মত-মতান্তর
হিংসা ও বলপ্রয়োগ: ‘জিসকি লাঠি, উসকি ভঁইস’
ড. মাহফুজ পারভেজ
২০২১-১১-২০
হিংসা এক চিরন্তন মানসিক সমস্যা। হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদি কুচিন্তা সর্বদা পরিত্যাজ্য হলেও সমাজে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর, যার মধ্যে মোটেও হিংসা নেই। নিশ্চয় আছেন। তবে তারা অত্যল্প এবং মহামানব ও উচ্চতর মানবিকতার বোধ সম্পন্ন মানুষ। এদের মধ্যে ধর্মবেত্তা, রাষ্ট্রনায়ক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সুরসাধক, লোকশিল্পী রয়েছেন।
সাধারণ মানুষের মধ্যে হিংসা এক অতি সাধারণ ব্যাধি বিশেষ। ঘরে, পরিবারে, পাড়ায়, মহল্লায়, কর্মক্ষেত্রে হিংসার প্রকাশ্য ও গোপন আগুনে জ্বলতে দেখা যায় বহুজনকেই। অবশ্যই এসব দূষণীয়। তথাপি এসব নিয়েই সুখেদুঃখে চলছে সাধারণ মানুষের আটপৌরে জীবন।
সমস্যা হয় তখনই, যখন সমাজে হিংসার প্রকোপ ও দৌরাত্ম্য চরম আকার ধারণ করে। কর্তাব্যক্তিগণ কিংবা সমাজের কর্তৃত্বশীল প্রধান অংশ হিংসায় আক্রান্ত হলে একদিকে যেমন সকলের বিপদ বাড়ে, অন্যদিকে মনের হিংসাকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চরিতার্থ করার সুযোগও বৃদ্ধি পায়।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে বেশির ভাগ সমাজেই হিংসার অবধারিত কুফলস্বরূপ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দুর্বলের প্রতি সবলের তাণ্ডব চলে। হিংসার ক্ষেত্রে একতরফা অধিকার নানা দুষ্কর্মের কারণ হয়। হিংসা ও বলপ্রয়োগের দুরভিসন্ধিযুক্ত মিলন হলে আইন, নীতি, মানবিকার ক্ষয় হয়। পরিস্থিতি দাঁড়ায় প্রাচীন হিন্দি প্রবাদের মতো: ‘জিসকি লাঠি, উসকি ভঁইস’ ( যার লাঠি, তারই মোষ)।
বিশ্বইতিহাসে হিংসার উদাহরণ আদৌ বিরল নয়। কখনও তা এসেছে আক্রমণকারী বা ক্ষমতাসীন বা অন্যদের হাত ধরে। অনেক সময়ে হিংসাকে অহিংসার মুখোশ পরিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। কখনো রাজনীতির নামে, মতাদর্শের নামে, ধর্মের নামে, উগ্র জাতীয়তার নামে হিংসা আমদানি ও চর্চা করা হয়েছে। প্রতিপক্ষকে, বিরোধীদের, প্রতিদ্বন্দ্বীদের হেনস্তা করার হাতিয়ার হয়েছে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য হিংসা এবং তারই ধারাবাহিকতায় বলপ্রয়োগ।
রাজনীতি ছাড়াও হিংসা কবলিত হয়েছে ভিন্নমতাবলম্বীরা, মুক্তচিন্তার মানুষেরা, নারী সমাজ, সংখ্যালঘু, দুর্বল ও প্রান্তিক জনজাতি। কখনও আক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ে হিংসার মুখোশ খসেও পড়েছে। এমন সুপরিকল্পিত এবং পর্যায়ক্রমিক হিংসা সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে বলপ্রয়োগের দ্বারা মানুষের জান, মাল, ইজ্জত, আব্রু, অধিকার হননের উদাহরণ পৃথিবীব্যাপী অবিরল।
হিংসার কারণ ও বিস্তার প্রসঙ্গে ডারউইনবাদ-কথিত ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ বা ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’-এর তত্ত্বের সমান্তরালে ব্রায়ান হেয়ার এবং ভেনেসা উডস নামে লেখক দম্পতি একটি বিশেষ তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। সেটির নাম ‘সারভাইভাল অব দ্য ফ্রেন্ডলিয়েস্ট’ বা ‘সব থেকে বন্ধুভাবাপন্নের টিকে থাকা’। তাঁদের রচিত গ্রন্থটির সম্পূর্ণ নাম ‘সারভাইভাল অব দ্য ফ্রেন্ডলিয়েস্ট: আন্ডারস্ট্যান্ডিং আওয়ার অরিজিনস অ্যান্ড রিডিসকভারিং আওয়ার কমন হিউম্যানিটি’ (আমাদের উৎসকে বোঝা এবং মানবত্বের সাধারণ সূত্রগুলোকে পুনরাবিষ্কার করা)।
গবেষক হেয়ার এবং উডস যুক্তি দিচ্ছেন, ডারউইনবাদকে বন্ধুভাবাপন্নতার পাশাপাশি ফেলে দেখার অবকাশ রয়েছে। সেই সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার প্রবৃত্তিগত ক্ষমতাকেও বিচার করা প্রয়োজন, যার সাহায্যে মানুষ তার অভিযোজন সূত্রে নিকটতম আত্মীয়দের থেকে এগিয়ে থেকেছে। রাজনৈতিক বা কর্পোরেট সংস্কৃতিতে বিষয়টি যতখানি নির্মম সত্য, সত্য ক্রিকেট দল, খেলার মাঠ, শেয়ার বাজার বা একক মানুষের পারিবারিক-ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে এবং সামগ্রিক অর্থে বৃহত্তর সমাজের ক্ষেত্রে। এমন নিয়ম অন্য প্রাণিদের ক্ষেত্রেও সত্য।
তবে, মানুষকে অন্যান্য জৈবিক প্রাণিদের চেয়ে পৃথক, আলাদা ও অগ্রসর করছে তার বিবেক ও মনুষ্যত্ব। হিংসা কিংবা অন্যান্য কুপ্রবৃত্তি যদি মানুষের পরিবারে, সমাজে, সংসারে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে 'মানুষ' নামক পরিচিতি আর অবশিষ্ট থাকে না। হিংসা, লোভ, দম্ভ, ক্ষমতা, অর্থ, বিত্ত, কর্তৃত্ব মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে দেয়। এই মানবিক অধঃপতনের কুফল নানা নির্মমতা ও নৃশংসতার মাধ্যমে চারপাশ কলুষিত করে ও দৃশ্যমান হয়।
পৃথিবীর মানুষজন মনে হয়, তেমনই একটি কালো, কলুষযুক্ত, দুষ্টচক্রের কারাগারসম গণ্ডিতে আবর্তিত হচ্ছে আর হিংসা-বিদ্বেষ-বলপ্রয়োগের দ্বারা মানবিকতাকে পদে পদে লাঞ্ছিত হতে দেখছে। শুনছে মানবতার আর্তনাদ। টের পাচ্ছে মানবিক অধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্য নিপীড়িতের গোঙানি। যার থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউই। এশিয়া থেকে আফ্রিকার মানুষ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে লাতিন আমেরিকার উদ্বাস্ত, হাসপাতালের রোগি থেকে পথচারী, অফিসের কর্মচারী থেকে বাজারের ক্রেতা, রাজনীতির লোক থেকে সমাজের বাসিন্দা, সবাই যেন বিদ্ধ হচ্ছে হিংসা ও বলপ্রয়োগের তীব্র শরাঘাতে। যেন হিংসা নামক চিরন্তন মানসিক ব্যাধির সবল ও আক্রমণাত্মক করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে পারছে না এই অতিআধুনিক, অতিঅগ্রসর, অতিউন্নত, একবিংশ শতাব্দীর বিপন্ন মানুষ।
সাধারণ মানুষের মধ্যে হিংসা এক অতি সাধারণ ব্যাধি বিশেষ। ঘরে, পরিবারে, পাড়ায়, মহল্লায়, কর্মক্ষেত্রে হিংসার প্রকাশ্য ও গোপন আগুনে জ্বলতে দেখা যায় বহুজনকেই। অবশ্যই এসব দূষণীয়। তথাপি এসব নিয়েই সুখেদুঃখে চলছে সাধারণ মানুষের আটপৌরে জীবন।
সমস্যা হয় তখনই, যখন সমাজে হিংসার প্রকোপ ও দৌরাত্ম্য চরম আকার ধারণ করে। কর্তাব্যক্তিগণ কিংবা সমাজের কর্তৃত্বশীল প্রধান অংশ হিংসায় আক্রান্ত হলে একদিকে যেমন সকলের বিপদ বাড়ে, অন্যদিকে মনের হিংসাকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চরিতার্থ করার সুযোগও বৃদ্ধি পায়।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে বেশির ভাগ সমাজেই হিংসার অবধারিত কুফলস্বরূপ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দুর্বলের প্রতি সবলের তাণ্ডব চলে। হিংসার ক্ষেত্রে একতরফা অধিকার নানা দুষ্কর্মের কারণ হয়। হিংসা ও বলপ্রয়োগের দুরভিসন্ধিযুক্ত মিলন হলে আইন, নীতি, মানবিকার ক্ষয় হয়। পরিস্থিতি দাঁড়ায় প্রাচীন হিন্দি প্রবাদের মতো: ‘জিসকি লাঠি, উসকি ভঁইস’ ( যার লাঠি, তারই মোষ)।
বিশ্বইতিহাসে হিংসার উদাহরণ আদৌ বিরল নয়। কখনও তা এসেছে আক্রমণকারী বা ক্ষমতাসীন বা অন্যদের হাত ধরে। অনেক সময়ে হিংসাকে অহিংসার মুখোশ পরিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। কখনো রাজনীতির নামে, মতাদর্শের নামে, ধর্মের নামে, উগ্র জাতীয়তার নামে হিংসা আমদানি ও চর্চা করা হয়েছে। প্রতিপক্ষকে, বিরোধীদের, প্রতিদ্বন্দ্বীদের হেনস্তা করার হাতিয়ার হয়েছে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য হিংসা এবং তারই ধারাবাহিকতায় বলপ্রয়োগ।
রাজনীতি ছাড়াও হিংসা কবলিত হয়েছে ভিন্নমতাবলম্বীরা, মুক্তচিন্তার মানুষেরা, নারী সমাজ, সংখ্যালঘু, দুর্বল ও প্রান্তিক জনজাতি। কখনও আক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ে হিংসার মুখোশ খসেও পড়েছে। এমন সুপরিকল্পিত এবং পর্যায়ক্রমিক হিংসা সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে বলপ্রয়োগের দ্বারা মানুষের জান, মাল, ইজ্জত, আব্রু, অধিকার হননের উদাহরণ পৃথিবীব্যাপী অবিরল।
হিংসার কারণ ও বিস্তার প্রসঙ্গে ডারউইনবাদ-কথিত ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ বা ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’-এর তত্ত্বের সমান্তরালে ব্রায়ান হেয়ার এবং ভেনেসা উডস নামে লেখক দম্পতি একটি বিশেষ তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। সেটির নাম ‘সারভাইভাল অব দ্য ফ্রেন্ডলিয়েস্ট’ বা ‘সব থেকে বন্ধুভাবাপন্নের টিকে থাকা’। তাঁদের রচিত গ্রন্থটির সম্পূর্ণ নাম ‘সারভাইভাল অব দ্য ফ্রেন্ডলিয়েস্ট: আন্ডারস্ট্যান্ডিং আওয়ার অরিজিনস অ্যান্ড রিডিসকভারিং আওয়ার কমন হিউম্যানিটি’ (আমাদের উৎসকে বোঝা এবং মানবত্বের সাধারণ সূত্রগুলোকে পুনরাবিষ্কার করা)।
গবেষক হেয়ার এবং উডস যুক্তি দিচ্ছেন, ডারউইনবাদকে বন্ধুভাবাপন্নতার পাশাপাশি ফেলে দেখার অবকাশ রয়েছে। সেই সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার প্রবৃত্তিগত ক্ষমতাকেও বিচার করা প্রয়োজন, যার সাহায্যে মানুষ তার অভিযোজন সূত্রে নিকটতম আত্মীয়দের থেকে এগিয়ে থেকেছে। রাজনৈতিক বা কর্পোরেট সংস্কৃতিতে বিষয়টি যতখানি নির্মম সত্য, সত্য ক্রিকেট দল, খেলার মাঠ, শেয়ার বাজার বা একক মানুষের পারিবারিক-ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে এবং সামগ্রিক অর্থে বৃহত্তর সমাজের ক্ষেত্রে। এমন নিয়ম অন্য প্রাণিদের ক্ষেত্রেও সত্য।
তবে, মানুষকে অন্যান্য জৈবিক প্রাণিদের চেয়ে পৃথক, আলাদা ও অগ্রসর করছে তার বিবেক ও মনুষ্যত্ব। হিংসা কিংবা অন্যান্য কুপ্রবৃত্তি যদি মানুষের পরিবারে, সমাজে, সংসারে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে 'মানুষ' নামক পরিচিতি আর অবশিষ্ট থাকে না। হিংসা, লোভ, দম্ভ, ক্ষমতা, অর্থ, বিত্ত, কর্তৃত্ব মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে দেয়। এই মানবিক অধঃপতনের কুফল নানা নির্মমতা ও নৃশংসতার মাধ্যমে চারপাশ কলুষিত করে ও দৃশ্যমান হয়।
পৃথিবীর মানুষজন মনে হয়, তেমনই একটি কালো, কলুষযুক্ত, দুষ্টচক্রের কারাগারসম গণ্ডিতে আবর্তিত হচ্ছে আর হিংসা-বিদ্বেষ-বলপ্রয়োগের দ্বারা মানবিকতাকে পদে পদে লাঞ্ছিত হতে দেখছে। শুনছে মানবতার আর্তনাদ। টের পাচ্ছে মানবিক অধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্য নিপীড়িতের গোঙানি। যার থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউই। এশিয়া থেকে আফ্রিকার মানুষ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে লাতিন আমেরিকার উদ্বাস্ত, হাসপাতালের রোগি থেকে পথচারী, অফিসের কর্মচারী থেকে বাজারের ক্রেতা, রাজনীতির লোক থেকে সমাজের বাসিন্দা, সবাই যেন বিদ্ধ হচ্ছে হিংসা ও বলপ্রয়োগের তীব্র শরাঘাতে। যেন হিংসা নামক চিরন্তন মানসিক ব্যাধির সবল ও আক্রমণাত্মক করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে পারছে না এই অতিআধুনিক, অতিঅগ্রসর, অতিউন্নত, একবিংশ শতাব্দীর বিপন্ন মানুষ।