প্রথম পাতা

আলোচনায় মুসা বিন শমসের

শুভ্র দেব

২০২১-১০-১১

শিল্পপতি প্রিন্স মুসা বা মুসা বিন শমসেরকে বাবা বলে ডাকতেন ভুয়া অতিরিক্ত সচিব পরিচয় দেয়া আব্দুল কাদের। বাবা সম্বোধন করে তাদের মধ্যে কথা হতো। অসংখ্যবার দুজনের সাক্ষাৎ হয়েছে। ‘বাবার’ সঙ্গে তোলা একাধিক ছবি কাদেরের মোবাইলে। যেগুলো দেখাতেন কাজ ও ব্যাংক ঋণ প্রত্যাশীদের। যখন তখন ‘বাবাকে’ ফোন দিয়ে কথা বলতেন। যারা তার কাছে আসতেন তাদের সামনেও ‘বাবার’ সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন। এতে করে তাদের মধ্যে কাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা জন্মাতো। প্রিন্স মুসা তাকে ২০ কোটি টাকার একটি চেকও দিয়েছেন। চেকের নিচে তার স্বাক্ষর, নাম ও ড্যাটকো গ্রুপের চেয়ারম্যান লেখা 
সিলও রয়েছে। প্রিন্স মুসার গুলশানের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে ফ্ল্যাট কিনেছেন কাদের। এ জন্য দু’পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তিনামা হয়েছে। এ ছাড়া মুসা তাকে জুতাসহ অনেক কিছু উপহার হিসেবে দিয়েছেন বলেও দাবি করেছে কাদের। কাদের গ্রেপ্তারের পর এই শিল্পপতির নাম ঘুরে ফিরে উঠে আসছে। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর এখন সর্বত্র আলোচনায় মুসা বিন শমসের।
মাধ্যমিকের গণ্ডি না পেরোনো কাদেরের সঙ্গে সত্যিই কি প্রিন্স মুসার কোনো সম্পর্ক ছিল? এই প্রশ্ন এখন সর্বত্র। কাদের কাণ্ডে এই শিল্পপতির নাম চলে আসাতে খোদ তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেকেই বিস্মিত। আসলেই তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল নাকি এই শিল্পপতির নাম ভাঙ্গিয়ে মানুষের কাছ থেকে ফায়দা লুটেছেন কাদের। সাতদিনের রিমান্ডে থাকা কাদের দাবি করছেন প্রিন্স মুসা তাকে ছেলে হিসেবেই ভাবতেন। পরিচয়ের কিছুদিনের মধ্যে তাদের মধ্যে সখ্যতা বাড়ে। এজন্য তাদের মধ্যে ব্যবসা- বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা হতো। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন কাদেরের কাছে গেলে ঘুরেফিরে প্রিন্স মুসার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতেন। লাউড স্পিকারে মুসার সঙ্গে কথা বলতেন। বাবা বাবা বলে কথা হতো তাদের। বিভিন্ন কাজের বিষয়ে তারা কথা বলতেন। ডিবি’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রিন্স মুসার সঙ্গে কাদেরের কেমন যোগাযোগ ছিল বিষয়টি গভীর তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কাদেরের কাছ থেকে পাওয়া কিছু ডকুমেন্ট ঘাঁটাঘাঁটি করা হচ্ছে। এ নিয়ে শিল্পপতির ছেলের সঙ্গে ডিবি কার্যালয়ে কথা বলা হয়েছে।
ডিবি’র অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার গতকাল মানবজমিনকে বলেন, কাদের ইস্যুতে মুসা বিন শমসেরের নাম উঠে এসেছে। কাদেরও ওনার নাম বলেছে। আমরা বেশকিছু ডকুমেন্ট পেয়েছি। এখন বিষয়গুলো আমরা যাচাই বাছাই করে দেখবো। তিনি কোনোভাবে তার সঙ্গে জড়িত নাকি তিনি নিজেই অন্যদের মতো ভুক্তভোগী। ওনার ছেলে ডিবিতে এসেছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তারা কথা বলেছেন। আরও কথা বলা হবে।
ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কাদেরের টিমে অন্তত ১২০ নারী ছিল। যাদেরকে ব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন স্বার্থ হাসিল করতেন। এসব নারীর মধ্যে অনেকেই মডেলিংয়ের সঙ্গে জড়িত। কেউ কেউ অভিনয় জগতে কাজ করেন। বর্তমান সময়ের অনেক পরিচিত মডেল-অভিনেত্রীকে তিনি নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে কাদের তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন অনেক বিদেশি অতিথি তার কাছে আসতেন। এসব অতিথিদের খুশি করতে এবং তাদের মনোরঞ্জনের জন্য মডেলদের পাঠাতেন। চট্টগ্রাম থেকে এক নারী তাকে এসব নারী ও মডেলদের সরবরাহ করতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গুলশান-১ এর গোলচত্বরের পাশে জব্বার টাওয়ারের ১৮ তলায় কাদেরের ৬ হাজার বর্গফুটের একটি অফিস রয়েছে। নামে অফিস হলে আদতে সেখানে অফিসিয়াল কার্যক্রম হতো না। তার সহযোগী প্রতারকরা ওই অফিসে বসতেন। এখানে বসেই বিভিন্ন প্রতারণা কাজ করতেন। বিভিন্ন ঠিকাদার, সরবরাহকারী, ব্যাংক লোন প্রত্যাশীদের তার মার্কেটিং টিম গুলশানের অফিসের ঠিকানা দিতেন। তারা বলতেন একজন অতিরিক্ত সচিবের ব্যক্তিগত অফিস এটি। তিনি বিভিন্ন কাজ ও ব্যাংক লোন পেতে সহযোগিতা করবেন। পরে ভুক্তভোগীরা ওই অফিসে এসে কাদেরের সঙ্গে দেখা করতেন। দেখা করার আগে ফরম পূরণ করে নির্ধারিত ফি দিয়ে কাদেরের সঙ্গে দেখা করতে হতো। আলিশান এই অফিসে দুটি বড় বেডরুম রয়েছে। অত্যাধুনিক ডেকোরেশনের এই বেডরুম দুটি ছিল তার মনোরঞ্জনখানা। ভেতরে দুটি খাট ছাড়া আরও অনেক আসবাবপত্র আছে। এখানেই কাদের আগত অতিথিদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করতেন। বিভিন্ন মডেলদের অবাধে যাতায়াত ছিল সেখানে।
ডিবি’র জিজ্ঞাসাবাদে কাদের জানিয়েছে, টেন্ডার মোঘল জিকে শামীম গ্রেপ্তারের পর তার জামিনের জন্য কয়েকজন তার কাছে এসেছিলেন। শামীমের জামিনের জন্য একটি চুক্তি করেছিলেন। বিভিন্ন তদবির করেও পরে জামিন করাতে ব্যর্থ হন। ডিবি জানায়, মোতালেব নামের এক ব্যক্তি ব্যাংক লোন করানোর জন্য কাদেরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। পরে কথায় কথায় কাদের বলেন- গুলশানের মাটিতে ৬ হাজার বর্গফুটের এই অফিস তিনি এক রাতেই কিনেছেন। যদিও বাস্তবে ৫ লাখ টাকা ভাড়ায় ওই অফিস চালাতেন কাদের। এক রাতেই ৬ হাজার বর্গফুটের অফিস কেনার কথা শুনেই মোতালেব ব্যাংক লোন পাবার জন্য তাকে ৯০ লাখ টাকা দিয়ে দেন। পরে তার ব্যাংক লোন আর হয়নি। টাকাও ফেরত পাননি। এখন তিনি তার বিরুদ্ধে মামলা করবেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কাদের দুটি পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন। আব্দুল কাদের নামের পাসপোর্টে তার বয়স দেখানো হয়েছে ১৯৬৮ সালে। আর আব্দুল কাদের চৌধুরী নামের আরেক পাসপোর্টে দেখানো হয়েছে ১৯৮১ সাল। এক ব্যক্তি ভিন্ন নামে দুটি পাসপোর্ট ব্যবহার করার কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। ডিবি জানায়, কাদের শত শত মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন কাজের জন্য স্ট্যাম্পে চুক্তি করে কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন। বাস্তবে কারও কাজ করে দিতে পারেননি। তার গ্রেপ্তারের খবর শুনে এসব ভুক্তভোগীরা এখন ডিবি কার্যালয়ে এসে ভিড় করছেন। অনেকেই তার বিরুদ্ধে মামলা করছেন। প্রতারণা করে মানুষের কাছ থেকে নেয়া টাকা দিয়ে আবার নিজেই বিভিন্ন জমিজমা, প্লট-ফ্ল্যাটের কেনার বায়না করে রাখতেন।
ডিবি প্রধান একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, আমার কাছে অনেক ভুক্তভোগী আসছে যারা কাদেরের কাছে টাকা পায়। এখন পর্যন্ত ৫ জন আমার কাছেই এসেছে। যাদেরকে আমরা মামলা করার পরামর্শ দিচ্ছি। অনেকের কাছে টাকা দেয়ার কোনো ডকুমেন্টও নেই। না বুঝেই অনেকে টাকা দিয়েছে। কারণ পরিচয় দিয়েছে অতিরিক্ত সচিবের। এ ছাড়া আলিশান অফিস, দামি গাড়ি ব্যবহার করতো। নারী মডেলদের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে মডেলদের তথ্য আমরা পেয়েছি।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status