দেশ বিদেশ
সড়ক-মহাসড়কে গতি নির্ধারণ বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন
স্টাফ রিপোর্টার
১০ মে ২০২৪, শুক্রবারদেশের সড়ক অনুযায়ী মোটরযানের আলাদা গতিসীমা নির্ধারণ করে দিচ্ছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। গত রোববার এ সংক্রান্ত একটি বিধিমালার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে দেশব্যাপী সড়ক-মহাসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে ও মহানগরীর সড়কে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, বাস-ট্রাক, মিনিবাস আলাদা গতিসীমার মধ্যে চলবে। গতকাল থেকে এ বিধিমালা কার্যকর করা হয়।
বিধিমালা অনুযায়ী, এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার, জাতীয়, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়কে ৫০ কিলোমিটার, সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/জেলা সদর/উপজেলা মহাসড়ক ও শহর এলাকায় প্রাইমারি আরবান সড়কে ৩০ কিলোমিটার, শেয়ার রোড ও অন্যান্য সড়ক এবং গ্রামীণ সড়কে ২০ কিলোমিটার। মোটরকার, জিপ, মাইক্রোবাস, হালকা যাত্রীবাহী মোটরযান এবং বাস-মিনিবাস ও ভারী যাত্রীবাহী মোটরযানের ক্ষেত্রে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিসীমা এক্সপ্রেসওয়েতে ৮০ কিলোমিটার, জাতীয় মহাসড়কে (ক্যাটাগরি-এ) ৮০ কিলোমিটার, জাতীয় (ক্যাটাগরি-বি) ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ৭০ কিলোমিটার, জেলা সড়কে ৬০ কিলোমিটার, সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/জেলা সদরে ৪০ কিলোমিটার, উপজেলা মহাসড়ক ও শহর এলাকায় প্রাইমারি আরবান সড়কে ৪০ কিলোমিটার, শেয়ার রোড ও অন্যান্য সড়ক এবং গ্রামীণ সড়কে ৩০ কিলোমিটার। ট্রাক, মিনি ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ মালবাহী মোটরযান এবং ট্রেইলারযুক্ত আর্টিকুলেটেড মোটরযানের ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিসীমা এক্সপ্রেসওয়েতে ৫০ কিলোমিটার, জাতীয় মহাসড়কে (ক্যাটাগরি-এ) ৫০ কিলোমিটার, জাতীয় (ক্যাটাগরি-বি) ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ৪৫ কিলোমিটার, জেলা সড়কে ৪০ কিলোমিটার, সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/জেলা সদরে ৩০ কিলোমিটার, উপজেলা মহাসড়ক ও শহর এলাকায় প্রাইমারি আরবান সড়কে ৩০ কিলোমিটার, শেয়ার রোড ও অন্যান্য সড়ক এবং গ্রামীণ সড়কে ৩০ কিলোমিটার।
এই গতিসীমা নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। বলছেন, বিদেশের চেয়ে আমাদের দেশে সড়ক পথে ব্যয়ের খরচ দেড়-দুই গুণ বেশি হয়। ভারতেও অর্ধেক খরচ করে এক্সপ্রেসওয়েতে ১৩০ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চালানো হয়। তবে বাংলাদেশে কেন সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার হবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের আশপাশের সবগুলো দেশের এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহনের গতিসীমা ১২০-১৩০ হয়ে থাকে। এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করাই হয় মূলত, দ্রুত গতিতে চলার জন্য।
মোটরসাইকেল, প্রাইভেট-মাইক্রো, বাস-মিনিবাস ও ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের মতো ভারী যানবাহনের জন্য আলাদা গতিসীমা নির্ধারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গতির তারতম্য হওয়া মাত্রই শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না। মোটরসাইকেলের পেছনে যদি একটা ৪ চাকার যানবাহন পড়ে সে তো বাধ্য হয়ে বারবার লেন পরিবর্তন করবে। আমাদের তো লেনভিত্তিক গাড়ি চলে না। তাহলে দরকার ছিল আগে লেন নির্ধারণ করা। লেনভিত্তিক যানবাহন চললে তখন আলাদা গতিসীমা দেয়া যেতো। তাহলে দুর্ঘটনা ঘটতো না।
অযৌক্তিক, যেটা কখনো প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না সেই আইন প্রতিনিয়ত মানুষ ভাঙবে এবং এতে সড়কের বিশৃঙ্খলা কমবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক। তিনি মানবজমিনকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় উপযোগিতার বিষয়ে বলা হয়েছিল দ্রুত গতিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখা। এখন যে গতিতে চলে তার থেকে দ্রুত গতিতে চললে সময়ের মূল্য ও পরিবহনের খরচ সাশ্রয় হবে। এক্সপ্রেসওয়ে বানানোই হয় দ্রুতগতিতে চালানোর জন্য। যারা আমাদের দেশের সড়কের জন্য গতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন তারা মনে হয় বিজ্ঞানের ধারেকাছে নেই। সেজন্য এটা নির্ধারণ করেছেন।
পাশের দেশগুলো উদাহরণ দিয়ে এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ভারতে এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চালাচ্ছে ১৩০ কিলোমিটার গতিতে, শ্রীলঙ্কা চালাচ্ছে ১১০ কিলোমিটার গতিতে। অন্যান্য দেশে ১৪০ কিলোমিটার আছে। আবার কোনো কোনো দেশে গতির কোনো লিমিটও নেই। কিন্তু তারা সুশৃঙ্খলভাবে চালায়। সেখানে দেখা হয় গাড়ি যে গতিতে চালাচ্ছে সেটা কি লেন অনুযায়ী সম্পর্কযুক্ত কিনা। অতএব, গতির একটা ধাপ থাকবে। বাঁ দিকে লেনে কম গতি, তার পরেরটা বেশি গতি, তার পরেরটা আরও বেশি গতি।
গতিসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, পুরো পৃথিবী প্রযুক্তির মাধ্যমে গতিসীমা পরিবর্তন করে। তারা ডিজিটাল প্লেটে গতিসীমা লিখে রাখে। সেখানে যে সড়ক সকালে ৮০ কিলোমিটার গতি হয় কখনো কখনো এটা ৫০ কিলোমিটারেও আসতে পারে। কখনো এটা ১১০ কিলোমিটারেও নিতে পারে। এটা তাৎক্ষণিক একদল টেকনিক্যাল লোক বসে নিয়ন্ত্রণ করে। আর আমরা প্লেটে লিখে স্থির করে দেই। সকালে ফাঁকা রাস্তায়ও বলছি ৫০ কিলোমিটারে চালাও। কোনো দিন সেভাবে চালাবে না। সে দ্রুত গতিতেই চালাবে। তাই পরিবেশের ওপর নির্ভর করে গতিসীমা নির্ধারণ করা উচিত। কিন্তু আমরা যদি অন্যায্য একটা স্থির গতি দিয়ে দেই তাহলে গতির একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।
এক্সপ্রেসওয়ে ও জাতীয় মহাসড়কে (ক্যাটাগরি-এ) ও (ক্যাটাগরি-বি) এবং আঞ্চলিক মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জেলা সড়ক, সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/জেলা সদর, উপজেলা মহাসড়ক ও শহর এলাকায় প্রাইমারি আরবান সড়কে চলাচলের অনুমতি সাপেক্ষে সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার গতিতে থ্রি-হুইলার চলতে পারবে। এ ছাড়া শেয়ার রোড ও অন্যান্য সড়ক এবং গ্রামীণ সড়কে সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ২০ ও ৩০ কিলোমিটার গতিতে থ্রি-হুইলার চলতে পারবে।
মঙ্গলবার বিআরটিএ’র সাধারণ নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সড়কের শ্রেণি ও মোটরযানের শ্রেণি/ধরন অনুযায়ী উপরে বর্ণিত গতিসীমাই হবে সর্বোচ্চ গতিসীমা। এ গতিসীমা মেনে সড়ক মহাসড়কে মোটরযান চালাতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা এবং হাট-বাজার সংলগ্ন সড়ক বা মহাসড়কে মোটরযানের সর্বোচ্চ গতিসীমা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বা রাস্তা নির্মাণকারী বা উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্ধারিত হবে; তবে তা কোনো ক্রমেই জাতীয় মহাসড়কের ক্ষেত্রে ৪০ কিলোমিটার/ঘণ্টা এবং আঞ্চলিক মহাসড়কের ক্ষেত্রে ৩০ কিলোমিটার/ঘণ্টার অধিক হবে না। জরুরি পরিষেবায় নিয়োজিত মোটরযান, যেমন: এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের ক্ষেত্রে এই গতিসীমা শিথিলযোগ্য হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ গতিসীমার এই বাধ্যবাধকতা শুধু স্বাভাবিক অবস্থায় প্রযোজ্য হবে; দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, প্রখর রোদ, অতিরিক্ত বৃষ্টি, ঘনকুয়াশাসহ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণযোগ্য নিরাপদ গতিসীমা প্রযোজ্য হবে; দৃষ্টিসীমা বেশি মাত্রায় কমে গেলে বা একেবারেই দেখা না গেলে মোটরযান চালানো বন্ধ রাখতে হবে; এক্সপ্রেসওয়ে, জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়কের উভয়দিকের প্রবেশমুখ ও নির্দিষ্ট দূরত্বে যানবাহনভিত্তিক নির্ধারিত গতিসীমা সংক্রান্ত সাইন রাস্তা নির্মাণকারী বা উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে প্রদর্শন করতে হবে; মোটরযানের শ্রেণি/ধরন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন গতিসীমার জন্য একই পোস্টে মোটরযানের নাম ও ছবি সম্বলিত গতিসীমার সাইন প্রদর্শন করতে হবে; এবং পাহাড়ি এলাকা, আঁকাবাঁকা সড়ক, বাঁক, ব্রিজ, রেল বা লেভেলক্রসিং, সড়ক সংযোগস্থল, বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সামনে সাইনে প্রদর্শিত গতিসীমা প্রযোজ্য হবে।
বিআরটিএ’র বিশেষ নির্দেশনায় যা বলা হয়েছে, সড়ক বাঁক, জাংশন, জ্যামিতিক কাঠামো, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট রাস্তা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে মোটরযানের শ্রেণি/ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য ট্রাফিক সাইন ম্যানুয়াল অনুযায়ী স্ট্যান্ডার্ড ট্রাফিক সাইন পোস্ট ও গতিসীমা প্রদর্শন/স্থাপন করবে। মালবাহী মোটরযানসহ অন্যান্য স্বল্পগতির মোটর যান সর্বদা সড়কের বামপাশের লেন দিয়ে চলাচল করবে। শুধু ওভারটেক করার সময় ডান লেন ব্যবহার করতে পারবে, কখনো বাম লেন দিয়ে ওভারটেক করা যাবে না। ওভারটেকিং নিষিদ্ধ না থাকলে রাস্তার ট্রাফিক সাইন, রোডমার্কিং দেখে এবং সামনে, পেছনে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় জায়গা থাকলে নিরাপদ পরিস্থিতি বিবেচনায় ওভারটেক করা যাবে; এবং ওভারটেক করার সময় সামনে বিপরীত লেনে আসা গাড়ি এবং পেছনের গাড়ির অবস্থান ও গতিবেগ দেখে ওভারটেকিংয়ের জন্য নিরাপদ দূরত্ব আছে কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
বিশেষ নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, এ নির্দেশিকায় উল্লিখিত গতিসীমা অমান্য করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।