শেষের পাতা

এমসি কলেজে গণধর্ষণ

ভারত পালানোর সময় গ্রেপ্তার সাইফুর-অর্জুন

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার, ৯:৪১ পূর্বাহ্ন

স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে ‘গ্যাং রেপের’ পর দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টায় ছিল ধর্ষকরা। এ কারণে একেক জন ছুটে গিয়েছিল একেক সীমান্ত এলাকায়। কিন্তু পুলিশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে ধরা পড়েছে আলোচিত এ ধর্ষণ ঘটনার মূল হোতা সাইফুর রহমান ও অর্জুন লস্কর। ভারত পালিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে ছাতক থেকে সাইফুর রহমানকে ও হবিগঞ্জের মনতলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় অর্জুন লস্করকে। গতকাল ভোরে দুই জনকে গ্রেপ্তারের পর সিলেট মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত দুইজন ধর্ষণের ঘটনা স্বীকার করেছে। আজ তাদের আদালতে তোলা হবে। এদিকে পলাতক থাকা অপর আসামিদের  গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক টিম অভিযানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) জ্যোর্তিময় সরকার। তিনি জানিয়েছেন, পুলিশের দুটি দল গতকাল ভোরে সাইফুর রহমানকে ছাতক ও অর্জুনকে মনতলা থেকে গ্রেপ্তার করে। তারা এখন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। এদিকে অভিযানে থাকা পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ধর্ষণের ঘটনার পর মূল হোতা সাইফুর রহমান সিলেট শহর থেকে পালিয়ে যায়। সে নিজেকে রক্ষা করতে ঘটনার রাতেই দাড়ি ছেঁটে ফেলে। এবং চুল ছোট করে ফেলে। ফলে তাকে অনেকটা  চেনাই যাচ্ছিলো না। গতকাল রোববার সকালে সাইফুর রহমান সীমান্ত এলাকার ইসলামপুরে যেতে নদী পাড়ি দিতে ছাতকের ফেরিঘাটে যায়। এ সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সাইফুরকে আটক করা হয়। কিন্তু সাইফুরের ছবির সঙ্গে তার চেহারার মিল হচ্ছিলো না। সে দাড়ি কেটে দেয়। এবং চুলও ছোট করে ফেলে। তাকে গ্রেপ্তারের পর তারা সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের শাহপরান থানায় যোগাযোগ করেন। পরে দুপুর ১২টার দিকে শাহপরান থানা পুলিশ তাকে নিয়ে আসে। তিনি জানান, সাইফুর ভারত পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিনা সে ব্যাপারে তারা কিছুই জানেন না। তবে সাইফুরের গন্তব্য ছিল সীমান্তবর্তী ইসলামপুর। সেটি দোয়ারাবাজার উপজেলায় অবস্থিত। ওখান থেকে সে ভারতে পাড়ি দিতে চেয়েছিলো। গ্রেপ্তার হওয়া সাইফুর রহমানের বাড়ি বালাগঞ্জ উপজেলায়। এদিকে অর্জুনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকেই। হবিগঞ্জের মনতলার দুর্লভপুর গ্রাম একেবারে সীমান্তবর্তী। সিলেট থেকে পালিয়ে ওই গ্রামেই অবস্থান নিয়েছিলো অর্জুন। সিলেট জেলা পুলিশের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার নেতৃত্বে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে  রোববার ভোরে অভিযান চালায়। পরে ওখান থেকে অর্জুন লস্করকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ জানায়, ভারত পাড়ি দিতেই সে সীমান্তবর্তী গ্রামে অবস্থান নেয়। সীমান্ত পাড়ি দেয়ার আগেই তাকে আটক করা হয়। এদিকে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। তবে তারা নানা তথ্য দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। শুধু এই ঘটনাই নয়, এমসি কলেজকেন্দ্রিক নানা ঘটনায় জড়িত ছিল সাইফুর রহমান। এর আগে তার বিরুদ্ধে ডাকাতিসহ আরো অনেক ঘটনার প্রমাণ ও শাহপরান থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। চিহ্নিত অপরাধী সে। তার নেতৃত্বে ছিনতাইসহ নানা ঘটনা ঘটতো এমসি কলেজের ছাত্রাবাস এলাকায়। এদিকে ধর্ষকরা দেশ ছেড়ে পালাতে পারে- এই আশঙ্কায় সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বিজিবি সতর্ক রয়েছে। এখনো গ্রেপ্তার হয়নি এজাহারনামীয় ৪ আসামি। আসামি শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি, তারিকুল ইসলাম তারেক, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম পলাতক রয়েছে। এডিসি মিডিয়া জানান, আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশ কোনো গাফিলতি করছে না। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এমসি কলেজে গণধর্ষণের ঘটনা নতুন হলেও আশেপাশের এলাকায় অতীতে এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। বান্ধবীদের নিয়ে বেড়াতে গিয়ে এই চক্রের হাতে অনেক নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। সাইফুর-রনির নেতৃত্বে ওই চক্র ছিনতাইয়ের আখড়ায় পরিণত করেছিলো ওই এলাকা। তারা প্রতি রাতেই ছিনতাই করতো। এর বাইরে ইয়াবা সেবনের আড্ডা বসাতো। এমসির ছাত্রাবাস এলাকায়ই তারা ইয়াবা সেবন করতো। এসব দৃশ্য ক্যাম্পাসে বসবাসকারী ছাত্ররা জানলেও কখনোই প্রতিবাদ করতো না। এমসির ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনায় টিলাগড় ছাত্রলীগের একাংশ গতকাল দুপুরেও এমসির ফটকে বিক্ষোভ করেছে। দুপুরে জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের ব্যানারে তারা এই কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচিতে তারা বলেন, অস্বীকার করার উপায় নেই ধর্ষকরা ছাত্রলীগের না। ওদের লালনপালন করে তাদের অপরাধী হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। তারা ধর্ষকদের শেল্টারদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
মেয়রের পদযাত্রা: সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমসি কলেজে তরুণী গণধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে মহানগর পুলিশ কার্যালয় অভিমুখে ‘পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররা। এর আগে দুপুরে নগর ভবনে সিসিক মেয়র আরিফুল হক  চৌধুরীর সভাপতিত্বে কাউন্সিলরদের নিয়ে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এমসি কলেজের তরুণী গণধর্ষণের ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান কাউন্সিলররা। জরুরি সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডে নাগরিক প্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, অভিভাবক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হবে। সভা শেষে নগর ভবন থেকে প্রতিবাদী কর্মসূচির অংশ হিসেবে সিলেট মহানগর পুলিশ কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা করেন  মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও কাউন্সিলরবৃন্দ। নগরীর উপ-শহরস্থ মহানগর পুলিশ কার্যালয়ে গিয়ে পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও সিসিকের কাউন্সিলররা। পবিত্র নগরী সিলেটে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা মহানগরবাসীর জন্য উদ্বেগজনক উল্লেখ করে মেয়র আরিফুল হক  চৌধুরী বলেন, আধ্যাত্মিক মর্যাদার এই নগরীকে আমরা স্মার্ট পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি। কিন্তু এই নগরীতে একজন পর্যটক যদি এমন নিকৃষ্ট ঘটনার শিকার হন তবে আমরা জনপ্রতিনিধি হয়ে লজ্জিত না হয়ে পারি না। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত সন্তু, কাউন্সিলর রেজাউল হাসান লোদী, কাউন্সিলর তৌফিক বক্‌স, কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান, কাউন্সিলর সৈয়দ তৌফিকুল হাদী, কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান, কাউন্সিলর এবিএম উজ্জলুর রহমান, কাউন্সিলর মো. আব্দুর রকিব তুহিন, কাউন্সিলর মো. ছয়ফুল আমীন, কাউন্সিলর আব্দুল মুমিন, কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাজ, কাউন্সিলর  মোস্তাক আহমদ, কাউন্সিলর এস এম শওকত আমীন তৌহিদ, কাউন্সিলর আব্দুল মুহিত জাবেদ, সংরক্ষিত কাউন্সিলর শাহানারা বেগম, শাহানা  বেগম শানু, মাসুদা সুলতানা,  রেবেকা বেগম রেনু, কুলসুমা বেগম পপি, নাজনিন আক্তার কণা প্রমুখ।
এই ঘটনা এমসি কলেজের ঐতিহ্য ও মর্যাদাকে কলুষিত করেছে: মহানগর আওয়ামী লীগ: এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে ধর্ষণের বর্বরোচিত ঘটনার তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ এই নিন্দা জানান। ন্যক্কারজনক এ ঘটনায় নেতৃদ্বয় মর্মাহত। এক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ পাশবিক এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকল অপরাধীকে দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।  নেতৃদ্বয় বিবৃতিতে বলেন, অপরাধ ও অপরাধীর পৃষ্ঠপোষকতা সভ্য সমাজ, পলিটিক্যাল সোসাইটি ও সুধীমহল কখনো বরদাশত করবে না এবং যে বা যারা সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তপনাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন ও দেবেন অতীতের মতো সিলেটবাসী তাদের চিহ্নিত ও প্রত্যাখ্যান করবে।  নেতৃদ্বয় বিবৃতিতে বলেন, প্রকৃত মুজিব আদর্শের কর্মী সমাজবিরোধী কোনো অপকর্ম করতে পারে না। কোনো অপরাধীর স্থান আওয়ামী লীগসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে নেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status