশেষ শায়েস্তা খাঁর আস্তাবল বলে কথিত।) ছাব্বিশ সেলে আবদ্ধ আওয়ামী লীগের সাারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট এক জরুরি চিঠি লিখেছেনÑ‘আমাকে সেগ্রীগেট করে রাখা হয়েছে, যা জেল-শাস্তির সমতুল্য।’ অর্থাৎ তাঁকে অন্যান্য জেলবাসী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র বিভাগের কোনো নির্দেশ ছিল না তাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার। দ্রুত তদন্ত সেদিনই করা হয়। প্রকৃতপক্ষে দেখা গেল তাঁর সেল এলাকার অন্যান্যদের সেদিন সকালবেলা মুক্তিদান করার ফলে তিনি স্বাভাবিকভাবেই সেখানে একা হয়ে পড়ে ছিলেনÑযা ছিল সেগ্রীগেশনের শামিল। হয় তাঁর সেলে অন্য এলাকা থেকে বন্দী দিতে হবে, নয় তো তাঁকে নিতে হবে অন্যান্যদের মধ্যে।
পরের দিন অন্যান্য সেল ওয়ার্ড এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের এস এম জামিল সহ আমাদের আটজন নিরাপত্তা বন্দীকে নিয়ে যাওয়া হলো ছাব্বিশ সেলে শেখ মুজিবের এলাকায়। তিনি আমাদের সংবর্ধনা জানিয়ে হো হো করে হেসে বললেন: এই দ্যাখ, হাঙ্গার স্ট্রাইকের হুমকি কাকে বলে। আমি একটা লিস্ট করে দিয়ে ছিলাম। কেন, জানিস?
আমরা কিছু বুঝতে পারার আগেই তিনি বললেন: তাস, তাসরে! তাস খেলার জন্যে। তাস খেলতে হবে। কি বলিস?
তাস যে আমরা বেশী দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে খেলতে পেরেছি, তা নয়। কিছু দিনের মধ্যেই আমাদের বিভক্ত করে অন্যান্য জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো, আর আমাদের অনেক পূর্বেই শেখ মুজিব সাময়িক কালের জন্যে মুক্তি লাভ করলেন। কর্মহীন, বই-পুস্তকহীন অবস্থায় সময় ক্ষেপণের প্রয়োজন; সেই তাস থেকে কিন্তু আমাদের মুক্তিলাভ হলো না।
চতুর্দশ শতকে যদি ইউরোপে এই তাস খেলার প্রবর্তন বা উদ্ভাবন না হতো, (কারো কারো মতে ভারতে প্রথম তাস প্রচলিত হয়।) তবে আর সভ্য জগতের বাইরে অধিকারহীন কারাগারে তাস খেলা এতো মূল্যবান বলে গণ্য হবার সুযোগ থাকতো না। শিল্পকলা ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী ফ্রান্স এই তাসের খেলাকে আরো উন্নত করে আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সেই থেকে আমরা হরতন, রুহিতন, চিড়িতন ও ইশকাপনের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে থাকি। একঘেয়েমি থেকে বাঁচার জন্যে কর্তৃপক্ষের কাছে পাশা খেলার ব্যবস্থা করতে প্রস্তাব দিলাম। কিন্তু সেই প্রাচীন মিশরীয়, গ্রীক, রোমানদের পাশা খেলা অথবা মহাভারতের যুগের প্রাচ্য দেশীয় পাশার কোন সন্ধানই নাকি চক বাজারে পাওয়া গেল না। সবচেয়ে বড়ো বাঁধা হলো জেলকোডÑ সেখানে নিরাপত্তা বন্দীদের পাশা খেলার সুযোগ দানের উল্লেখ নেই।
বর্তমান বিশ্বে মানব কল্যাণের প্রয়োজনে পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানী-সমাজসেবীদের আন্দোলন চলছে। এমন কি উন্নত দেশের সরকারগুলো বিরাট বাজেট নিয়ে বড়ো বড়ো দফতরও খুলেছেন। সম্প্রতি পরিবেশ ও আবহাওয়া দূষিত করণের জন্যে প্রধানত দায়ী কে সে বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানের উন্নতি ও মানব জাতির অগ্রগতিকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার জন্যে পাওয়া যাচ্ছে। একজন কার্টুনিস্ট চিত্র মাধ্যমে দেখিয়েছেনÑ ধোঁয়াই পরিবেশ দূষিত করার জন্যে যথেষ্ট এবং এই ধোঁয়ার সূত্রপাত অগ্নি থেকে। সুতরাং আদি মানুষের যিনি সর্ব প্রথম অগ্নি আবিষ্কার করেছেন, তিনিই এই চারশ’ কোটি মানব অধ্যুষিত পৃথিবীর পরিবেশ দূষিত বা বিষাক্ত করার জন্যে মূলতঃ দায়ী। তাকেই তবে বিচারকের সম্মুখে উপস্থিত করা হোক। সেই একই পদ্ধতিতে তাসের ব্যাপারে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে অপরাধী করার কথাও কেউ কেউ ভাবতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে লোকটির নাম আমাদের পক্ষে খুঁজে বের করা কঠিন নয়। যদি কাগজ আবিষ্কৃত না হতো, তবে হয় তো সভ্যতার বিকাশ অন্য পথে হতো; অন্ততঃ কাগজে তৈরি তাসের জন্ম হতো কি না, সন্দেহ। যেহেতু এতো ক্ষতিকর ও সময় ক্ষেপক তাস খেলার আবিষ্কর্তার সঠিক সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না, সেহেতু কাগজের চীনা আবিষ্কারক মিঃ সাই লুনকে পাকড়াও করতে পারি। খৃষ্টের জন্মের একশ পাঁছ বছর পরেই নাকি তিনি চীন দেশে প্রথম কাগজ প্রস্তুত করতে শুরু করেন। এর একশ’ বছর পর জাপানে এবং আড়াইশ’ বছর পর সমরকন্দে কাগজ ব্যবহার আরম্ভ হয়। বিশ্বময় এভাবে যখন হাতে বানানো কাগজের ব্যবহার শুরু হলো, তখন থেকে বিলাসী ধনী, জমিদার ব্যারন, রাজা, সম্রাটদের কক্ষে পাশার সঙ্গে তাসের প্রচলন। অবশ্য এখন এ তাস সবারই।
তাসের জগৎ কেবলমাত্র ধনতান্ত্রিক দেশেই নয়, সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহেও কম বেশী বিস্তৃত। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশে তাস খেলায় বাজী বা স্টেক বা অর্থের প্রলোভন নেই। সেসমস্ত দেশে তাস বা এজাতীয় যে কোন খেলার বুদ্ধিবৃদ্ধির প্রক্রিয়া, প্রতিযোগিতা ও নির্মল আনন্দ উপভোগই প্রধান। বিজয়ের গৌরব আছে, বুদ্ধির বিকাশ আছেÑপরাজয়ের গ্লানি নেই, বুদ্ধির স্থবিরতা নেই। ধনতান্ত্রিক পরিবেশে অনেক ক্ষেত্রেই চারিত্রিক অবনতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এই তাস। তদুপরি বিমল আনন্দ ও আর্থিক লাভের আশায় কতো না বিপর্যয় আসতে পারে এবং কোন কোন সময় লজ্জাজনক পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্তও হতে হয়।
সুদূর অতীত হলেও ভুলে যাবার কথা নয়। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এই ক্লাবেই। পরিবেশটা এমনই ছিল যে, আমরা ক’জন প্রতিদিনই তাস না খেলে পারতাম না। এক ঈদের পূর্ব দিন আমি ‘সংবাদ’ থেকে এবং বন্ধু এম আর আখতার মুকুল ‘ইত্তেফাক’ থেকে বেতন পেয়ে বিকেল বেলা সোজা চলে এলাম প্রেসক্লাবে তাস খেলতে। কথা ছিল সন্ধ্যার পূর্বেই যার যার বাসায় ফিরে যাব। মুকুলের পকেটে ঈদের বাজারের লম্বা একটা লিস্টও ছিল। আমার সেদিনেই চলে যাবার কথা ঢাকার বাইরে। সাত্তার সায়েব আগে থেকেই বসেছিলেন। পরবর্তীকালে ঢাকা বণিক সমিতির দীর্ঘস্থায়ী সভাপতি, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি আব্দুস সাত্তার সায়েব সেসময় সাংবাদিক মহলে একজন বিশেষভাবে সম্পর্কিত ব্যক্তি। ক্লাবে নিয়মিত তাস পেটাতেন। একটু পরেই এলেন মিঃ মিটার ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার ‘গেট-এ-ওয়ার্ড’ খেলার ম্যানেজার মিঃ মিটারের জীবনের বড়ো গৌরবজনক অধ্যায় হচ্ছে, তিনি সুদূর অতীতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীকে (বগুড়া) কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। মোহাম্মদ আলীর বাবার জমিদারীতে তিনি এককালে প্রিয় কর্মকর্তা ছিলেন। সেই গৌরব বহন করেই তিনি দিন কাটাতেন।
এক পর্যায়ে, রাত তখন দশটা। ঈদের বেতনের সমস্ত টাকাই ‘রামী’ খেলায় আমি আর মুকুল হেরে বসে আছি। সে সময় সাত্তার সায়েবের বাসায় ফেরার পারিবারিক প্রয়োজন ছিল না। মিঃ মিটার বিপতœীক, মর্নিং নিউজ বিল্ডিং-এর চিলে কোঠার চিরস্থায়ী বিছানায় ফিরে না গেলে তাঁকে কেউ জিজ্ঞেস করার নেই। আমরা তো কপর্দকশূন্য! আমাদের ঈদের বাজার পকেটের লিস্টে।
সাত্তার সায়েব ও মিঃ মিটার আমাদের বললনÑকাল তো ছুটি, খেলতে খেলতে ভোর হবে। মন্দ কি? আমাদের টাকা তখন তাদের পকেটে। টাকা ওঠাবার তাগিদে সারারাত ভরে আমরা ক্লাবের দোতলার কক্ষে তাস খেলে চললাম। ভোরের আজান শোনা গেল। কাক ডাকছে, রাস্তায় দু’একটা রিকসা বেরুলো। হয়তো খাবার দোকানও খুলছে। ক্রিশ্চিয়ান মিঃ মিটার আমাদের স্মরণ করিয়ে বললেনÑ ভোর হয়েছে, আজ ঈদ।
ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে আমরা রাস্তায় এলাম যার যার বাসায় ফেরার পথে। তাদের টাকা এখন আমাদের পকেটে।
সেকে- গেটের উল্টো দিকে এখনো যে রেস্তোরাঁ-হোটেলগুলো আছে, তারই একটা সবেমাত্র পাট খুলেছে।
ঈদের ভোরে হন হন করে খদ্দের মুকুল ও আমি প্রবেশ করলাম খাদ্যের সন্ধানে। এক জোড়া চেয়ার টেবিল থেকে নামিয়ে বলাম। (এসব রেস্তোঁরায় রাতে টেবিলের উপর চেয়ার সাজানো থাকে।) যেন দোকানটা আমাদেরই অথবা আমাদের জন্যেই এতো ভোরে খোলা হয়েছে। কে একজন ঘুম থেকেই উঠে এসে বলল: কিছুইতো নাই, সায়েব। যা আছে সব বাসী।
: যা আছে তাই একটু গরম করে দিলেই হবে। আর চা। আমাদের মুখমন্ডলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে লোকটা বুঝতে পারলো আমরা বুভুক্ষু। চুল দাঁড়িয়ে আছে, চোখ রক্তাভ, ঠোঁট পাঁশুটে।
যা চেয়ে ছিলাম, তাই আমাদের সম্মুখে। এই ঈদের ভোরে এখন ফিরি কোথায়। মুকুলকে জিজ্ঞেস করলাম: কি করে ঘরে ফিরবি রে, মুকুল?
: কেন, বাজার করে! ঠাঠারী বাজার খুলে গেছে।
দূরে দরজার কাছে এতক্ষণে একজন লোক ক্যাশ নিয়ে বসে গেছে। এক দৃষ্টিতে লোকটা আমাদের দিকে চেয়েছিল।
আমাদের খাদ্য গ্রহণের পালা শেষ। এখন পয়সা দিয়ে রাজপথে নামতে হবে। শরীরে রক্ত সঞ্চালনের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
উঠে দাঁড়িয়ে মুকুলের সাথে করমর্দন করে বললাম: থ্যাংক ইউ মিঃ মিটার।
আমি বসলাম। এবার মুকুল দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করে বলল: থ্যাংক ইউ মিঃ সাত্তার। (যাদের, টাকায় খেলাম তাদের অবর্তমানে এভাবেই আমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলাম।)
দূরে দরজার কাছে উঁচু টুলের উপর বসা লোকটা তখনও আমাদের দিকে চেয়ে সব শুনছে।
আমরা বিব্রত বোধ করলাম।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যাবার সময়ও লোকটা অবাক বিস্ময়ে আমাদের দিকে চেয়ে রইল। নির্বাক। বিস্ময়, না প্রতিবাদ, না ভীতি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
বিব্রত দু’বন্ধু লজ্জায় নত হয়ে রাজপথে পা বাড়ালাম। তাসের সায়েমের মতো আমরা নিরস্ত্র।


[আগামীকাল পডুন বইটির ১০ম অধ্যায়: ‘ইয়ে আফ্ সার তো জানতা’, ৯ম অধ্যায় ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’ ইতোমধ্যে মিডিয়া কর্নার বিভাগে দেয়া হয়েছে।]

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status