ঢাকা, ১৯ মে ২০২৪, রবিবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনা বাড়ছে

শুভ্র দেব
৫ মে ২০২৪, রবিবার
mzamin

বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার কাঠাদুরো গ্রামের মিন্টু মোল্যার ছেলে তীব্র মোল্যা। তিনি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার গোবরা মাদ্রাসাপাড়া এলাকার মামা সাইমন চৌধুরীর বাসায় থেকে লেখাপড়া করতেন। সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের ব্যাচেলর অব বিজনেস স্টাডি (বিবিএস) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পহেলা মে নাহিম চৌধুরী নামের একজনকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে গোবরা এলাকায় যাচ্ছিলেন। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার টুঙ্গিপাড়া সড়কের এলজিইডি মোড়ে আসার পর তীব্র মোল্যা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি দেয়ালে ধাক্কা দেন। এ সময় তিনি এবং নাহিম মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে তীব্র মোল্যাকে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে গত মাসের শেষ সপ্তাহে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার একটি বাজার থেকে মধ্যরাতে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন তিনজন। তারা সবাই একই মোটরসাইকেলে ছিলেন। তাদের বহনকারী মোটরসাইকেলটি জকিগঞ্জ-সিলেট সড়কের বারঠাকুরী গ্রামের কাছে ইটভাটার সামনে যাওয়া মাত্র একটি ট্রাক তাদেরকে ধাক্কা দেয়।

বিজ্ঞাপন
এতে তিনজনই ছিটকে পড়ে গুরুতর আহত হন। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় রাবেয়া খাতুন চৌধুরী হাসপাতালে নিয়ে গেলে রেদোয়ান ও মঞ্জুর নামের দুইজনকে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এরপর আরেক আহত দেলোয়ার হোসেনকে সিলেটে নিয়ে যাওয়ার পথে তারও মৃত্যু হয়। 

এই চিত্র শুধু সিলেট আর গোপালগঞ্জে নয়। সারা দেশেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। বিগত প্রতিটি বছরই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর রেকর্ড ভেঙেছে। চলতি বছরেও তার কমতি হবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোট দুর্ঘটনার অর্ধেক বা কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু হচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে মোটরসাইকেলের বৃদ্ধি। সড়কে যেমন মুড়ি-মুড়কির মতো করে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে ঠিক তেমনি দুর্ঘটনাও বাড়ছে। কিছু কিছু দুর্ঘটনা এতটা মর্মান্তিক ও বেদনাদায়কভাবে হচ্ছে যা দেখে নিহতদের প্রতি নানাভাবে মানুষ সমবেদনা জানায়। একেকটি দুর্ঘটনার কারণে একেকটি পরিবারের স্বপ্নও অঙ্কুরেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেভাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে সেভাবে এটি নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অদক্ষ চালক, বেপরোয়া, লাইসেন্সের সহজলভ্যতা, প্রশিক্ষণ ছাড়া গাড়ি চালানো, আইন না মানা, বেপরোয়া গতিসহ নানা কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে। আবার অনেক সময় অন্যান্য যানবাহনের কারণেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে। বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক গবেষণা বলছে- দেশে প্রতিনিয়তই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। সংস্থাটির দাবি, গত পাঁচ বছরে (২০২৩ সাল পর্যন্ত) মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার বেড়েছে ১৬ শতাংশ। আর এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। সারা দেশে  ৪৩ লাখ ৪৩ হাজার ৮৮৩ মোটরসাইকেল যেন একেকটি মৃত্যুদূত। অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের কারণে এসব মোটরসাইকেল হর-হামেশা মৃত্যু ডেকে আনছে। 
নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকার কারণে সহজেই মোটরসাইকেল চালাতে পারছেন। ট্রাফিকের মামলা থেকে বাঁচার জন্য অনেকেই অসাধু কর্মকর্তা ও দালালদের মাধ্যমে ঘুষ দিয়ে সহজেই ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছেন। চালকরা নিয়মনীতি ও নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালান। তারা বেপরোয়া গতিতে চালালেও নিরাপত্তার জন্য হেলমেট ব্যবহার করেন না। যারা করেন তারা মান সম্মত হেলমেট ব্যবহার করছেন না। হেলমেট না থাকার কারণে অনেকেই দুর্ঘটনার পর মৃত্যুবরণ করছেন। অথচ মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার করলে মৃত্যু অনেকটা কমানো যেতো। 

রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে মোট ৬ হাজার ৯১১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৫২৪ জন। এরমধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৫৩২টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৪৮৭ জন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ৯৪৩ জন। নিহতদের মধ্যে ৭৫ দশমিক ৩৯ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছর। যাত্রীকল্যাণ সমিতির ২০২৩ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে ওই বছর  ২ হাজার ৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ১৫২ জন। যা মোট মৃত্যুর ২৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। মোট দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাবে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনা কবলিত মোট যানবাহনের ১ হাজার ৭৪৭টি মোটরসাইকেল। যা মোট যানবাহনের ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ। 

২০২৩ সালের প্রথম ৩ মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে ৪৩ দশমিক সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। একইভাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাও চলতি বছরে বেড়েছে। এ ছাড়া রোজার ঈদের আগে পরে মিলিয়ে মাত্র ১৫ দিনে ৩৯৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪০৭ জন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ৩৯৮ জন। এরমধ্যে ১৯৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৫ জন নিহত হয়েছেন। যা মোট দুর্ঘটনার ৪৯.৬২ শতাংশ, নিহতের ৪০. ৫৪ শতাংশ।  
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিভাগে রেজিষ্ট্রেশনকৃত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ১১ লাখ ১৪ হাজার ৮০১টি। এরমধ্যে ২০১০ সাল পর্যন্ত রেজিষ্ট্রেশনকৃত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল  ২ লাখ ১০ হাজার ৮৭৯টি। 

সংস্থাটির তথ্যমতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে রেজিষ্ট্রেশনকৃত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৪৩ লাখ ৪৩ হাজার ৮৮৩টি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশে মোটরসাইকেল অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি হচ্ছে। দুর্ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে অদক্ষ চালক। কারণ দেশে মোটরসাইকেল চালানোর জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা লাগে না। এ ছাড়া লাইসেন্স পাওয়া কোনো বিষয় না। এ কারণে যেনতেন ব্যক্তিরা মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। দুই চাকার গাড়ি যিনি চালান তিনি যদি সাবধান থেকে না চালান তবে দুর্ঘটনা ঘটবে।  দেশে যারা মোটরসাইকেল চালাচ্ছে তাদের আইন ভাঙার প্রবণতা বেশি। আরেকটা হতাশার বড় কারণ হচ্ছে হেলমেট। হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। কিন্তু যারা হেলমেট পরছে তারাও মানসম্মত হেলমেট পরে না। শুধুমাত্র ট্রাফিকের জরিমানা থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ মানের হেলমেট পরছে। তারা যে ধরনের হেলমেট পরছে এটিতে নিরাপত্তা দিতে পারে না। কোনো ক্ষেত্রে প্রাণহানি বেড়ে যায়। এ ছাড়া অনেক লাইসেন্সবিহীন চালক রয়েছে। অনেক রাইড শেয়ারিং কোম্পানি আছে তারা শুধু অ্যাপস্‌ চালানোর শিক্ষা দেয় কিন্তু মোটরসাইকেল কীভাবে চালাতে হবে সেই শিক্ষা দেয় না। অথচ তাদের সেইফটি, রুলস নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ দেয় না। মোটকথা মোটরসাইকেল যেভাবে বাড়ছে তেমনি দুর্ঘটনাও বাড়ছে। 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, আমাদের কাছাকাছি যেসব দেশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে তারা হয় মোটরসাইকেল তাদের দেশে নিষিদ্ধ করেছে। না হয় চলাচল সীমিত করেছে। তাই যেসব দেশে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে দুর্ঘটনা কমিয়েছে তাদের পদ্ধতিগুলো আমাদেরও অনুসরণ করা দরকার। তিনি বলেন, আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকরা দুর্ঘটনা কমানোর জন্য চলাচল সীমিত বা নিষিদ্ধ করবে এরকম কিছুই দেখছি না। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সময় দাবি তুলছি। দাবিগুলো জনসম্মুখে নিয়ে আসছি। সরকারের কানে যাতে পৌঁছায় সে চেষ্টা করছি। তবে সরকার দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য অঙ্গীকার করেছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতেও অঙ্গীকার করেছে। ট্রাফিক ডিভিশনের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়িয়ে যায় তাহলে সুশাসন নিশ্চিত করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। ভারতের যানবাহন আমাদের মতো বেপরোয়া নয়। কারণ তাদের যানবাহনের জন্য গতিসীমা নির্ধারণ করা আছে। এই গতি সীমার মধ্যেই সবাই চলে। তারা লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছে। সারা বিশ্বে যেভাবে আইন প্রয়োগ হয় সেভাবে আমাদের দেশে পারছি না। যেমন ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা যেতো তবে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা যেতো।
 

পাঠকের মতামত

রিপোর্টটি সময়পযোগী। তবে দেশে যদি নিরাপদ সড়ক আইন থাকতো তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে তমিয়ে আনা সম্ভভ হতো।

তরিকুল ইসলাম
৫ মে ২০২৪, রবিবার, ২:৪০ অপরাহ্ন

বাইক হলো অত্যাবশ্যকীয় পরিবহন যখন আমার ছিল না। তখন কত কষ্ট করে চলাচল করেছি তা এখন উপলব্ধি করতে পারি। তবে বাইক অবশ্যই ঝুঁকি পূর্ণ্য পরিবহন আমার মতে এ বি এস যুক্ত ডাবল ডিস্ক ছাড়া আমদানি ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা। সর্বোচ্চ ১৫০ সি সির বেশি অনুমোদন না দেওয়া। চাকার সাইজ ১২০ এর নিচে অনুমতি না দেওয়া। যত্রতত্র বাইক চালাতে না পারে এই জন্য বাম পাশে তিন ফুট রাস্তা ফাকা রাখা। শহর এলাকায় সর্বোচ্চ ৬০ এবং হাইওয়ে সর্বোচ্চ ৮০ কি মি এর বেশি চালাতে না দেওয়া। ১৮ বছর বয়সের নিচে লাইসেন্স না দেওয়া। তা হলে দুর্ঘটনা কমে যাবে বহ লাংশে ।

জাহিদ মিয়া
৫ মে ২০২৪, রবিবার, ১২:৪০ অপরাহ্ন

হাইওয়েতে মোটর সাইকেল চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেই সমস্যাটির ৮০% সমাধান হয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি। কারণ শতকরা ৯০ শতাংশ মারাত্মক এক্সিডেন্টই হচ্ছে হাইওয়েতে।

দয়াল মাসুদ
৫ মে ২০২৪, রবিবার, ১০:৪৫ পূর্বাহ্ন

চাকুরীজীবি ছাড়া অন্য সব মোটরসাইকেলের লাইসেন্স সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিন। কি হয় দেখুন।

Anwarul Azam
৫ মে ২০২৪, রবিবার, ৫:০৯ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status