বিশ্বজমিন

দ্য গার্ডিয়ানের নিবন্ধ

এশিয়ার নতুন শীতল যুদ্ধে হেরে গেছে ন্যায় বিচার ও রোহিঙ্গারা

মানবজমিন ডেস্ক

২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার, ৯:৪৯ পূর্বাহ্ন

এশিয়ার নতুন শীতলযুদ্ধে ন্যায়বিচার ও রোহিঙ্গা জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আঞ্চলিক ‘প্লেয়াররা’ তাদের নিজেদের স্বার্থের দিকে বেশি মনোযোগী হওয়ার কারণে মিয়ানমারে মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হামলার বিষয়টি অনিয়ন্ত্রিতই (আনচেকড) থেকে গেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন, জাতিনিধন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গণহত্যা এখন আইনের শাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। সেখানে যে নৃশংসতা ঘটানো হয়েছে তা প্রামাণ্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক একজন শীর্ষ আইনজীবীর মতে, এটা হলো আমাদের সামষ্টিক বিবেক ও মানবতার ওপর একটি নৈতিক ক্ষত। তাই এসব অপরাধের হোতারা যখন শাস্তির বাইরে রয়েছে, তখন কেন হত্যাকান্ড ও অন্যান্য ভীতিকর অবস্থা অব্যাহত আছে? লন্ডনের অনলাইন দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন সাংবাদিক সিমন টিসডাল। ‘জাস্টিস এন্ড দ্য রোহিঙ্গা পিপল আর দ্য লুজারস ইন এশিয়া’জ নিউ কোল্ড ওয়্যার’ শীর্ষক মতামত কলামে তিনি ওই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এটা এমন একটি প্রশ্ন যার সম্ভাব্য বেশ কিছু উত্তর হতে পারে। হতে পারে দরিদ্র, বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা মিয়ানমার, যার আগের নাম ছিল বার্মা, এখন একটি রাষ্ট্র হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়, যার জন্য তার দিকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি দিতে হবে। হয়তো পশ্চিমাদের অবচেতনে ব্যাপক অর্থে না দেখা, অচেনা, বাদামি ত্বকের মুসলিম সংখ্যালঘুদের জীবন ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যখন তারা বহুবিধ বর্ণবাদী, জাতিগত ও শরণার্থী সঙ্কটের মুখে।

অথবা, হয়তো টেকসই প্রতিবাদের অনুপস্থিতির কারণ বহু যুগ পুরনো কোনো সমস্যায় লুকিয়ে আছে: নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে বৃহৎ শক্তিগুলোর মাধ্যমে তাদের চেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠী ও দেশগুলোর নিপীড়ন ও অপব্যবহার ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়া। মিয়ানমারে এক শতকের বেশি সময় ধরে এমনটা করেছে বৃটিশ সাম্রাজ্য। এখন তেমনটা করছে চীন, যারা নিজদেশ বা বিদেশ কোনো জায়গাতেই মানবাধিকারের ধার ধারে না।

মিয়ানমার প্রহেলিকার একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে তাতমাদাও বা সেনাবাহিনীর অনিয়ন্ত্রিত, দমনমূলক ক্ষমতা। ২০১১ সালে দেশটিতে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলেও এখনো সেখানে জাতীয় জীবনে তাদের প্রভাবই বেশি। ২০১৬-১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর তাদের হামলায় খুন হয়েছেন হাজারো মানুষ। বাংলাদেশে পালিয়েছেন ৭ লাখের বেশি। এ ঘটনায় পুরো বিশ্ব কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু এখনো কাউকেই এর জন্য দায়ী করা হয়নি।

গত সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই-কমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট সতর্ক করেছেন যে, মিয়ানমারে নির্যাতন বন্ধ রাখাতো দূরের কথা, তার বদলে ফের বেসামরিকদের হত্যা ও অপহরণ করা শুরু করেছে তাতমাদাও। রাখাইন ও পার্শ্ববর্তী চিন রাজ্যে দায়মুক্তির সঙ্গে এসব চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ব্যাচেলেট বলেন, ‘কিছু ঘটনায় তারা বাছবিচারহীনভাবে হামলা চালায়। এতে আরো যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।’ অথচ, আবারো কাউকেই এর দায় নিতে বাধ্য করা হচ্ছে না।

গত ডিসেম্বরে মিয়ানমারের বেসামরিক নেত্রী অং সান সুচি যখন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) হাজির হন, তখন বিচারিক জাগরণের আশা জেগেছিল। কিন্তু সুচি তাতমাদাওয়ের বিরুদ্ধে গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে হামলা চালানোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেন। তাতমাদাওকে সমর্থন দিলেন। বললেন, রাখাইনের ব্যাপারটি সেনাবাহিনী, রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’ ও সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যকার একটি ‘আভ্যন্তরীণ সংঘাত’। এতে যদি সেনারা ব্যক্তি পর্যায়ে অপরাধের জন্য দোষী হয়ে থাকে, তাহলে তাদের শাস্তি হবে। তবে এখন অবধি তেমন শাস্তি তেমন একটা দেখা যায়নি। শাস্তি দেয়া হলেও তা খুব অল্প কয়েকজনই পেয়েছেন।

জানুয়ারিতে মামলার অন্তর্বর্তী রায়ে আইসিজে মিয়ানমারকে গণহত্যা প্রতিরোধে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও তাদের সকল প্রকার ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সরকারের ক্ষমতার আওতায় সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। আদালত তাতমাদাওকে অপরাধের প্রমাণ নষ্ট না করতে ও তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ক প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে।

এসবের কোনোকিছুতেই সত্যিকারের কোনো পরিবর্তন আসেনি। ব্যাচেলেট জানান, আদতে তাতমাদাওয়ের হত্যাকা-ের মাত্রা আরো বেড়েছে। স্যাটেলাইটে তোলা ছবিতে দেখা যায়, তিন বছর আগে পুড়ে যাওয়া কান কায়া নামের একটি রোহিঙ্গা গ্রামের ধ্বংসাবশেষ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে সামরিক বাহিনী। এটির পাশাপাশি এমন অন্যান্য গ্রামের নাম মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। পুরো ঘটনা ধাপাচাপা দেয়ার বিস্তৃত চেষ্টার অংশ এসব। এখন অবধি আদালতের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়নি মিয়ানমার সরকার। সামরিক বাহিনীর অপরাধ ঘিরে করা হয়নি কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্তও।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নেয়া দুই সেনা সদস্যের নতুন করে দেয়া সাক্ষ্যতে সবচেয়ে বড় আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তারা বর্ণনা করেছে, কিভাবে সামরিক বাহিনী গণহারে হত্যাকা- চালিয়েছে, গণকবর খুঁড়েছে, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে, নারী ও অল্পবয়সী মেয়েদের ধর্ষণ করেছে। এক সেনা জাও নাইং তুন বলেছেন, তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘যাদের পাবে তাদেরই মেরে ফেলবে, শিশু হোক বা বয়স্ক’।

দেরিতে হলেও, বৃটেনের নেতৃত্বে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে। গত সপ্তাহে তারা মিয়ানমারকে আইসিজের আদেশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়া, মিয়ানমার সরকারকে চলমান সহিংসতা বন্ধে তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন, দেশটিতে মানবিক সহায়তা ও আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের অন্তুর্ভুক্ত করতে আহ্বান জানিয়েছে পরিষদ।

তবে মিয়ানমারে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ করা অলাভজনক সংগঠন ‘বার্মা ক্যা¤েপইন ইউকে’ বলছে, এখানে একটি সমস্যা রয়েছে। এই বক্তব্য কিছুই পরিবর্তন করবে না। এটি হবে, হাসের শরীর দিয়ে পানি ঝড়ার মতো। এটি কেবলই একটি বক্তব্য মাত্র। এটি কখনো বাস্তবায়িত হবে না।

গত বছর জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে ব্যর্থতা স্পষ্ট। তবে এটি আশ্চর্যের কিছু নয়। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোকে আহ্বান জানানো হয়েছিল তাদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থের বাইরে গিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। এর মধ্যে রয়েছে, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, স¤পদ বাজেয়াপ্ত, ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিষিদ্ধ এবং মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে আসা। তবে তারা এসব পদক্ষেপ নেয়নি।

বৃটিশরা মিয়ানমার শাসন করেছে এবং তাদের স¤পদ হরণ করেছে। এখন চীনও মিয়ানমারকে ব্যবহার করে একটি কৌশলগত বাফার ও অর্থনৈতিক জোন সৃষ্টি করছে। এ বছরের জানুয়ারিতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মিয়ানমার সফরে দুই দেশের মধ্যে কয়েক ডজন চুক্তি হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে অবকাঠামোগত চুক্তি। সবথেকে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে চীন-মিয়ানমার ইকোনোমিক করিডোর প্রকল্প। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের সুযোগ পাবে চীন। যার ফলে দক্ষিণ সাগর ও মালাক্কা প্রণালীতে নতুন বাণিজ্য পথের সুযোগ সৃষ্টি হবে চীনের জন্য।
চীনের বলিষ্ঠ ঘনিষ্ঠতার বিপদ সম্পর্কে মিয়ানমারের নেতারা অবগত। ঋণের ফাঁদ ও উদ্দেশ্য সাধনে জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত সৃষ্টিসহ নানা আশঙ্কা রয়েছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের। কিন্তু বেইজিংয়ের রাজনৈতিক সমর্থন দরকার তাদের। তাছাড়া, তাতমাদাও জেনারেলদের ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা ঠেকাতে চীনের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে। এতে করে তাদের দায়মুক্তি নিশ্চিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মিয়ানমারকে মানবাধিকারের জন্য বেশি চাপ দিয়ে দেশটিতে তাদের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ও এশিয়ার শীতল যুদ্ধে দেশটির সমর্থন হারাতে চায় না।

আর তাই, হত্যা চলেছেই। বিবেকবর্জিত দাগ ছড়িয়ে চলেছেই। এ থেকে পুরনো একটা শিক্ষা নতুন করে শেখা হয়ে গেলো: বৃহৎ শক্তিরা বরাবরই আইন ও মানবতার ঊর্ধ্বে থাকে।

(বৃটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের অনলাইন সংস্করণে ২০শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত নিবন্ধের ভাবানুবাদ। মূল নিবন্ধটি লিখেছেন সাইমন টিসডাল। তিনি গার্ডিয়ানের একজন পররাষ্ট্র বিষয়ক কলাম লেখক। )
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status