ঢাকা, ২ জুলাই ২০২৫, বুধবার, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৫ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

দেশ বিদেশ

ঘাটতি ৭১ হাজার কোটি টাকা

আন্দোলনে রাজস্ব আদায়ে বড় ধাক্কা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৮ মে ২০২৫, বুধবার
mzamin

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দু’টি আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠার অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে এনবিআরের কর্মকর্তাদের টানা কর্মবিরতির ঘটনায় চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। দেশ জুড়ে প্রতিটি অফিসে কার্যক্রম থমকে যাওয়ায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে সেবা পাচ্ছেন না করদাতা, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। রাজস্ব আদায় কমায় ঘাটতি ৭১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রমে স্থবিরতায় বন্দরে দেখা দিয়েছে জট। এদিকে আগামী সপ্তাহে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবে সরকার। বাজেটের আগে এরকম আন্দোলন বন্দরগুলোতে আমদানি-রপ্তানিসহ রাজস্ব আদায়ে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। 

ওদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসের পর এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ আন্দোলন স্থগিত করলেও কর্মসূচি চলমান। 
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আন্দোলন যত দীর্ঘায়িত হবে, রাজস্ব আদায়ে তত নেতিবাচক প্রভাব পড়বে- যা ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে। এই নিয়ে গত মঙ্গলবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক হলেও তাতে কোনো সন্তোষজনক সমাধান হয়নি। 

রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি: রাজস্ব আদায় প্রায় বন্ধ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার। কারণ প্রতিদিন অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা আছে। এটি আদায় না হলে চলতি বাজেট বাস্তবায়নে সংকটে পড়বে সরকার। 

জানা যায়, এমনিতেই রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের ঘাটতি চলছে। আর আন্দোলন শুরু হওয়ায় এ ঘাটতি আরও বাড়তে শুরু করেছে।
এনবিআরের সর্বশেষ তথ্যমতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস (জুলাই-এপ্রিল) শেষে রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। তবে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দেখা দিলেও গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩.২৪ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কোভিডকালীন ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১.৯৬ শতাংশ। আগামী ২রা জুন নতুন বাজেট পেশ করবেন অর্থ উপদেষ্টা। তার আগেই রাজস্ব ঘাটতির এই চিত্র সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে আছে ১৯.৯২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে (১০ মাসে) রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। 

চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা পরে সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। তবে এপ্রিল পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ২ লাখ ৮৭ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। ফলে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।
চলতি মে মাস শেষে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এনবিআর বিলুপ্ত করে জারি করা অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়েছে সংস্থাটির কার্যক্রম। 

খাতভিত্তিক রাজস্ব আদায়ের চিত্র: ভ্যাট খাতে (স্থানীয় পর্যায়ে) লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৪২২ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ২০২ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ৫.৭৯ শতাংশ। আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৮১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ১.৩৬ শতাংশ। শুধু এপ্রিল মাসেই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা, ঘাটতি দাঁড়ায় ৫ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।

বন্দরে স্থবিরতা: রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে এনবিআর কর্মকর্তাদের ১৩ দিনব্যাপী কলমবিরতি কর্মসূচি। এতে চট্টগ্রাম বন্দর, প্রধান কাস্টম হাউজ এবং বিভিন্ন স্থলবন্দরে শুল্কায়ন কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম বন্দরে ৪২ হাজারের বেশি কনটেইনার জমে গেছে, জায়গার সংকটে আরও ১৮টি জাহাজ ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। এতে তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল খালাস বিলম্বিত হচ্ছে, যা রপ্তানি কার্যক্রমে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। বেনাপোল ও তামাবিলসহ স্থলবন্দরগুলোতেও একই অবস্থা। পেট্রাপোলে ভারতীয় পাশে আটকে আছে ৫৫০ ট্রাক, তামাবিলে পাথর ও চুনাপাথর পরিবহনেও বিঘ্ন ঘটছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, চলতি পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতির অঙ্ক ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, রাজস্ব প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশিত মাত্রায় না পৌঁছালে আইএমএফের সঙ্গে ঋণচুক্তি বাস্তবায়ন জটিল হয়ে পড়বে। ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাতও কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
রপ্তানিকারকরা বলেন, ঈদের আগে কাঁচামাল না পেলে উৎপাদন ও রপ্তানি সময়মতো সম্ভব হবে না। এর প্রভাব শুধু ব্যবসা নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতেও পড়বে।

রাজস্ব আদায়ে প্রভাব: প্রতিদিন গড়ে ১৫০০-২০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা থাকলেও চলতি মাসের ১৩ দিনে আদায় কমেছে প্রায় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা। এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। মে মাসেও ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার  কথা। কিন্তু আন্দোলনের জেরে মে মাসে রাজস্ব আদায় অর্ধেকে নামতে পারে। আর্থাৎ রাজস্ব আদায় হতে পারে ১৬ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের মে মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে দৈনিক রাজস্ব আদায় হয় ১ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় না হলে দৈনিক রাজস্ব ক্ষতি আনুমানিক ১ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এ হিসাবে টানা আন্দোলনে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা। 
এনবিআরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, মে ও জুলাই মাসে রাজস্ব আদায়ের চাপ বেশি থাকে। কিন্তু কর্মকর্তাদের আন্দোলনের কারণে মে মাসের রাজস্ব আদায়ে বড় ধাক্কার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, ফলে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ২০১৯-২০ অর্থবছরের পর সবচেয়ে কম হতে পারে।

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা বলেন, বছরের মে এবং জুন মাসে সাধারণত দৈনিক দেড় থেকে ২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। সেই হিসাবে গত কয়েক দিনে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় কম হতে পারে। 

জানা গেছে, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিচালিত হয়। সেখানে আমদানি কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে। বেনাপোল কাস্টম হাউজের কার্যক্রম বন্ধ। তবে ঢাকা কাস্টম হাউজে সীমিত পরিসরে কাজ চলছে। পাশাপাশি সারা দেশেই কর ও ভ্যাট অফিসের কার্যক্রমও স্থগিত রয়েছে। এই অচলাবস্থায় বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বেশ কয়েকজন রপ্তানিকারক জানিয়েছেন, সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কায় বিদেশি ক্লায়েন্টরা যোগাযোগ করছেন। শিল্প নেতারা সতর্ক করে বলেছেন, যদি এই ব্যাঘাত দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, স্থবির থাকলে প্রতিদিন অর্থনীতিতে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। চালান আসতে না পারায় অর্ডার বাতিল ও মূল্যছাড় না পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে। এতে করে আমাদের বিশ্ববাজারে সুনাম চরম ঝুঁকিতে পড়বে। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ খান এই উদ্বেগের কথা বলেছেন। 

বিজিএমইএ’র সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, আমদানিকৃত কাঁচামাল খালাসে বিলম্ব হচ্ছে বিধায় একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে, অন্যদিকে রপ্তানির লিড টাইম বেড়ে যাবে। এ কারণে রপ্তানি খাতে ইমেজ সংকটও দেখা দিতে পারে। এই অচলাবস্থা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে, যার প্রভাবে তারা অর্ডার কমিয়ে দিতে পারেন।

 

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status