প্রথম পাতা

যেভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েন স্বাস্থ্যের গাড়িচালক মালেক

শুভ্র দেব

২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার, ১০:১৭ পূর্বাহ্ন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অঘোষিত মোগল ছিলেন গাড়িচালক আব্দুল মালেক। ৬৩ বছর বয়সী এই চালক দীর্ঘদিন ধরে তিন-তিনটি সংগঠনের সভাপতির চেয়ার দখল করে ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারি গাড়িচালক সমিতি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ড্রাইভার্স এসোসিয়েশন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েই তিনি নিজের অবস্থানের পরিবর্তন করেন। এই তিনটি সংগঠনের প্রথম ও শেষ কথাই ছিল তার। প্রভাব খাটিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নিয়ন্ত্রণ করতেন অধিদপ্তরের নিয়োগ বাণিজ্য। পরিবারের সদস্যসহ নিকট আত্মীয় ডজন খানেক ব্যক্তিকে অধিদপ্তরে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এক যুগে অধিদপ্তরের বিভিন্ন নিয়োগে অন্তত কয়েকশ’ লোককে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বদলি বাণিজ্য তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। সুবিধাজনক স্থানে চিকিৎসকদের বদলি করিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। একইভাবে কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাহিদামতো স্থানে বদলিতে মোটা টাকা নিতেন।

গোয়েন্দাসূত্র জানিয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ডিজির অধীনে চাকরি করেন গাড়িচালক আব্দুল মালেক। অথচ অধিদপ্তরের পদত্যাগী সাবেক এক ডিজির আস্থাভাজন ছিলেন। মূলতঃ ওই ডিজির মদতেই তিনি অধিদপ্তরে প্রভাব খাটাতেন। বেশিরভাগ নিয়োগে ডিজির প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। একইভাবে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরেও প্রভাব বিস্তার করতেন। সেখানকার নিয়োগও নিয়ন্ত্রণ করতেন। স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন মালেক। টাকার বিনিময়ে পছন্দের ঠিকাদারদের টেন্ডার পাইয়ে দিতেন। তার পছন্দের ঠিকাদারদের তালিকায় আত্মীয়স্বজনরাও ছিলেন। অধিদপ্তরের কেনাকাটাও নিয়ন্ত্রণ করতেন মালেক ও তার সহযোগীরা। অধিদপ্তরের ক্যান্টিন চালাতেন বড় জামাতা দিয়ে। অধিদপ্তরসূত্র জানিয়েছে, মালেকের দ্বিতীয় স্ত্রী রাবেয়া খাতুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইব্রেরিতে চাকরি করেন। ছোট মেয়ে নৌরিন সুলতানা বেলি অফিস সহকারী, ভাই আব্দুল খালেক ও ভাতিজা আব্দুল হাকিম অফিস সহায়ক। বড় মেয়ে বেবির স্বামী রতন ক্যান্টিনের দায়িত্বে, ভায়রা মাহবুব সরকারি গাড়ি চালক ও নিকটাত্মীয় কামাল পাশা অফিস সহায়ক।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, শুধু মালেক নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বড় একটি সিন্ডিকেটের সন্ধান তারা পেয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে এই সিন্ডিকেট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তাদের কব্জায় রেখে লুটে খাচ্ছে। এই তালিকায় অন্তত ৪৫ জনের নাম আছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আব্দুল মালেক। এদের প্রত্যেকের সম্পদের অনুসন্ধান আরো অনেক আগে থেকেই দুদক করছে। অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্র্র্ভূত সম্পদ অর্জনের সত্যতা মিলেছে।
র‌্যাব ও দুদক সূত্র জানিয়েছে, অনুসন্ধানে আব্দুল মালেকের অঢেল সম্পদের তথ্য বের হয়ে আসছে। শুধুমাত্র দুদকের অনুসন্ধানেই ঢাকায় মালেক ও তার স্ত্রীর নামে ৭টি প্লটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই সাতটি প্লটের মধ্যে চারটিতেই বহুতল ভবন আছে। এরমধ্যে প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তারের নামে তুরাগের দক্ষিণ বামারপাড়া এলাকায় দুটি সাততলা ভবন রয়েছে। যার একটি ভবনের তিনতলায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে মালেক থাকতেন। এ ছাড়া ধানমণ্ডির মৌজার হাতিরপুলে সাড়ে চার কাঠা জমিতে ১০ তলা ভবন নির্মাণাধীন। এর বাইরে আরো একটি বহুতল ভবন আছে। তুরাগ এলাকায় বড় মেয়ে বেবির নামে ১৫ কাঠা জমির উপরে একটি ডেইরি ফার্ম। র‌্যাবের এক সিনিয়র কর্মকর্তা গতকাল জানিয়েছেন, ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় মালেকের আরো ১২টি ফ্ল্যাট রয়েছে। একাধিক ব্যাংক হিসাবে রয়েছে শত কোটি টাকা। র‌্যাবসূত্র বলছে, মালেকের বিদেশে টাকা পাচারেরও একটি তথ্য রয়েছে। তবে সেটি যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।

১৪ দিনের রিমান্ডে মালেক: অবৈধ অস্ত্র ও জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় পৃথক দুই মামলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আব্দুল মালেকের ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর আগে পুলিশ গতকাল তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে। পরে তুরাগ থানার অবৈধ অস্ত্র ও জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় সাতদিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। এ সময় মালেকের আইনজীবী জি এম মিজানুর রহমান জামিনের আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে মহানগর হাকিম শহিদুল ইসলাম জামিন নামঞ্জুর করে ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

সম্পদের তদন্তে দুদক: অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আব্দুল মালেকের সাতটি প্লট ও চারটি বাড়ির সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির সচিব দিলোয়ার বখত জানান, দুদক আগে থেকেই অনুসন্ধান করছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়ে ১৬ই সেপ্টেম্বর আব্দুল মালেক ও তার স্ত্রীর  সম্পদের বিবরণীর তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী সিন্ডিকেট করে দুর্নীতি করছে, এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৯ সাল থেকে আমরা একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করি। ইতিমধ্যে মালেকসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে। এদের মধ্যে ১২ জনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলাও হয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে আব্দুল মালেক ও তার স্ত্রীর নামে ঢাকায় সাতটি প্লট এবং এসব প্লটে চারটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার মানবজমিনকে বলেন, গাড়ি চালক আব্দুল মালেককে আমরা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছি। আমরা মালেককে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। এখন পর্যন্ত গোয়েন্দা তথ্য ও মালেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করছি। অনেক অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের অনুসন্ধানে তার কয়েকটি বাড়ি, একাধিক ফ্ল্যাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছি। ধারণা করছি এর বাইরেও তার অনেক সম্পদ রয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status