বিশ্বজমিন
পশ্চিমতীরে যেভাবে যুদ্ধাপরাধ করছে ইসরাইল
মানবজমিন ডেস্ক
(২ সপ্তাহ আগে) ২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:৩০ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:২০ অপরাহ্ন
২০২৩ সালের ২৯শে নভেম্বর। বিকেলবেলা। কয়েকটি ফিলিস্তিনি বালক দখলীকৃত পশ্চিমতীরে সড়কের ওপর ঘোরাফেরা করছিল। তারা মাঝে মাঝেই একসঙ্গে খেলাধুলা করতে এখানে সমবেত হয়। কয়েক মিনিট পরেই ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে তাদের মধ্যে দু’জন- বাসিল (১৫) ও আদম (৮)-এর মৃতদেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেদিন পশ্চিমতীরে কি হয়েছিল তা নিয়ে তদন্ত করেছে বিবিসি। তারা দেখার চেষ্টা করেছে কেন ওই দুটি শিশুকে হত্যা করেছে ইসরাইলিরা। তারা এমনিতেই কমপক্ষে অর্ধ শতাব্দী ধরে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে দখল করে আছে পশ্চিম তীর। বিবিসি তার অনুসন্ধানে মোবাইল ফোন, সিসিটিভি ফুটেজ, ইসরাইলি সেনাদের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য, ঘটনাস্থলের বিস্তারিত তদন্ত সহ সব বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে। তাতে এটা প্রমাণ হয় যে, সেখানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে ইসরাইলি বাহিনী।
৭ই অক্টোবর হামাস ইসরাইলে রকেট হামলা করে। তখন থেকেই পশ্চিমতীরে সহিংসতা দেখা দিয়েছে। সেখানে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ভেঙে দেয়ার তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে বিবিসি। ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষকে সেখানে অস্ত্র ব্যবহার করে হুমকি দেয়া হয়েছে। তাদেরকে প্রতিবেশীকে জর্ডানে চলে যেতে বলা হয়েছে। ফিলিস্তিনি একজন অস্ত্রধারীর গলিত মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২৯শে নভেম্বরের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একটি হার্ডওয়্যার স্টোরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বাসিল। দোকানটির সাটার নামিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা। ইসরাইলি সেনারা পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমতীরের শহর জেনিনের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ্য, পশ্চিমতীরও ফিলিস্তিনের অংশ, কিন্তু গাজার মতো তা হামাস শাসন করে না। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, জেনিন শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি সেনারা আকস্মিক গুলি করা শুরু করে।
নিহত আদম ছিল ফুটবলের খুব ভক্ত। একই সঙ্গে ফুটবলের কিংবদন্তি লিয়নেল মেসিরও ভক্ত সে। তার ১৪ বছর বয়সী ভাই বাহারের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে। সিসিটিভির ক্যামেরায় দেখা যায়, সব মিলে ওই সড়কে সেদিন প্রায় ৯টি বালক উপস্থিত ছিল। ওই সিসিটিভিতে আশপাশে কি ঘটেছে তা সবদিক থেকে দেখায়। এর কয়েক মিটার দূরে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কমপক্ষে ৬টি সশস্ত্র যান একটি প্রান্তে গিয়ে অবস্থান নেয়। তারা ওই বালকদের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। এতে বালকরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কয়েকটি বালক দৌড়ে সরে যেতে শুরু করে। ঠিক এই সময়ে একটি মোবাইল ফোনের ফুটেজে দেখা যায়, একটি সাঁজোয়া গাড়ির দরজা সামনের দিক থেকে খুলে যায়। এর ভিতরে থাকা সেনা পরিষ্কারভাবে সরাসরি বালকদের দেখতে পাচ্ছিলেন। রাস্তার মাঝখানে চলে গিয়েছিল বাসিল। সেনাদের থেকে ১২ মিটার দূরে ছিল আদম। সে দৌড়াচ্ছিল।
এরপরই কমপক্ষে ১১টি গুলি করা হয়।
ঘটনাস্থল পরীক্ষা করে বিবিসি পুরো এলাকায় গুলির আঘাত দেখতে পেয়েছে। চারটি গুলি আঘাত হেনেছে একটি ধাতব খুঁটিতে। দুটি গুলি বিদ্ধ হয়েছে হার্ডওয়্যারের দোকানের সাটারে। একটি গুলি পার্ক করে রাখা একটি গাড়ির বাম্পারের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। আরেকটি গুলি আঘাত করেছে সিঁড়িতে। মেডিকেল রিপোর্টে বিবিসি দেখতে পেয়েছে, বাসিলের বুকে আঘাত করেছে দুটি গুলি। আরেকটি গুলি আট বছরের আদামের মাথার পিছন দিয়ে আঘাত করেছে। তার বড়ভাই বাহা তার দেহকে টেনে নেয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। এতে আদমের শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। আর একটি এম্বুলেন্সের জন্য চিৎকার করছিল বাহা। কিন্তু এম্বুলেন্স আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়। বাহা বলে, আদম ও তার বন্ধু বাসিল তারই সামনে মারা যায়।
অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বাহা বলেছে- আমি হতাশাজনক এক অবস্থায় ছিলাম। কি করতে হবে বুঝে উঠছিলাম না। ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। আমি তাকে ডেকেছি- আদম, আদম! কিন্তু ততক্ষণে তার দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে গেছে। সে আমার কোনো কথার উত্তর দেয়নি।
গুলি করার আগে বাসিলের হাতে কিছু একটা ধরে রাখতে দেখা গেছে। এটা কি তা পরিষ্কার নয়। পরে আইডিএফ একটি ছবি শেয়ার করেছে ঘটনাস্থল থেকে। তাতে তারা দাবি করেছে, এটা ছিল একটি বিস্ফোরক ডিভাইস। বিবিসি লিখেছে, আমরা ঘটনাস্থলে তদন্ত করে যেসব তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি তা বেশ কিছু মানবাধিকার আইনজীবী, যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক একজন তদন্তকারী, একজন সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষজ্ঞ, জাতিসংঘ ও অন্য নিরপেক্ষ সংস্থাসহ বিভিন্ন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শেয়ার করেছি। তাদের অনেকেই যে বিশ্লেষণ দিয়েছেন, তাতে নাম প্রকাশ করতে চান নি। বিশেষজ্ঞরা একমত হয়েছেন যে এ ঘটনার তদন্ত হওয়া দরকার। অন্যরা আরও একটু বাড়িয়ে বলেছেন। তারা বলেছেন, দৃশ্যত এ ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। বেন সল বলেছেন, যদি তার কাছে বিস্ফোরক থাকেও, তবু বাসিলের ক্ষেত্রে আইনগতভাবে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অন্যদিকে আদমের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের আইনের বিধান ইচ্ছাকৃতভাবে, বৈষম্যমূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে নিরীহ মানুষের ওপর আক্রমণ চালাতে। এটা যুদ্ধাপরাধ। জীবনের জন্য মানবিক অধিকারেরও লঙ্ঘন এটা। ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ল’-এর সহ-পরিচালক ড. লরেন্স হিল কাউথোর্ন বলেন, সেনাবাহিনী সাঁজোয়া যানে ছিল। এমনকি যদি সেখানে হুমকিও থাকতো, তাদের সরে যাওয়া উচিত ছিল এবং পরিকল্পনা নিয়ে গ্রেপ্তার করতে পারতো। তার পরিবর্তে তারা বৈষম্যহীণভাবে, প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার করেছে। এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
আরব দেশ গুলো হামাসকে মুক্তিবাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেশে দেওয়া উচিত।