মিডিয়া কর্নার
এসো সুপ্তি এসো শান্তি
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১:১৪ পূর্বাহ্ন
প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের দেখা বহুল পঠিত গ্রন্থ ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’। ওই বইয়ের ৬ষ্ঠ অধ্যায় ‘এসো সুপ্তি এসো শান্তি’:
মতিমহল থেকে নানা ধরনের চিড়িয়ার রোস্ট এসে উপস্থিত হলো। বিকেল থেকেই এই নির্দিষ্ট কক্ষে রসিক ব্যক্তিদের তরল কাঞ্চনের উপহার আসতে শুরু করে ছিল। মতিমহল রেস্টুরেন্টটি নয়া ও পুরোন দিল্লীর মাঝামাঝি সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত। সাতান্ন সালের দিকে দেখেছি মতিমহলের চিড়িয়া বা নানা ধরনের পাখির রোস্ট একবার না খেলে যেন কোন পর্যটকের দিল্লী ভ্রমণটাই বৃথা হয়ে যেতো। বর্তমানে আধুনিক দিল্লীর জৌলুসে সেই কুলীন রেস্টুরেন্টের গৌরবে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ভাটা পড়েছে।
উপমহাদেশের ক’জন প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের একান্ত অন্তরঙ্গ বৈঠকের আয়োজন এসব। সতর্কতার সঙ্গে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে যাতে কোন প্রকার ভিড় না হয়। কবিরা চেয়েছিলেন অতীত মন্থন ও বর্তমানকে চুম্বন করতে, তাঁরা চেয়েছিলেন এমন ভাষা প্রয়োগ করতে, এমন শব্দ চয়ন ও রস পরিবেশন করতে, যা কেবল ইয়ার-বন্ধুদের মধ্যেই উচ্চারণ করা অশোভন হবে না। এমন একটা পরিবেশে কি না শব্দ আসতে পারে, কি না রূপকল্পের উজ্জ্বল ব্যবহার হতে পারে।
আমাদের সেন্ট্রাল কোর্ট হোটেলের যে কক্ষটি কবিদের অন্তরঙ্গ আসর বসার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল, তা ছিল একান্তই সাধারণ কক্ষ। কিন্তু সন্ধ্যার পর একে একে যাঁরা এসে উপস্থিত হলেন, তাদের ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয়তা, খ্যাতি ও ঔজ্জ্বল্য ক্ষুদ্র কক্ষটিকে এক মূল্যবান স্থানে পরিণত করল। সবার আগে যিনি উচ্চকণ্ঠে হাসতে হাসতে কক্ষে প্রবেশ করলেন, তিনি তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহের বিপ্লবী কবি মখ্ধুম মহিউদ্দিন। তেলেঙ্গানায় তিনি ছিলেন উপকথার নায়ক। কৃষক বিদ্রোহের অভিযোগে নির্যান ভোগ ও পুলিশের চোখ এড়িয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপন করার ফলে তিনি শারীরিক দিক থেকে দুর্বল ছিলেন। পাকিস্তানের নামকরা কমিউনিস্ট নেতা ও লেখক সাজ্জাদ জহীর ও সৈয়দ জাফরী এলেন বৈঠকে একই গাড়ীতে করে। ভারত ও পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ ঊর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ এসে যোগদান করলেন সবার শেষে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বন্ধু বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক এস জি রয়। এঁরা সবাই হয় কমিউনিস্ট, নয়তো মার্কসবাদী।
রয় এমন একজন সাংবাদিক, যিনি একই সময় বিপরীতধর্মী কয়েকটি পত্রিকা বা এজেন্সীর রিপোর্ট করতে পারতেন। তিনি করাচীর ‘ডন’ পত্রিকার মালিক ইউসুফ হারুন এবং লাহোরের ভিন্নধর্মী দৈনিক ‘পাকিস্তান টাইমস’ পত্রিকার সর্বময় কর্তা মিয়া ইফতেখার উদ্দিনের বন্ধু ছিলেন। ফলে তিনি একই সময়ে পরস্পর বিরোধী ‘ডন’ ও ‘পাকিস্তান টাইমস’ পত্রিকার দিল্লীস্থ সংবাদদাতার কাজ করেছেন বেশ কিছুদিনÑ তাঁর টাইপরাইটার থেকে একই ঘটনার উক্ত দু’টি পত্রিকার উপযোগী দুটি পৃথক রিপোর্ট সহজেই বেরিয়ে আসত। তাছাড়া সে সময় তিনি বিদেশের দু’টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং ইউপিআই-এর (ইউনাইটেড প্রেস অব ইন্ডিয়া) ডাইরেক্টর।
পাকিস্তান টাইমস্-এর প্রধান সম্পাদক ও প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ সেসময় দিল্লীতে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ব্যক্তি; তার পরেই নাম করতে হয় চীনের খ্যাতিমান সাহিত্যিক মাও তুনের কথা। এঁরা সবাই তখন নয়া দিল্লীতে সমবেত হয়েছিলেন প্রথম এশীয় লেখক সম্মেলনে যোগদানের জন্য। চল্লিশজন কবি-সাহিত্যিক নিয়ে গঠিত চীনা প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মাও তুন। আর পাকিস্তান দলের নেতা ছিলেন কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। প্রথম দিকে পাকিস্তানের দু’অঞ্চলে থেকে চৌদ্দজন করে আটাশজন প্রতিনিধি উক্ত সম্মেলনে যোগদানের জন্য মনোনীত হন। পরে উভয় অঞ্চলে থেকেই আরো কিছু সংখ্যক সাহিত্যিক মূল প্রতিনিধি দলে সংযুক্ত হয়েছিলেন। বেগম সুফিয়া কামাল, কবি গোলাম মোস্তফা, আতোয়ার রহমান, আলাউদ্দিন আল-আজাদ, আনিসুজ্জামান, সৈয়দ নুরুদ্দীন, সরদার জয়েন উদ্দিন, আবদুর রাজ্জাক, কাজী দীন মোহাম্মদ, সানাউল্লাহ নূরী প্রমুখ বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে সদস্য ছিলেন। আমিও এই প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি দলভুক্ত কয়েকজন সদস্য শেষ পর্যন্ত সম্মেলনে যোগদান করতে পারেননি।
প্রখ্যাত ভারতীয় সাহিত্যিক ডক্টর মুলুক রাজ আনন্দের প্রাথমিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগেই সাতান্ন সালের শেষ দিকে নয়া দিল্লীতে ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত হয় এই প্রথম এশীয় লেকক সম্মেলন। ভারত সরকারের সহযোগিতায় ভারতীয় জাতীয় কমিটির ব্যবস্থাপনায় (যার সভাপতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সাহিত্যিক হুমায়ুন কবির ও সম্পাদক মুলক রাজ আনন্দ) এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এশিয়ার দেশগুলো ছাড়াও সোভিয়েট রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ এই সম্মেলনে সৌভাত্বমূলক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিল।
আমার একান্ত বন্ধু প্রতিনিধি দলের সদস্য সানাউল্লাহ নূরী, যিনি বর্তমানে ‘দৈনিক দেশে’র সম্পাদক, সম্মেল উদ্বোধনের পরের দিন দিল্লীতে পৌঁছায়। বন্ধু একা নয়, সঙ্গে এক স্মার্ট তরুণী, রওশন আরা। সরাসরি সম্মেলন ভবনে এসে উপস্থিত। এই লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘বিজ্ঞান ভবনে’, কিছু দিন পূর্বেই ভবনটি উদ্বোধন করা হয় এবং সম্ভবতঃ ভবনটিতে এই প্রথম একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো।
আটচল্লিশ সালের (মার্চ) প্রথম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বন্ধু নূরীর অবদান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের অন্যতম নেতা ছিল সে। বাংলা ভাষা সমর্থনের জন্যে তাকে মুসলিম লীগ পা-াদের হাতে দল বেঁধে মার খেতে হয়েছিল। রায়সায়েব বাজার এলাকাটা ছিল শত্রুপক্ষের দখলে। ইসলামীয়া হোটেল এলাকা প্রধানত ছিল আক্রমণকারীদের আড্ডাস্থল। আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে প্রতিবাদী হয়ে ওঠার পর থেকে উক্ত কলেজের ছাত্ররা বেশ কিছু দিন রায়সায়েবের বাজার এলাকায় আসতে পারতো না। নির্ঘাৎ আক্রমণ। তবুও একদিন নূরী কারো কথা শুনলো না। আরো ক’জনকে নিয়ে ওই পথেই যাত্রা করল ভাষা সংক্রান্ত সভায় যোগদান করতে। পাঞ্জাবী, পাজামা, চাদর এবং তার উপর টুপি লাগিয়ে বন্ধুটি ভাবল যে, যথেষ্ট ছদ্মবেশ ধারণ করা গেছে। শত্রুপক্ষ চিনতেই পারবে না। হন হন করে সে যাত্রা করল রায়সায়েবের বাজার দিয়ে।
আর যায় কোথায়। ওই টুপি আর চাদর দিয়ে কি আর মুসল্লী সেজে লীগ পাণ্ডাদের ফাঁকি দেয়া যাবে। রে রে করে আক্রমণ আর পিছু তাড়া। মার যাই পড়ুক, কিন্তু ধরতে পারেনি। নবাবপুরের মধ্য দিয়ে দৌড়ে তারা প্রাণ নিয়ে উপস্থিত হল ‘মানসী’ সিনেমা (বর্তমানে ‘সংবাদ’ পত্রিকার বিপরীত দিকে) হলের কাছে। ক’দিন পরে বাংলা ভাষা বিরোধীরা রায়সায়েব বাজার অঞ্চল থেকে জগন্নাথ কলেজে আন্দোলন সমর্থকদের উপর আক্রমণ করেছিল। সে সময়ও বন্ধু নুরী প্রতিরোধের প্রতি আক্রমণে এগিয়ে গিয়ে বিপদে পড়ে।
সেই বন্ধু সানাউল্লাহ নুরী সম্মেলনে উপস্থিত; আমরা তখন যার যার দেশের সারিতে বসে বক্তৃতা শুনছি। খবর এলো নতুন প্রতিনিধি এসেছেন, আমাকে পাঠানো হলো বাইরে লবীতে। বন্ধু নূরী দাঁড়িয়ে, সঙ্গে রওশন আরা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্র ‘মাটির পাহাড়’-এ রওশন আরা একজন অভিনেত্রী। পরবর্তীকালে দু’একটি ছবিতে নেমেই তিনি সেল্যুলয়েডের জগত থেকে উধাও হয়েছেন। মিটফোর্ড-এ ডাক্তার হবার জন্যে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। সাহসিনী রওশন আরা বিদেশ ভ্রমণের অদম্য আগ্রহে দিল্লী আসার সুযোগ ছাড়েননি। বন্ধু সাংবাদিক নূরী তার খালাতো ভাই ও শুভাকাঙ্খী; নূরী ও অন্যান্যদের সঙ্গে কোলকাতা থেকে দিল্লী পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথে রেল ভ্রমণ তার কাছে ক্লান্তিদায়ক না হয়ে সুখকরই হয়েছিল।
লবীর এক কোণে নূরীকে নিয়ে বললাম: তোর জন্যে তো কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু ডবল বিপদ তো কাঁধে করে নিয়ে এসেছিল।
‘ঠিকই বলেছিস। ভারি ডেয়ারিং, আসবেই। ছাড়ল না ও। সেই ঢাকা থেকে দিল্লী!’
‘প্রতিনিধিও নয়, তার উপর মহিলা। দাঁড়া, দলনেতা ফয়েজ ভাই-এর সঙ্গে কথা বলে আসি। তাঁর কিন্তু মেয়ে-মহিলাদের প্রতি সম্মান বোধ অসীম।’
রওশনকে বললা: এভাবে না হলে দেশ ভ্রমণ হয় না, ভালই করেছেন। তিনি উদাসীন। এমনভাবে হাসলেন যে, একটা কিছু হবেই।
প্রতিনিধি দলের নেতা বললেন ‘মেয়েটি কি লেখিকা? তোমাদের কোন কিছু হয় কি?’
‘তেমন নয়। দু’একটা কাগজে লেখে হয়তো। একটু ডেয়ারিং।’
‘তাই হবে। একটা ব্যবস্থা করতে হয়।’
‘দল নেতাদের টেকনিক্যাল স্টাফ থাকে। আপনার তো কেউ নেই। ওর নামটা বসিয়ে কি?’
ফয়েজ ভাই হেসে বললেন ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটা করা যায়।’
নূরীকে এসে বললাম, ‘পথ হয়েছে রে। এখন কেবল নামটা রেজিষ্ট্রী করা। ব্যাস, থাকা, হোটেল, খাদ্য, গাড়ি, সবই মিলবে।’
সম্মেলনের সচিবালয়ে গেলাম পাকিস্তান ডেস্কে। সেখানে এক জবরদস্ত মহিলা মিসেস্ প-িত। দু’দেশের বাঙালীদের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি ফয়েজ সায়েবের নাম শুনেই রওশন আরার নাম টেকনিক্যাল স্টাফভুক্ত করে বললেন, ‘ওকে হোটেলে পাঠিয়ে দিতে পারেন।’
পরদিন থেকে রওশন আরা মূল সম্মেলনে দলনেতার পেছনের আসনে প্রতিনিধি দলের সঙ্গেই বসতে শুধু করলেন।
সেদিন রাতেই এই কবিতা সন্ধ্যার আয়োজন। সাংবাদিক এস জি রয়ই এর প্রধান উদ্যোক্তা। অর্ধ ডজন কবি-সাহিত্যিক ছাড়া শ্রোতা কেউ ছিল না বললেই চলেÑ কেবলমাত্র বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের সৈয়দ নুরুদ্দীন, এ এল খাতিন (মর্নিং নিউজ) ও আমি ছাড়া। প্রধানতঃ তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা ও পাঠই ছিল এই সন্ধ্যার মূল আকর্ষণ ও বৈশিষ্ট্য। রাত যতো গভীর হতে আরম্ভ করল, ততোই পরস্পরের কবিতার তারিফে (উর্দু মোশায়েরার আধুনিক ও উচ্চাঙ্গ প্রকাশ) কক্ষটি মুখরিত হয়ে উঠতে লাগল। এমন সময় কিছুক্ষণের জন্যে এলেন মুলক রাজ আনন্দ। তাঁর উপস্থিতি উপলক্ষ্য করে সাংবাদিক রয় (যাঁকে শ্যামদা বরেই আমরা এখনো সমব্ধেন করি) প্রস্তাব করলেন: আজকের এই মহান কবিদের আসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উপস্থিত থাকতে হবে; তাঁকে ছাড়া তো কোন কবিতার আসরই হতে পারে না। (আসরে ভাষা ছিল তিনটিÑহিন্দী, উর্দু ও ইংরেজী) ঠাকুরভক্ত রয়ের প্রস্তাব শুনে সবাই ‘ট্যাগোর ট্যাগোর’ করে উঠলেন। মনে হচ্ছিল রবি ঠাকুরের কথাটা এতোক্ষণ ভুলে গিয়ে তাঁরা মস্ত অপরাধই করে ফেলেছিলেন।
এখন রবি ঠাকুরের বই পাওয়া যাবে কোত্থেকে? কিন্তু দেখা গেল রয় অনেক প্রখ্যাত কবিরই কবিতাগ্রন্থ এনে টেবিলের এক কোণে পূর্বেই রেখেছিলেন। সেখানেই ছিল ‘সঞ্চরিতা’। কে মূল থেকে আবৃত্তি করবেন আর অনুবাদ করবেন কে? দু’বাঙালী সাংবাদিক দাঁড়ালেন। ঢাকার ‘সংবাদ’ পত্রিকার নিউজ এডিটর সৈয়দ নুরুদ্দীন উজ্জ্বল হাসিতে ম-িত হয়ে বললেন। আমি, আমি আবৃত্তি করব ‘মানস সুন্দরী’। দিল্লীর বাঙালী সাংবাদিক রয়ের নাটকীয় উক্তি: এই হীরক খচিত রজনীতে ‘মানস সুন্দরী’ ছাড়া আর কি রবীন্দ্র-উপহার হতে পারে? ফয়েজ, তাই নয় কি? মখ্দুম, তাই নয় কি? সবাই বলে উঠলেন: আজকের রাতটা রবি ঠাকুরের ‘মানস সুন্দরী’কে নিয়েই কাটাতে চাই।
কবি-বৈঠকের অন্যতম শ্রোতা মারাঠী সন্তান এ, এল খাতিব উপমহাদেশের সাতটি ভাষার সাথে পরিচিত। তিনি ইংরেজীতে কবিতা লিখেন, ইতিমধ্যেই বিশিষ্ট কবিদের আপনজন। বোম্বে, সিংহল, করাচী ও ঢাকায় তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। ঢাকায় প্রেসক্লাবের একটি ক্ষুদ্র কক্ষে পুস্তক ও পত্রিকার ভীড়ের মধ্যে বাস করতেন তিনি। বাংলার প্রকৃতি, সংস্কৃতি, মানুষ ও প্রগতি-চেতনার সাথে তিনি সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ অঞ্চলটা যেন তাঁর আর এক মাতৃভূমি। স্বল্পভাষী খাতিব ভাই হালকা সুরে বললেন, ‘ঠাকুর তাঁর সুন্দরীকে নিয়ে আসছেন কি?’
সবাই আবার হেসে উঠলেন, নির্মল আনন্দে।
রয়: নুরুদ্দীন তোমাকে ধন্যবাদ। আমি তোমার পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজীতে পাশাপাশি অনুবাদ করে যাবো।
উপস্থিত কবি-সাহিত্যিকণ জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে রবি ঠাকুরের প্রচুর বিখ্যাত কবিতা অনুবাদের মাধ্যমে পাঠ করেছেন। তাঁদের আগ্রহ থেকে একথা স্পষ্ট যে, মানস সুন্দরী তাঁদের একটি প্রিয় কবিতা। কবিগণ সুধা পানের ফাঁকে ফাঁকে দীর্ঘ সময়ব্যাপী স্ব স্ব তাৎক্ষণিক কবিতা আবৃত্তি করেছেন, অতীত মন্থন করে যৌবনের পুষ্পিত কাননে পদচারণ করতে করতে নিজেদের উদ্দীপ্ত করে তুলেছেন। তরল কাঞ্চন আর সিগারেটের ধোয়ায় তাঁরা করেছেন অবগাহন।
সৈয়দ নুরুদ্দীন, তখন আমার নিউজ এডিটর, উঠে দাঁড়ালেন বৃহৎ সঞ্চয়িতা হাতে। ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে এগার পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ ‘মানস সুন্দরী’ পাঠ শুরু করলেন তিনি। তাঁরই পাশাপাশি ইংরেজীতে একই গতিতে অনুবাদ করে চলেছেন বিশালদেহী সাংবাদিক রয়। রাত বারোটার পরে নিশুদ্ধ নগরীর সুউচ্চ এক প্রাচীন হোটেল কক্ষে মন্ত্রের মতো উচ্চারণে আবৃত্তি করে চললেন সৈয়দ নুরুদ্দীন। প্রচ- উচ্ছ্বাসের মধ্যে তাঁর আবৃত্তি শেষ হল যখন, প্রায় একই সঙ্গে ইংরেজী অনুবাদ শেষ করলেন রয়।
কিন্তু তবুও নুরুদ্দীন ভাই-এর পরিপূর্ণ কণ্ঠে মন্ত্রের মতো উচ্চারিত পঙক্তিগুলো তখনো আমাদের স্তব্ধ করে রেখেছিল:
শুধু এই নিদ্রাপূর্ণ নিশীথের কূলে
অন্তরের অন্তহীন অশ্রু পারাবার
উদ্বেলিয়া উঠিয়াছে হৃদয়ে আমার
গম্ভীর নিস্বনে।।
এসো সুপ্তি, এসো শান্তি,
এসো প্রিয়ে, মুগ্ধ মৌন সকরুণ কান্তি,
বক্ষে মোরে লহো টানি; শোয়াও যতনে
মরণসুস্নিগ্ধ শুভ্রতিশয়নে॥
[আগামীকাল পড়ুন বইটির ৭ম অধ্যায় ‘ডীয়ার ডীয়ার এন্ড ডীয়ার ’।]
মতিমহল থেকে নানা ধরনের চিড়িয়ার রোস্ট এসে উপস্থিত হলো। বিকেল থেকেই এই নির্দিষ্ট কক্ষে রসিক ব্যক্তিদের তরল কাঞ্চনের উপহার আসতে শুরু করে ছিল। মতিমহল রেস্টুরেন্টটি নয়া ও পুরোন দিল্লীর মাঝামাঝি সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত। সাতান্ন সালের দিকে দেখেছি মতিমহলের চিড়িয়া বা নানা ধরনের পাখির রোস্ট একবার না খেলে যেন কোন পর্যটকের দিল্লী ভ্রমণটাই বৃথা হয়ে যেতো। বর্তমানে আধুনিক দিল্লীর জৌলুসে সেই কুলীন রেস্টুরেন্টের গৌরবে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ভাটা পড়েছে।
উপমহাদেশের ক’জন প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের একান্ত অন্তরঙ্গ বৈঠকের আয়োজন এসব। সতর্কতার সঙ্গে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে যাতে কোন প্রকার ভিড় না হয়। কবিরা চেয়েছিলেন অতীত মন্থন ও বর্তমানকে চুম্বন করতে, তাঁরা চেয়েছিলেন এমন ভাষা প্রয়োগ করতে, এমন শব্দ চয়ন ও রস পরিবেশন করতে, যা কেবল ইয়ার-বন্ধুদের মধ্যেই উচ্চারণ করা অশোভন হবে না। এমন একটা পরিবেশে কি না শব্দ আসতে পারে, কি না রূপকল্পের উজ্জ্বল ব্যবহার হতে পারে।
আমাদের সেন্ট্রাল কোর্ট হোটেলের যে কক্ষটি কবিদের অন্তরঙ্গ আসর বসার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল, তা ছিল একান্তই সাধারণ কক্ষ। কিন্তু সন্ধ্যার পর একে একে যাঁরা এসে উপস্থিত হলেন, তাদের ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয়তা, খ্যাতি ও ঔজ্জ্বল্য ক্ষুদ্র কক্ষটিকে এক মূল্যবান স্থানে পরিণত করল। সবার আগে যিনি উচ্চকণ্ঠে হাসতে হাসতে কক্ষে প্রবেশ করলেন, তিনি তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহের বিপ্লবী কবি মখ্ধুম মহিউদ্দিন। তেলেঙ্গানায় তিনি ছিলেন উপকথার নায়ক। কৃষক বিদ্রোহের অভিযোগে নির্যান ভোগ ও পুলিশের চোখ এড়িয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপন করার ফলে তিনি শারীরিক দিক থেকে দুর্বল ছিলেন। পাকিস্তানের নামকরা কমিউনিস্ট নেতা ও লেখক সাজ্জাদ জহীর ও সৈয়দ জাফরী এলেন বৈঠকে একই গাড়ীতে করে। ভারত ও পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ ঊর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ এসে যোগদান করলেন সবার শেষে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বন্ধু বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক এস জি রয়। এঁরা সবাই হয় কমিউনিস্ট, নয়তো মার্কসবাদী।
রয় এমন একজন সাংবাদিক, যিনি একই সময় বিপরীতধর্মী কয়েকটি পত্রিকা বা এজেন্সীর রিপোর্ট করতে পারতেন। তিনি করাচীর ‘ডন’ পত্রিকার মালিক ইউসুফ হারুন এবং লাহোরের ভিন্নধর্মী দৈনিক ‘পাকিস্তান টাইমস’ পত্রিকার সর্বময় কর্তা মিয়া ইফতেখার উদ্দিনের বন্ধু ছিলেন। ফলে তিনি একই সময়ে পরস্পর বিরোধী ‘ডন’ ও ‘পাকিস্তান টাইমস’ পত্রিকার দিল্লীস্থ সংবাদদাতার কাজ করেছেন বেশ কিছুদিনÑ তাঁর টাইপরাইটার থেকে একই ঘটনার উক্ত দু’টি পত্রিকার উপযোগী দুটি পৃথক রিপোর্ট সহজেই বেরিয়ে আসত। তাছাড়া সে সময় তিনি বিদেশের দু’টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং ইউপিআই-এর (ইউনাইটেড প্রেস অব ইন্ডিয়া) ডাইরেক্টর।
পাকিস্তান টাইমস্-এর প্রধান সম্পাদক ও প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ সেসময় দিল্লীতে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ব্যক্তি; তার পরেই নাম করতে হয় চীনের খ্যাতিমান সাহিত্যিক মাও তুনের কথা। এঁরা সবাই তখন নয়া দিল্লীতে সমবেত হয়েছিলেন প্রথম এশীয় লেখক সম্মেলনে যোগদানের জন্য। চল্লিশজন কবি-সাহিত্যিক নিয়ে গঠিত চীনা প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মাও তুন। আর পাকিস্তান দলের নেতা ছিলেন কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। প্রথম দিকে পাকিস্তানের দু’অঞ্চলে থেকে চৌদ্দজন করে আটাশজন প্রতিনিধি উক্ত সম্মেলনে যোগদানের জন্য মনোনীত হন। পরে উভয় অঞ্চলে থেকেই আরো কিছু সংখ্যক সাহিত্যিক মূল প্রতিনিধি দলে সংযুক্ত হয়েছিলেন। বেগম সুফিয়া কামাল, কবি গোলাম মোস্তফা, আতোয়ার রহমান, আলাউদ্দিন আল-আজাদ, আনিসুজ্জামান, সৈয়দ নুরুদ্দীন, সরদার জয়েন উদ্দিন, আবদুর রাজ্জাক, কাজী দীন মোহাম্মদ, সানাউল্লাহ নূরী প্রমুখ বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে সদস্য ছিলেন। আমিও এই প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি দলভুক্ত কয়েকজন সদস্য শেষ পর্যন্ত সম্মেলনে যোগদান করতে পারেননি।
প্রখ্যাত ভারতীয় সাহিত্যিক ডক্টর মুলুক রাজ আনন্দের প্রাথমিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগেই সাতান্ন সালের শেষ দিকে নয়া দিল্লীতে ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত হয় এই প্রথম এশীয় লেকক সম্মেলন। ভারত সরকারের সহযোগিতায় ভারতীয় জাতীয় কমিটির ব্যবস্থাপনায় (যার সভাপতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সাহিত্যিক হুমায়ুন কবির ও সম্পাদক মুলক রাজ আনন্দ) এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এশিয়ার দেশগুলো ছাড়াও সোভিয়েট রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ এই সম্মেলনে সৌভাত্বমূলক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিল।
আমার একান্ত বন্ধু প্রতিনিধি দলের সদস্য সানাউল্লাহ নূরী, যিনি বর্তমানে ‘দৈনিক দেশে’র সম্পাদক, সম্মেল উদ্বোধনের পরের দিন দিল্লীতে পৌঁছায়। বন্ধু একা নয়, সঙ্গে এক স্মার্ট তরুণী, রওশন আরা। সরাসরি সম্মেলন ভবনে এসে উপস্থিত। এই লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘বিজ্ঞান ভবনে’, কিছু দিন পূর্বেই ভবনটি উদ্বোধন করা হয় এবং সম্ভবতঃ ভবনটিতে এই প্রথম একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো।
আটচল্লিশ সালের (মার্চ) প্রথম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বন্ধু নূরীর অবদান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের অন্যতম নেতা ছিল সে। বাংলা ভাষা সমর্থনের জন্যে তাকে মুসলিম লীগ পা-াদের হাতে দল বেঁধে মার খেতে হয়েছিল। রায়সায়েব বাজার এলাকাটা ছিল শত্রুপক্ষের দখলে। ইসলামীয়া হোটেল এলাকা প্রধানত ছিল আক্রমণকারীদের আড্ডাস্থল। আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে প্রতিবাদী হয়ে ওঠার পর থেকে উক্ত কলেজের ছাত্ররা বেশ কিছু দিন রায়সায়েবের বাজার এলাকায় আসতে পারতো না। নির্ঘাৎ আক্রমণ। তবুও একদিন নূরী কারো কথা শুনলো না। আরো ক’জনকে নিয়ে ওই পথেই যাত্রা করল ভাষা সংক্রান্ত সভায় যোগদান করতে। পাঞ্জাবী, পাজামা, চাদর এবং তার উপর টুপি লাগিয়ে বন্ধুটি ভাবল যে, যথেষ্ট ছদ্মবেশ ধারণ করা গেছে। শত্রুপক্ষ চিনতেই পারবে না। হন হন করে সে যাত্রা করল রায়সায়েবের বাজার দিয়ে।
আর যায় কোথায়। ওই টুপি আর চাদর দিয়ে কি আর মুসল্লী সেজে লীগ পাণ্ডাদের ফাঁকি দেয়া যাবে। রে রে করে আক্রমণ আর পিছু তাড়া। মার যাই পড়ুক, কিন্তু ধরতে পারেনি। নবাবপুরের মধ্য দিয়ে দৌড়ে তারা প্রাণ নিয়ে উপস্থিত হল ‘মানসী’ সিনেমা (বর্তমানে ‘সংবাদ’ পত্রিকার বিপরীত দিকে) হলের কাছে। ক’দিন পরে বাংলা ভাষা বিরোধীরা রায়সায়েব বাজার অঞ্চল থেকে জগন্নাথ কলেজে আন্দোলন সমর্থকদের উপর আক্রমণ করেছিল। সে সময়ও বন্ধু নুরী প্রতিরোধের প্রতি আক্রমণে এগিয়ে গিয়ে বিপদে পড়ে।
সেই বন্ধু সানাউল্লাহ নুরী সম্মেলনে উপস্থিত; আমরা তখন যার যার দেশের সারিতে বসে বক্তৃতা শুনছি। খবর এলো নতুন প্রতিনিধি এসেছেন, আমাকে পাঠানো হলো বাইরে লবীতে। বন্ধু নূরী দাঁড়িয়ে, সঙ্গে রওশন আরা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্র ‘মাটির পাহাড়’-এ রওশন আরা একজন অভিনেত্রী। পরবর্তীকালে দু’একটি ছবিতে নেমেই তিনি সেল্যুলয়েডের জগত থেকে উধাও হয়েছেন। মিটফোর্ড-এ ডাক্তার হবার জন্যে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। সাহসিনী রওশন আরা বিদেশ ভ্রমণের অদম্য আগ্রহে দিল্লী আসার সুযোগ ছাড়েননি। বন্ধু সাংবাদিক নূরী তার খালাতো ভাই ও শুভাকাঙ্খী; নূরী ও অন্যান্যদের সঙ্গে কোলকাতা থেকে দিল্লী পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথে রেল ভ্রমণ তার কাছে ক্লান্তিদায়ক না হয়ে সুখকরই হয়েছিল।
লবীর এক কোণে নূরীকে নিয়ে বললাম: তোর জন্যে তো কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু ডবল বিপদ তো কাঁধে করে নিয়ে এসেছিল।
‘ঠিকই বলেছিস। ভারি ডেয়ারিং, আসবেই। ছাড়ল না ও। সেই ঢাকা থেকে দিল্লী!’
‘প্রতিনিধিও নয়, তার উপর মহিলা। দাঁড়া, দলনেতা ফয়েজ ভাই-এর সঙ্গে কথা বলে আসি। তাঁর কিন্তু মেয়ে-মহিলাদের প্রতি সম্মান বোধ অসীম।’
রওশনকে বললা: এভাবে না হলে দেশ ভ্রমণ হয় না, ভালই করেছেন। তিনি উদাসীন। এমনভাবে হাসলেন যে, একটা কিছু হবেই।
প্রতিনিধি দলের নেতা বললেন ‘মেয়েটি কি লেখিকা? তোমাদের কোন কিছু হয় কি?’
‘তেমন নয়। দু’একটা কাগজে লেখে হয়তো। একটু ডেয়ারিং।’
‘তাই হবে। একটা ব্যবস্থা করতে হয়।’
‘দল নেতাদের টেকনিক্যাল স্টাফ থাকে। আপনার তো কেউ নেই। ওর নামটা বসিয়ে কি?’
ফয়েজ ভাই হেসে বললেন ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটা করা যায়।’
নূরীকে এসে বললাম, ‘পথ হয়েছে রে। এখন কেবল নামটা রেজিষ্ট্রী করা। ব্যাস, থাকা, হোটেল, খাদ্য, গাড়ি, সবই মিলবে।’
সম্মেলনের সচিবালয়ে গেলাম পাকিস্তান ডেস্কে। সেখানে এক জবরদস্ত মহিলা মিসেস্ প-িত। দু’দেশের বাঙালীদের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি ফয়েজ সায়েবের নাম শুনেই রওশন আরার নাম টেকনিক্যাল স্টাফভুক্ত করে বললেন, ‘ওকে হোটেলে পাঠিয়ে দিতে পারেন।’
পরদিন থেকে রওশন আরা মূল সম্মেলনে দলনেতার পেছনের আসনে প্রতিনিধি দলের সঙ্গেই বসতে শুধু করলেন।
সেদিন রাতেই এই কবিতা সন্ধ্যার আয়োজন। সাংবাদিক এস জি রয়ই এর প্রধান উদ্যোক্তা। অর্ধ ডজন কবি-সাহিত্যিক ছাড়া শ্রোতা কেউ ছিল না বললেই চলেÑ কেবলমাত্র বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের সৈয়দ নুরুদ্দীন, এ এল খাতিন (মর্নিং নিউজ) ও আমি ছাড়া। প্রধানতঃ তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা ও পাঠই ছিল এই সন্ধ্যার মূল আকর্ষণ ও বৈশিষ্ট্য। রাত যতো গভীর হতে আরম্ভ করল, ততোই পরস্পরের কবিতার তারিফে (উর্দু মোশায়েরার আধুনিক ও উচ্চাঙ্গ প্রকাশ) কক্ষটি মুখরিত হয়ে উঠতে লাগল। এমন সময় কিছুক্ষণের জন্যে এলেন মুলক রাজ আনন্দ। তাঁর উপস্থিতি উপলক্ষ্য করে সাংবাদিক রয় (যাঁকে শ্যামদা বরেই আমরা এখনো সমব্ধেন করি) প্রস্তাব করলেন: আজকের এই মহান কবিদের আসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উপস্থিত থাকতে হবে; তাঁকে ছাড়া তো কোন কবিতার আসরই হতে পারে না। (আসরে ভাষা ছিল তিনটিÑহিন্দী, উর্দু ও ইংরেজী) ঠাকুরভক্ত রয়ের প্রস্তাব শুনে সবাই ‘ট্যাগোর ট্যাগোর’ করে উঠলেন। মনে হচ্ছিল রবি ঠাকুরের কথাটা এতোক্ষণ ভুলে গিয়ে তাঁরা মস্ত অপরাধই করে ফেলেছিলেন।
এখন রবি ঠাকুরের বই পাওয়া যাবে কোত্থেকে? কিন্তু দেখা গেল রয় অনেক প্রখ্যাত কবিরই কবিতাগ্রন্থ এনে টেবিলের এক কোণে পূর্বেই রেখেছিলেন। সেখানেই ছিল ‘সঞ্চরিতা’। কে মূল থেকে আবৃত্তি করবেন আর অনুবাদ করবেন কে? দু’বাঙালী সাংবাদিক দাঁড়ালেন। ঢাকার ‘সংবাদ’ পত্রিকার নিউজ এডিটর সৈয়দ নুরুদ্দীন উজ্জ্বল হাসিতে ম-িত হয়ে বললেন। আমি, আমি আবৃত্তি করব ‘মানস সুন্দরী’। দিল্লীর বাঙালী সাংবাদিক রয়ের নাটকীয় উক্তি: এই হীরক খচিত রজনীতে ‘মানস সুন্দরী’ ছাড়া আর কি রবীন্দ্র-উপহার হতে পারে? ফয়েজ, তাই নয় কি? মখ্দুম, তাই নয় কি? সবাই বলে উঠলেন: আজকের রাতটা রবি ঠাকুরের ‘মানস সুন্দরী’কে নিয়েই কাটাতে চাই।
কবি-বৈঠকের অন্যতম শ্রোতা মারাঠী সন্তান এ, এল খাতিব উপমহাদেশের সাতটি ভাষার সাথে পরিচিত। তিনি ইংরেজীতে কবিতা লিখেন, ইতিমধ্যেই বিশিষ্ট কবিদের আপনজন। বোম্বে, সিংহল, করাচী ও ঢাকায় তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। ঢাকায় প্রেসক্লাবের একটি ক্ষুদ্র কক্ষে পুস্তক ও পত্রিকার ভীড়ের মধ্যে বাস করতেন তিনি। বাংলার প্রকৃতি, সংস্কৃতি, মানুষ ও প্রগতি-চেতনার সাথে তিনি সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ অঞ্চলটা যেন তাঁর আর এক মাতৃভূমি। স্বল্পভাষী খাতিব ভাই হালকা সুরে বললেন, ‘ঠাকুর তাঁর সুন্দরীকে নিয়ে আসছেন কি?’
সবাই আবার হেসে উঠলেন, নির্মল আনন্দে।
রয়: নুরুদ্দীন তোমাকে ধন্যবাদ। আমি তোমার পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজীতে পাশাপাশি অনুবাদ করে যাবো।
উপস্থিত কবি-সাহিত্যিকণ জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে রবি ঠাকুরের প্রচুর বিখ্যাত কবিতা অনুবাদের মাধ্যমে পাঠ করেছেন। তাঁদের আগ্রহ থেকে একথা স্পষ্ট যে, মানস সুন্দরী তাঁদের একটি প্রিয় কবিতা। কবিগণ সুধা পানের ফাঁকে ফাঁকে দীর্ঘ সময়ব্যাপী স্ব স্ব তাৎক্ষণিক কবিতা আবৃত্তি করেছেন, অতীত মন্থন করে যৌবনের পুষ্পিত কাননে পদচারণ করতে করতে নিজেদের উদ্দীপ্ত করে তুলেছেন। তরল কাঞ্চন আর সিগারেটের ধোয়ায় তাঁরা করেছেন অবগাহন।
সৈয়দ নুরুদ্দীন, তখন আমার নিউজ এডিটর, উঠে দাঁড়ালেন বৃহৎ সঞ্চয়িতা হাতে। ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে এগার পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ ‘মানস সুন্দরী’ পাঠ শুরু করলেন তিনি। তাঁরই পাশাপাশি ইংরেজীতে একই গতিতে অনুবাদ করে চলেছেন বিশালদেহী সাংবাদিক রয়। রাত বারোটার পরে নিশুদ্ধ নগরীর সুউচ্চ এক প্রাচীন হোটেল কক্ষে মন্ত্রের মতো উচ্চারণে আবৃত্তি করে চললেন সৈয়দ নুরুদ্দীন। প্রচ- উচ্ছ্বাসের মধ্যে তাঁর আবৃত্তি শেষ হল যখন, প্রায় একই সঙ্গে ইংরেজী অনুবাদ শেষ করলেন রয়।
কিন্তু তবুও নুরুদ্দীন ভাই-এর পরিপূর্ণ কণ্ঠে মন্ত্রের মতো উচ্চারিত পঙক্তিগুলো তখনো আমাদের স্তব্ধ করে রেখেছিল:
শুধু এই নিদ্রাপূর্ণ নিশীথের কূলে
অন্তরের অন্তহীন অশ্রু পারাবার
উদ্বেলিয়া উঠিয়াছে হৃদয়ে আমার
গম্ভীর নিস্বনে।।
এসো সুপ্তি, এসো শান্তি,
এসো প্রিয়ে, মুগ্ধ মৌন সকরুণ কান্তি,
বক্ষে মোরে লহো টানি; শোয়াও যতনে
মরণসুস্নিগ্ধ শুভ্রতিশয়নে॥
[আগামীকাল পড়ুন বইটির ৭ম অধ্যায় ‘ডীয়ার ডীয়ার এন্ড ডীয়ার ’।]