মিডিয়া কর্নার
এক মুঠো বাতাস ও শালিক দম্পতি
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১:১৩ পূর্বাহ্ন
প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের দেখা বহুল পঠিত গ্রন্থ ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’। ওই বইয়ের ৫ম অধ্যায় ‘এক মুঠো বাতাস ও শালিক দম্পতি’:
একজন রিপোর্টার ঘটনাবহুল পারিপার্শ্বিকতার মধ্য দিয়ে বর্ধিত হয়। বিশেষ করে কেউ যদি কর্মদক্ষ ও প্রতিষ্ঠিত হতে চান, তবে তাকে অনেক সময় প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় এবং ব্যর্থতা তাকে নৈরাশ্যের মধ্যেও নিক্ষেপ করতে পারে। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, সামাজিক, অসামাজিক, সাংস্কৃতিক, অপসংস্কৃতির পাশ দিয়েই তাকে চলতে হয়। গণস্বার্থ বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রবঞ্চনা ও তাদের অর্থনৈতিক বঞ্চনা তো অহরহই রিপোর্টারদের বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে। তবুও এবং সে সব কারণেই রিপোর্টিং অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং। অর্থাৎ কৌতুহলোদ্দীপক, আনন্দদায়ক এবং সবার উপর সৃষ্টির গৌরব।
‘এক মুঠো বাতাস’ কথাটার প্রয়োগ নিয়ে যখন মাঝ রাতে নবাবপুরের মাঝ রাস্তায় প্রশ্ন উঠে, তখন অবশ্যই শ্রমসাধ্য রিপোর্টিংকে ইন্টারেস্টিং মনে হবে। আর শালিক দম্পতির গৃহত্যাগ ও মুখ্যমন্ত্রীর শাসনকেন্দ্রে গৃহপ্রবেশ সংক্রান্ত প্রতীকধর্মী রিপোর্টিং প্রতিবেদককে কম আনন্দদান করে না। ‘এক মুঠো বাতাস’কে কেন্দ্র করে ঘটনা সংক্ষিপ্ত আকারে লিখলেও, ‘তৃতীয় রীচ্’ ভল্যুমের সমান আকৃতি হতে পারে। রাজনৈতিক দিক থেকে সে সময়টা ছিল আকর্ষণীয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের পূর্বে ও পরে ব্যাপক সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী জেল থেকে ছাড়া পেতে থাকেন। নির্বাচন পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে মুক্তি প্রাপ্ত কমিউনিস্ট নেতা, কর্মী ও প্রগতিশীল ব্যক্তিরা সরাসরি ‘সংবাদে’ এসে উপস্থিত হতেন। দীর্ঘ দিন পর জেল থেকে বেরিয়ে অনেকেই কোন আশ্রয় বা আত্মীয় ঢাকায় খুঁজে পাননি। তারা তো কেউ কেউ গৃহে ফেরার পূর্বে ‘সংবাদ’Ñএর কক্ষে বা ছাদে বাস করেছেন অনেক দিন। ইতিমধ্যে ‘সংবাদ’ মুসলিম লীগের কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে নিরপেক্ষ-প্রগতিশীল ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
শ্রদ্ধেয় সত্যেন সেন, রনেশ দাসগুপ্ত, বন্ধু সন্তোষ গুপ্ত এঁরা ক্রমে ক্রমে ‘সংবাদে’ সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় দেশে (বাংলাদেশ অঞ্চলে) রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষমতার লড়াই চলছিল হক সায়েব বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যে। এই দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্ট বিভক্ত হয়ে পড়ে; এর ইতিহাস দীর্ঘ ও বিশ্বাস ভঙ্গের।
সেই সব রাজনৈতিক ঘটনা পশ্চাতে রেখেই ‘এক মুঠো বাতাস’-এর ঘটনাটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে। রাত আড়াইটার মতো হবে; সাধারণত; আমরা সে সময়েই টেবিলের কাজটা সাঙ্গ করতাম। শেষ কপির বাকী ক’টা সিøপ্ শিফ্ট ইনচার্জ প্রেসে বুঝিয়ে দিয়েই প্রেস ম্যানেজারের তাগিদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে বললেন: একটা সলাই (সিগারেট) দাও হে। সবারই গৃহশ্রীর কথা মনে পড়ল। আমরা ক’জন রিপোর্টার-সাব এডিটর রাস্তার দিকে পা’ বাড়ালাম। তখনকার দিনে পত্রিকাগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা চলছিল। পত্রিকার পরিবারে সাংবাদিকের সংখ্যা কাজের চাইতে কম। সে কারণে বেচারা রিপোর্টারকে শেষ তাগিদ পর্যন্ত নিউজপ্রিন্টের প্যাডের উপর সশব্দে কলম চালিয়ে যেতে হতো। আমরা নবাবপুরের রথখোলার মোড়ে প্রায় এসে গেছি; জনবিরল রাজপথে সে সময় নাম ধরে ডাকলে, কে না চমকে উঠে। পেছন থেকে ডাক আসছে: শুনছেন, এই যেÑ ফয়েজ সায়েব, শুনছেন?
আমরা দাঁড়ালাম। ব্যাপার কি? ‘সংবাদ’ অফিসে পুলিশ চড়াও? (নিকট অতীতে তা’ ঘটেছে।) নাকি পত্রিকার বিচারে কোন ‘মহৎ’ ব্যক্তি অসময়ে আমাদের রেহাই দিয়ে বিদায় নিলেন? অগস্তযাত্রা যখন, তা’ বাবা এতো রাতে কেন?
হাঁপাতে হাঁপাতে ভদ্রলোক আমাদের এসে ধরলেন রথখোলার মোড়ে চার তলা সেই হোটেলটার সামনে। এই হোটেলেই আমি থাকি, হোটেল এস, ডি, খান। লোকে রপ্ত করেছে, ‘হোটেল এস’ডেকানস্Ñ সংক্ষিপ্ত নামের আসল রূপ হচ্ছে হোটেল সিরাজদ্দৌলা খান, মালিকের নিজস্ব নাম। এমনিতে বিভ্রান্তিকর নামযুক্ত একটা হোটেলে বাস করি, তার মধ্যে ভদ্রলোক ছুটে এসে মধ্যরাতে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেললেন। হাতে তার একটা কাগজ, আমারই লেখা রিপোর্ট।
‘এই যে লিখেছেনÑ‘এক মুঠো বাতাস’Ñতা’ কি করে হয়?’
ভদ্রলোক প্রুফ রিডিং-এ কিছু দিন যাবত কাজ করছেন। তিনি গভীর আস্থার সাথেই বললেন কথাটা। প্রথমে আমরা বুঝতেই পারলাম না কেন এ জাতীয় প্রশ্ন করা হচ্ছে; আর এতে আতঙ্কিত হবারই বা কি আছে। তবে ইহলোক পরিহার করার মতো কোন দুঃসংবাদ নয় বলে পয়লা ডিগ্রীর আতঙ্ক থেকে রেহাই পেলাম। তবুও অফিসে ফিরে যাবার ভয় থেকে যেন মনটা রেহাই পাচ্ছিল না। রাগ চেপে বললাম: ‘এখানে কোন ভুল দেখছেন?’
‘তা’ নয় তো কি?’ তিনি আকাশের দিকে হাত উঁচু করে মুঠি পাকিয়ে আবার খুলে বলে চললেন: ‘বাতাস কি এক মুঠো হয়? মুঠির মধ্যে বাতাস ধরে রাখা যায় নাকি?’
সোহরাব সায়েবকে আমরা শ্রদ্ধ করতাম। তিনি এই পত্রিকার প্রুফ রিডিং-এর প্রধান। তাঁকে কে না ভয় করেন। এমন কি জহুর ভাইয়ের (সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী) মতো মুখর সাংবাদিকও সম্পাদকীয় লিখে প্রায়ই বলতেন, ‘সোহরাব সায়েব তাঁর দিকটা দেখে দেবেন।’ আমাদের সোহরাব সায়েব পত্রিকায় যে কোন ব্যক্তির ব্যাকরণ ও বানান ভুল অনবরত সংশোধন করতেন। সেই ঠা-া মেজাজের মানুষটির অধীনে এই ভদ্রলোক কিছু দিন যাবত কাজ শিখছেন। সুতরাং ভরসা ছিল।
বললাম: ‘এটা একটা বাংলা ফ্রেজ, মানে শব্দগুচ্ছ। অর্থাৎ ভাষার পদ্ধতি বা রূপ বিশেষ। সব ভাষাতে এই প্রকাশ ভঙ্গি গ্রহণযোগ্য। সে জন্যে ‘এক মুঠো বাতাস’ কথাটা ভুল নয়Ñ এ কথাটা একটা সুস্পষ্ট অর্থ বহন করে। তবে কিছুটা বিমূর্ত বটে।’ আমার ব্যাখ্যায় তিনি যে সন্তুষ্ট হয়েছেন তা’ মনে হলো না। আবার ভয় হলো অন্য কারণে। শেষে তাকে অনুরোধ করলাম, ‘জনাব, এটা ‘সংশোধন’ করবেন নাÑ দায়ী আমি। অপারেশনের মাধ্যমে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে রুগী বাঁচানো যায় না।
ভদ্রলোক নিরাশ; নীরবে অফিসে প্রত্যাবর্তন করলেন। কোন শব্দ প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে আশাহত হলেন।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট সাহিত্যিক সরদার ফজলুল করিম দীর্ঘ দিন জেলে কাটিয়ে ছিলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মধ্য-পঞ্চাশে মুক্তি পাবার পর তাঁর বক্তৃতা নিয়েই এই ঘটনা। তিনি সে সময় জেল থেকেই কেন্দ্রীয় পরিষদে নির্বাচিত হবার জন্যে প্রার্থী হয়েছিলেন। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ও নির্বাচিত ব্যক্তি সরদার করিমকে ঢাকায় তখন বিভিন্ন স্থানে অভ্যর্থনা দেয়া হচ্ছিল। তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় পরিষদে একমাত্র ও প্রথম প্রতিনিধি, যাঁকে কমিউনিষ্ট বা বামপন্থী সদস্য বলা হতো।
সেদিন ফজলুল হক হলের প্রাক্তন কৃতী ছাত্র সরদার ফজলুল করিমকে উক্ত হল মিলনায়নে অভ্যর্থনা দেয়া হচ্ছিল। অভ্যর্থনার উত্তরে সরদার করিম অনেকের অনুরোধে দীর্ঘস্থায়ী বক্তৃতা করেন। তাঁর সহজ করল ভাষার কথপোকথনের ভঙ্গিতে বক্তৃতা আমাদের এমনি আকর্ষণ করেছিল যে, বক্তৃতার পুরো নোট নেয়াই সম্ভব হয়নি। কারাগারে রাজনৈতিক কর্মীদের উপর নির্যাতনের কাহিনী প্রতিটি শ্রোতাকে নির্বাক স্তম্ভের মতো স্থবির করে রেখেছিল। রিপোর্টার আমিও সবার মতো একজন শ্রোতার পরিণত হয়ে পড়ি।
রাত দশটার দিকে সভা শেষে অফিসে ফিরে এমন একটা অনন্য বক্তৃতা লেখার মতো সময় পাওয়া গেল না। সরকারী সংবাদ এজেন্সী এ জাতীয় সমালোচনা-প্রধান বক্তৃতার একটি লাইনও সরবরাহ করেনি। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে এ জাতীয় বক্তৃতা লিখতে গেলে বক্তৃতাটির মূল সুর ও বহু তথ্য হারিয়ে যাবে। এবং বক্তব্যের প্রতি অবিচার করা হবে। অথচ সরদার করিমের বক্তৃতা আজকের কাগজে যেতেই হবে। নিউজ এডিটরের তাগিদ আমাকে অস্থির করে তুলছিল। একই সাথে আমাকে সে রাতে অবশ্য করণীয় দু’তিনটি রাজনৈতিক সংবাদ লিখতে হয়। আবার হাঁক আসে: সরদারের বক্তৃতা কোথায়? ডেস্ক্ থেকে এমন তাড়ায় আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু আমারও একটা প্রবল আগ্রহ ছিল সেই মন্ত্রের মতো বক্তৃতাটি লেখার। অথচ কোন ভাবেই সেই রাতে সময় করে সম্পূর্ণ বক্তৃতা লেখা সম্ভব ছিল না।
উপায় ছিল না দেখে আমি সরদার করিমের বক্তৃতার মধ্যে কোন একটি শাণিত বক্তব্য, কোন উজ্জ্বল শব্দগুচ্ছ বা কোন বিশেষ রাজনৈতিক অভি-ব্যক্তি বের করার চেষ্টা করলাম, যা’ হবে সংক্ষিপ্ত, অথচ যার মাধ্যমে তার মূল বক্তব্যকেই তুলে ধরা যাবে। তিনি বক্তৃতায় জেলে রাজনৈতিক কর্মীদের নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনাকালে নিজেরই অভিজ্ঞতা বলছিলেন। জেলখানার সেলে অবস্থানকালে (ঢাকা কারাগারের পুরোন-২০ সেলে বিশেষ ভাবে শাস্তিদানের জন্যে রাজবন্দীদের রাখা হতোÑবৃটিশ আমল থেকে এই বিশ-সেল নির্দিষ্ট ছিল কুখ্যাত সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের জন্যে।) প্রচ- উত্তপ্ত আবহাওয়ায় বন্দীদের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। পরবর্তীকালে এই ভীতিকর বিশ সেলে আমাদের অনেককেই বাস করতে হয়েছিল। তিনি এই করুন অবস্থার বর্ণনা কালে বলেন: ‘আমরা এক মুঠো বাতাসের জন্যে আকুতি করতাম; আমরা সেলের ঘুনটি দিয়ে জীবনকে আহ্বান জানাতাম।’
তাঁর এই সুন্দর প্রকাশভঙ্গী আমার মনের মধ্যে বিধৃত হয়েছিল। সেই বাক্যটি তুলে নিয়ে আমি অতি সংক্ষিপ্ত একটি রিপোর্ট লিখলাম। যাতে বিষয়বস্তুর চাইতে ভাবপ্রবণতাই ছিল বেশী। বিশেষ পরিস্থিতিতে নিক্ষিপ্ত হয়েই কেবল আমি এই পন্থা অবলম্বন করেছিলাম। বিশেষ বিশেষ কারণে এই ধরনের রিপোর্ট লেখানো বা গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে।
সরদার করিমের সেই ‘এক মুঠো বাতাস’ নিয়ে মধ্যরাতে রথখোলার তে-মাথায় বিশুদ্ধতার প্রশ্ন কোন তরুণ সাংবাদিক উত্থাপন করলেও, পরদিন সকাল বেলার ‘সংবাদ’-এ তা’ প্রথম পৃষ্ঠায় বক্স-বন্ধনীতে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল।
পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার মধ্য ভাগে বক্স-বন্ধনীতে প্রকাশিত সংবাদটিকে সুউচ্চ প্রাকার বেস্টনে আবদ্ধ উদ্ধত কারাগার বলে মনে হচ্ছিল।
রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে সে সময় শালিক দম্পতির গৃহত্যাগকে মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক গৃহ প্রবেশের ঘটনার মতোই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল। শালিক দম্পতির সাথে অবশ্যই আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর তুলনা হয় না। তবুও গৃহ নিয়ে যেখানে কথা, সেখানে প্রতীকধর্মী অপ্রাসঙ্গিক নয়। যুক্তফ্রন্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পরে একক ক্ষমতা লাভের জন্যে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিক ভাবেই সকল পথেই হানা দিচ্ছিল। এমন কি এক কালের বিশিষ্ট আমলা ও পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘ষড়যন্ত্রকারী বুড়ো’ গভর্ণর-জেনারেল গোলাম মোহাম্মদকে বিমান বন্দরে শেরে বাংলা ফজলুল হকের সাথে পাল্লা দিয়ে মাল্যভূষিত করতেও আওয়ামী লীগ নেতা বিব্রত বোধ করেন নি। কার্জন হল লনের টি-পার্টিতে (চা-বাগানও বলা যেতে পারেÑ যে বাগানে চা পান করা হয়ে থাকে।) মাত্রাধিক পানাহারে বক্র ওষ্ঠ বিশিষ্ট যষ্টি-নির্ভর গভর্ণর-জেনারেলের নিকট উক্ত দু’ নেতা ক্ষমতার প্রসাদ লাভের তীব্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র পর্যায়ে প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগের পরিষদ নেতা জনাব আতাউর রহমান লাট ভবনে প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন।
উৎফুল্ল মুখ্যমন্ত্রী গাড়িতে উঠার সময় আমাকে ও মাহ্বুবকে (বর্তমানে ভূটানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, তখন এ, পি, পি-র রিপোর্টার মাহ্বুবুল আলম।) ডেকে নিলেন তাঁর পাশে। নতুন মুখ্যমন্ত্রী হয়তো কোন বক্তব্য প্রকাশ করতে চান। তাই ঠিক। আমরা সোজা সচিবালয়ে চলে এলাম। গতানুগতিক পদ্ধতিতে যাদের থাকার কথা, তারা আজ সবাই সিঁড়ির কাছে কালো আচকান পরিহিত নয়া মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানাবেন। ইতিমধ্যে দোতালায় মুখ্যমন্ত্রীর জন্য নির্দ্দিষ্ট কক্ষ পরিষ্কারের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে।
এই কক্ষের দাবীদার দীর্ঘ দিন অনুপস্থিত থাকায় অবহেলার সুযোগে এক শালিক দম্পতি কক্ষটির প্রধান দরজার উপরে সুখনীড় বেঁধেছিল। সেই দরজা দিয়ে সহাস্য বদনে মুখ্যমন্ত্রী প্রবেশ করার সময় শালিক দু’টি অদ্ভূত শব্দ করে উড়ে গেল বাইরের দিকে। শেষ যাত্রায় তাদের প্রতিবাদের কণ্ঠ ছিল ক্ষীণ। জনাব খানের এই দৃশ্য অবলোকন করার মতো সময়, মন বা সুযোগ তখন ছিল না।
আমি মিনিট খানেক পরে তাঁর কক্ষে প্রবেশ করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: ‘হঠাৎ তুমি কোথায় গেলে?’
যিনি গৃহ প্রবেশ করছেন, তাঁর কাছে গৃহহারা পাখির গাথা বলে লাভ কি! তিনি সারাক্ষণই ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ও সম্প্রতি জনাব খান কর্ত্তৃক মাল্যভূষিত গোলাম মোহাম্মদের ষড়যন্ত্রের কাহিনীই কেবল বললেন। রাতে ‘সংবাদে’র টেবিলে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের খবর লেখার পর মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার লেখার জন্যে প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু সেই শালিক দম্পতি কোথায় গেল? ক্ষমতায় আসার সময় এদেশের নেতারা অনেক প্রতিশ্রুতিই জনগণকে দিয়ে আসছেন। আমরাও চিরাগত পদ্ধতিতে লিখে আসছি। শালিক দম্পতিকে জনগণের প্রতীক করলে অন্যায় কি? একজন যেখানে আশ্রয় নিলেন, আর একজন সেখানে অনিকেত। ‘সংবাদ’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় বেরিয়ে ছিল বক্স-আইটেম হিসেবে গৃহহারা শালিক দম্পতির কাহিনী মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসপূর্ণ কর্মসূচী নয়।
পরদিন বিকেলে রসবেত্তা মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খানের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি কৌতূহল সহকারে অনিকেত শালিক দম্পতির খবর পড়েছিলেন। হেসে বললেন: আমি জানলে ওদের বাস্তুহারা করতে দিতাম না।
[আগামীকাল পড়ুনন বইটির ৬ষ্ঠ অধ্যায় ‘এসো সুপ্তি এসো শান্তি’
একজন রিপোর্টার ঘটনাবহুল পারিপার্শ্বিকতার মধ্য দিয়ে বর্ধিত হয়। বিশেষ করে কেউ যদি কর্মদক্ষ ও প্রতিষ্ঠিত হতে চান, তবে তাকে অনেক সময় প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় এবং ব্যর্থতা তাকে নৈরাশ্যের মধ্যেও নিক্ষেপ করতে পারে। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, সামাজিক, অসামাজিক, সাংস্কৃতিক, অপসংস্কৃতির পাশ দিয়েই তাকে চলতে হয়। গণস্বার্থ বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রবঞ্চনা ও তাদের অর্থনৈতিক বঞ্চনা তো অহরহই রিপোর্টারদের বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে। তবুও এবং সে সব কারণেই রিপোর্টিং অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং। অর্থাৎ কৌতুহলোদ্দীপক, আনন্দদায়ক এবং সবার উপর সৃষ্টির গৌরব।
‘এক মুঠো বাতাস’ কথাটার প্রয়োগ নিয়ে যখন মাঝ রাতে নবাবপুরের মাঝ রাস্তায় প্রশ্ন উঠে, তখন অবশ্যই শ্রমসাধ্য রিপোর্টিংকে ইন্টারেস্টিং মনে হবে। আর শালিক দম্পতির গৃহত্যাগ ও মুখ্যমন্ত্রীর শাসনকেন্দ্রে গৃহপ্রবেশ সংক্রান্ত প্রতীকধর্মী রিপোর্টিং প্রতিবেদককে কম আনন্দদান করে না। ‘এক মুঠো বাতাস’কে কেন্দ্র করে ঘটনা সংক্ষিপ্ত আকারে লিখলেও, ‘তৃতীয় রীচ্’ ভল্যুমের সমান আকৃতি হতে পারে। রাজনৈতিক দিক থেকে সে সময়টা ছিল আকর্ষণীয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের পূর্বে ও পরে ব্যাপক সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী জেল থেকে ছাড়া পেতে থাকেন। নির্বাচন পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে মুক্তি প্রাপ্ত কমিউনিস্ট নেতা, কর্মী ও প্রগতিশীল ব্যক্তিরা সরাসরি ‘সংবাদে’ এসে উপস্থিত হতেন। দীর্ঘ দিন পর জেল থেকে বেরিয়ে অনেকেই কোন আশ্রয় বা আত্মীয় ঢাকায় খুঁজে পাননি। তারা তো কেউ কেউ গৃহে ফেরার পূর্বে ‘সংবাদ’Ñএর কক্ষে বা ছাদে বাস করেছেন অনেক দিন। ইতিমধ্যে ‘সংবাদ’ মুসলিম লীগের কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে নিরপেক্ষ-প্রগতিশীল ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
শ্রদ্ধেয় সত্যেন সেন, রনেশ দাসগুপ্ত, বন্ধু সন্তোষ গুপ্ত এঁরা ক্রমে ক্রমে ‘সংবাদে’ সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় দেশে (বাংলাদেশ অঞ্চলে) রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষমতার লড়াই চলছিল হক সায়েব বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যে। এই দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্ট বিভক্ত হয়ে পড়ে; এর ইতিহাস দীর্ঘ ও বিশ্বাস ভঙ্গের।
সেই সব রাজনৈতিক ঘটনা পশ্চাতে রেখেই ‘এক মুঠো বাতাস’-এর ঘটনাটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে। রাত আড়াইটার মতো হবে; সাধারণত; আমরা সে সময়েই টেবিলের কাজটা সাঙ্গ করতাম। শেষ কপির বাকী ক’টা সিøপ্ শিফ্ট ইনচার্জ প্রেসে বুঝিয়ে দিয়েই প্রেস ম্যানেজারের তাগিদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে বললেন: একটা সলাই (সিগারেট) দাও হে। সবারই গৃহশ্রীর কথা মনে পড়ল। আমরা ক’জন রিপোর্টার-সাব এডিটর রাস্তার দিকে পা’ বাড়ালাম। তখনকার দিনে পত্রিকাগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা চলছিল। পত্রিকার পরিবারে সাংবাদিকের সংখ্যা কাজের চাইতে কম। সে কারণে বেচারা রিপোর্টারকে শেষ তাগিদ পর্যন্ত নিউজপ্রিন্টের প্যাডের উপর সশব্দে কলম চালিয়ে যেতে হতো। আমরা নবাবপুরের রথখোলার মোড়ে প্রায় এসে গেছি; জনবিরল রাজপথে সে সময় নাম ধরে ডাকলে, কে না চমকে উঠে। পেছন থেকে ডাক আসছে: শুনছেন, এই যেÑ ফয়েজ সায়েব, শুনছেন?
আমরা দাঁড়ালাম। ব্যাপার কি? ‘সংবাদ’ অফিসে পুলিশ চড়াও? (নিকট অতীতে তা’ ঘটেছে।) নাকি পত্রিকার বিচারে কোন ‘মহৎ’ ব্যক্তি অসময়ে আমাদের রেহাই দিয়ে বিদায় নিলেন? অগস্তযাত্রা যখন, তা’ বাবা এতো রাতে কেন?
হাঁপাতে হাঁপাতে ভদ্রলোক আমাদের এসে ধরলেন রথখোলার মোড়ে চার তলা সেই হোটেলটার সামনে। এই হোটেলেই আমি থাকি, হোটেল এস, ডি, খান। লোকে রপ্ত করেছে, ‘হোটেল এস’ডেকানস্Ñ সংক্ষিপ্ত নামের আসল রূপ হচ্ছে হোটেল সিরাজদ্দৌলা খান, মালিকের নিজস্ব নাম। এমনিতে বিভ্রান্তিকর নামযুক্ত একটা হোটেলে বাস করি, তার মধ্যে ভদ্রলোক ছুটে এসে মধ্যরাতে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেললেন। হাতে তার একটা কাগজ, আমারই লেখা রিপোর্ট।
‘এই যে লিখেছেনÑ‘এক মুঠো বাতাস’Ñতা’ কি করে হয়?’
ভদ্রলোক প্রুফ রিডিং-এ কিছু দিন যাবত কাজ করছেন। তিনি গভীর আস্থার সাথেই বললেন কথাটা। প্রথমে আমরা বুঝতেই পারলাম না কেন এ জাতীয় প্রশ্ন করা হচ্ছে; আর এতে আতঙ্কিত হবারই বা কি আছে। তবে ইহলোক পরিহার করার মতো কোন দুঃসংবাদ নয় বলে পয়লা ডিগ্রীর আতঙ্ক থেকে রেহাই পেলাম। তবুও অফিসে ফিরে যাবার ভয় থেকে যেন মনটা রেহাই পাচ্ছিল না। রাগ চেপে বললাম: ‘এখানে কোন ভুল দেখছেন?’
‘তা’ নয় তো কি?’ তিনি আকাশের দিকে হাত উঁচু করে মুঠি পাকিয়ে আবার খুলে বলে চললেন: ‘বাতাস কি এক মুঠো হয়? মুঠির মধ্যে বাতাস ধরে রাখা যায় নাকি?’
সোহরাব সায়েবকে আমরা শ্রদ্ধ করতাম। তিনি এই পত্রিকার প্রুফ রিডিং-এর প্রধান। তাঁকে কে না ভয় করেন। এমন কি জহুর ভাইয়ের (সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী) মতো মুখর সাংবাদিকও সম্পাদকীয় লিখে প্রায়ই বলতেন, ‘সোহরাব সায়েব তাঁর দিকটা দেখে দেবেন।’ আমাদের সোহরাব সায়েব পত্রিকায় যে কোন ব্যক্তির ব্যাকরণ ও বানান ভুল অনবরত সংশোধন করতেন। সেই ঠা-া মেজাজের মানুষটির অধীনে এই ভদ্রলোক কিছু দিন যাবত কাজ শিখছেন। সুতরাং ভরসা ছিল।
বললাম: ‘এটা একটা বাংলা ফ্রেজ, মানে শব্দগুচ্ছ। অর্থাৎ ভাষার পদ্ধতি বা রূপ বিশেষ। সব ভাষাতে এই প্রকাশ ভঙ্গি গ্রহণযোগ্য। সে জন্যে ‘এক মুঠো বাতাস’ কথাটা ভুল নয়Ñ এ কথাটা একটা সুস্পষ্ট অর্থ বহন করে। তবে কিছুটা বিমূর্ত বটে।’ আমার ব্যাখ্যায় তিনি যে সন্তুষ্ট হয়েছেন তা’ মনে হলো না। আবার ভয় হলো অন্য কারণে। শেষে তাকে অনুরোধ করলাম, ‘জনাব, এটা ‘সংশোধন’ করবেন নাÑ দায়ী আমি। অপারেশনের মাধ্যমে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে রুগী বাঁচানো যায় না।
ভদ্রলোক নিরাশ; নীরবে অফিসে প্রত্যাবর্তন করলেন। কোন শব্দ প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে আশাহত হলেন।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট সাহিত্যিক সরদার ফজলুল করিম দীর্ঘ দিন জেলে কাটিয়ে ছিলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মধ্য-পঞ্চাশে মুক্তি পাবার পর তাঁর বক্তৃতা নিয়েই এই ঘটনা। তিনি সে সময় জেল থেকেই কেন্দ্রীয় পরিষদে নির্বাচিত হবার জন্যে প্রার্থী হয়েছিলেন। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ও নির্বাচিত ব্যক্তি সরদার করিমকে ঢাকায় তখন বিভিন্ন স্থানে অভ্যর্থনা দেয়া হচ্ছিল। তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় পরিষদে একমাত্র ও প্রথম প্রতিনিধি, যাঁকে কমিউনিষ্ট বা বামপন্থী সদস্য বলা হতো।
সেদিন ফজলুল হক হলের প্রাক্তন কৃতী ছাত্র সরদার ফজলুল করিমকে উক্ত হল মিলনায়নে অভ্যর্থনা দেয়া হচ্ছিল। অভ্যর্থনার উত্তরে সরদার করিম অনেকের অনুরোধে দীর্ঘস্থায়ী বক্তৃতা করেন। তাঁর সহজ করল ভাষার কথপোকথনের ভঙ্গিতে বক্তৃতা আমাদের এমনি আকর্ষণ করেছিল যে, বক্তৃতার পুরো নোট নেয়াই সম্ভব হয়নি। কারাগারে রাজনৈতিক কর্মীদের উপর নির্যাতনের কাহিনী প্রতিটি শ্রোতাকে নির্বাক স্তম্ভের মতো স্থবির করে রেখেছিল। রিপোর্টার আমিও সবার মতো একজন শ্রোতার পরিণত হয়ে পড়ি।
রাত দশটার দিকে সভা শেষে অফিসে ফিরে এমন একটা অনন্য বক্তৃতা লেখার মতো সময় পাওয়া গেল না। সরকারী সংবাদ এজেন্সী এ জাতীয় সমালোচনা-প্রধান বক্তৃতার একটি লাইনও সরবরাহ করেনি। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে এ জাতীয় বক্তৃতা লিখতে গেলে বক্তৃতাটির মূল সুর ও বহু তথ্য হারিয়ে যাবে। এবং বক্তব্যের প্রতি অবিচার করা হবে। অথচ সরদার করিমের বক্তৃতা আজকের কাগজে যেতেই হবে। নিউজ এডিটরের তাগিদ আমাকে অস্থির করে তুলছিল। একই সাথে আমাকে সে রাতে অবশ্য করণীয় দু’তিনটি রাজনৈতিক সংবাদ লিখতে হয়। আবার হাঁক আসে: সরদারের বক্তৃতা কোথায়? ডেস্ক্ থেকে এমন তাড়ায় আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু আমারও একটা প্রবল আগ্রহ ছিল সেই মন্ত্রের মতো বক্তৃতাটি লেখার। অথচ কোন ভাবেই সেই রাতে সময় করে সম্পূর্ণ বক্তৃতা লেখা সম্ভব ছিল না।
উপায় ছিল না দেখে আমি সরদার করিমের বক্তৃতার মধ্যে কোন একটি শাণিত বক্তব্য, কোন উজ্জ্বল শব্দগুচ্ছ বা কোন বিশেষ রাজনৈতিক অভি-ব্যক্তি বের করার চেষ্টা করলাম, যা’ হবে সংক্ষিপ্ত, অথচ যার মাধ্যমে তার মূল বক্তব্যকেই তুলে ধরা যাবে। তিনি বক্তৃতায় জেলে রাজনৈতিক কর্মীদের নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনাকালে নিজেরই অভিজ্ঞতা বলছিলেন। জেলখানার সেলে অবস্থানকালে (ঢাকা কারাগারের পুরোন-২০ সেলে বিশেষ ভাবে শাস্তিদানের জন্যে রাজবন্দীদের রাখা হতোÑবৃটিশ আমল থেকে এই বিশ-সেল নির্দিষ্ট ছিল কুখ্যাত সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের জন্যে।) প্রচ- উত্তপ্ত আবহাওয়ায় বন্দীদের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। পরবর্তীকালে এই ভীতিকর বিশ সেলে আমাদের অনেককেই বাস করতে হয়েছিল। তিনি এই করুন অবস্থার বর্ণনা কালে বলেন: ‘আমরা এক মুঠো বাতাসের জন্যে আকুতি করতাম; আমরা সেলের ঘুনটি দিয়ে জীবনকে আহ্বান জানাতাম।’
তাঁর এই সুন্দর প্রকাশভঙ্গী আমার মনের মধ্যে বিধৃত হয়েছিল। সেই বাক্যটি তুলে নিয়ে আমি অতি সংক্ষিপ্ত একটি রিপোর্ট লিখলাম। যাতে বিষয়বস্তুর চাইতে ভাবপ্রবণতাই ছিল বেশী। বিশেষ পরিস্থিতিতে নিক্ষিপ্ত হয়েই কেবল আমি এই পন্থা অবলম্বন করেছিলাম। বিশেষ বিশেষ কারণে এই ধরনের রিপোর্ট লেখানো বা গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে।
সরদার করিমের সেই ‘এক মুঠো বাতাস’ নিয়ে মধ্যরাতে রথখোলার তে-মাথায় বিশুদ্ধতার প্রশ্ন কোন তরুণ সাংবাদিক উত্থাপন করলেও, পরদিন সকাল বেলার ‘সংবাদ’-এ তা’ প্রথম পৃষ্ঠায় বক্স-বন্ধনীতে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল।
পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার মধ্য ভাগে বক্স-বন্ধনীতে প্রকাশিত সংবাদটিকে সুউচ্চ প্রাকার বেস্টনে আবদ্ধ উদ্ধত কারাগার বলে মনে হচ্ছিল।
রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে সে সময় শালিক দম্পতির গৃহত্যাগকে মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক গৃহ প্রবেশের ঘটনার মতোই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল। শালিক দম্পতির সাথে অবশ্যই আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর তুলনা হয় না। তবুও গৃহ নিয়ে যেখানে কথা, সেখানে প্রতীকধর্মী অপ্রাসঙ্গিক নয়। যুক্তফ্রন্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পরে একক ক্ষমতা লাভের জন্যে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিক ভাবেই সকল পথেই হানা দিচ্ছিল। এমন কি এক কালের বিশিষ্ট আমলা ও পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘ষড়যন্ত্রকারী বুড়ো’ গভর্ণর-জেনারেল গোলাম মোহাম্মদকে বিমান বন্দরে শেরে বাংলা ফজলুল হকের সাথে পাল্লা দিয়ে মাল্যভূষিত করতেও আওয়ামী লীগ নেতা বিব্রত বোধ করেন নি। কার্জন হল লনের টি-পার্টিতে (চা-বাগানও বলা যেতে পারেÑ যে বাগানে চা পান করা হয়ে থাকে।) মাত্রাধিক পানাহারে বক্র ওষ্ঠ বিশিষ্ট যষ্টি-নির্ভর গভর্ণর-জেনারেলের নিকট উক্ত দু’ নেতা ক্ষমতার প্রসাদ লাভের তীব্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র পর্যায়ে প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগের পরিষদ নেতা জনাব আতাউর রহমান লাট ভবনে প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন।
উৎফুল্ল মুখ্যমন্ত্রী গাড়িতে উঠার সময় আমাকে ও মাহ্বুবকে (বর্তমানে ভূটানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, তখন এ, পি, পি-র রিপোর্টার মাহ্বুবুল আলম।) ডেকে নিলেন তাঁর পাশে। নতুন মুখ্যমন্ত্রী হয়তো কোন বক্তব্য প্রকাশ করতে চান। তাই ঠিক। আমরা সোজা সচিবালয়ে চলে এলাম। গতানুগতিক পদ্ধতিতে যাদের থাকার কথা, তারা আজ সবাই সিঁড়ির কাছে কালো আচকান পরিহিত নয়া মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানাবেন। ইতিমধ্যে দোতালায় মুখ্যমন্ত্রীর জন্য নির্দ্দিষ্ট কক্ষ পরিষ্কারের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে।
এই কক্ষের দাবীদার দীর্ঘ দিন অনুপস্থিত থাকায় অবহেলার সুযোগে এক শালিক দম্পতি কক্ষটির প্রধান দরজার উপরে সুখনীড় বেঁধেছিল। সেই দরজা দিয়ে সহাস্য বদনে মুখ্যমন্ত্রী প্রবেশ করার সময় শালিক দু’টি অদ্ভূত শব্দ করে উড়ে গেল বাইরের দিকে। শেষ যাত্রায় তাদের প্রতিবাদের কণ্ঠ ছিল ক্ষীণ। জনাব খানের এই দৃশ্য অবলোকন করার মতো সময়, মন বা সুযোগ তখন ছিল না।
আমি মিনিট খানেক পরে তাঁর কক্ষে প্রবেশ করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: ‘হঠাৎ তুমি কোথায় গেলে?’
যিনি গৃহ প্রবেশ করছেন, তাঁর কাছে গৃহহারা পাখির গাথা বলে লাভ কি! তিনি সারাক্ষণই ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ও সম্প্রতি জনাব খান কর্ত্তৃক মাল্যভূষিত গোলাম মোহাম্মদের ষড়যন্ত্রের কাহিনীই কেবল বললেন। রাতে ‘সংবাদে’র টেবিলে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের খবর লেখার পর মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার লেখার জন্যে প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু সেই শালিক দম্পতি কোথায় গেল? ক্ষমতায় আসার সময় এদেশের নেতারা অনেক প্রতিশ্রুতিই জনগণকে দিয়ে আসছেন। আমরাও চিরাগত পদ্ধতিতে লিখে আসছি। শালিক দম্পতিকে জনগণের প্রতীক করলে অন্যায় কি? একজন যেখানে আশ্রয় নিলেন, আর একজন সেখানে অনিকেত। ‘সংবাদ’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় বেরিয়ে ছিল বক্স-আইটেম হিসেবে গৃহহারা শালিক দম্পতির কাহিনী মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসপূর্ণ কর্মসূচী নয়।
পরদিন বিকেলে রসবেত্তা মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খানের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি কৌতূহল সহকারে অনিকেত শালিক দম্পতির খবর পড়েছিলেন। হেসে বললেন: আমি জানলে ওদের বাস্তুহারা করতে দিতাম না।
[আগামীকাল পড়ুনন বইটির ৬ষ্ঠ অধ্যায় ‘এসো সুপ্তি এসো শান্তি’