প্রথম পাতা

তিন খাতে ভর করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি

এম এম মাসুদ

২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার, ৯:৩৯ পূর্বাহ্ন

করোনাভাইরাসের মহামারি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ইতিমধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘুরে দাঁড়াতে যে সব সূচক নিয়ামক হিসেবে কাজ করে সেগুলো ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টার্জিত রেমিটেন্স। এর পরেই রয়েছে পোশাক শ্রমিকদের ঘাম ঝরানো রপ্তানি আয়। এ ছাড়া রয়েছে দেশের কৃষি খাত ও শেয়ারবাজার। এদিকে  আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোও বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর গতি বেশ উৎসাহব্যঞ্জক বলে মন্তব্য করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাকালে স্বাভাবিকভাবেই শিল্প-কারখানার উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনা ঘটেছে। এমনকি আর্থিক সংকটে পড়ে অনেক কারখানাও বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধারের পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
অর্থনীতির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কৃষিপণ্যের উৎপাদন বেশ ভালো হচ্ছে। কোথাও কোনো ঘাটতি নেই। পাশাপাশি দেশের রপ্তানি আয়, রেমিটেন্স প্রবাহ, শেয়ারবাজার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভসহ বেশ কিছু সূচক করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে আগের ধারায় ফিরেছে। এ ছাড়া মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৬.৮ শতাংশ বাড়তে পারে বলে প্রাক্কলন করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে করোনাভাইরাসের মধ্যেও গেল ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি  প্রবৃদ্ধি ৫.২৪% অর্জন হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের মাথাপিছু আয়ও ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে ২ হাজার ৬৪ ডলারে উঠেছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনার মধ্যে রেমিটেন্স আসার ক্ষেত্রে রেকর্ড হয়েছে। করোনার মধ্যে আমদানি-রপ্তানি খাতও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, এই করোনাকালে সুবাতাস বইছে শেয়ারবাজারেও। দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। মূল্য সূচকও ৫ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।
কয়েকদিন আগেও নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, ছোট-বড় ব্যবসায়ী যারা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন, তাদের শঙ্কা কাটতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরছে বলেও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর গবেষণায় উঠে এসেছে।
আইএমএফের ওয়েবসাইটে জিডিপির একটা বিশ্ব মানচিত্র আছে। যেসব দেশে জিডিপি শূন্যের নিচে, মানে ঋণাত্মক ৩ থেকে ঋণাত্মক ৬, তাদেরটা লাল; শূন্য থেকে ঋণাত্মক ৩ কমলা; আর যারা ধনাত্মক, তারা সবুজ। পুরো উত্তর আমেরিকা লাল, ইউরোপ লাল, দক্ষিণ আমেরিকা লাল আর কমলা, অস্ট্রেলিয়া লাল। শুধু বাংলাদেশ, ভারত, চীনের মতো অল্প ক’টি দেশ প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ৫.৯ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের ঋণাত্মক ৬.৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ার ঋণাত্মক ৬.৭ শতাংশ, থাইল্যান্ড ঋণাত্মক ৬.৭ শতাংশ, পাকিস্তান ঋণাত্মক ১.৫ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ধনাত্মক ২ শতাংশ। এটা ২০২০ সালের কথা, আইএমএফের হিসাব। অন্যদিকে ট্রেডিং ইকোনমিকস নামের একটা সাইট বলছে ২০২০-২১ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৮.৫ শতাংশ।
এদিকে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এক্ষেত্রে দেশটিকে আশা দেখাচ্ছে মূল রপ্তানি পণ্য পোশাক খাত ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ও সিনিয়র সচিব ড. শামসুল আলম বলেন, চলতি বছর আমাদের ৩৮.৩ মিলিয়ন ধান উৎপাদন হয়েছে, গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৩৬.৩ মিলিয়ন টন। এই বছর ২ মিলিয়ন টন বেশি উৎপাদন হয়েছে। গত জুলাই মাসে ৩০০ কোটি ডলার এবং গত আগস্ট মাসে আয় হয়েছে ৩৩৬.৩৩ কোটি ডলার। এটি ২০১৯ সালের একই সময়ের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া প্রবাসী আয় রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। গত জুলাই মাসে রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.৯ শতাংশ এবং আগস্ট মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪.৩ শতাংশ। অর্থনীতির এসব সূচক বিশ্লেষণ করে বলা যায় আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, কোভিড-১৯ কারণে সারাবিশ্বের অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়েছে। সবশেষ কোয়ার্টারে জাপান, ভারত, ইউকে এবং জার্মানির অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেটার অবস্থানে রয়েছে। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে আমাদের তৈরি পোশাক খাত ধীরে ধীরে ভালো করছে। ফলে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই কোয়ার্টারে আমাদের অর্থনীতি একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে থাকবে বলে আশা করছি। তবে এটা বলা যায়, লোকাল মার্কেট এখন স্বস্তির জায়গায় আসেনি। স্থানীয় ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাঙ্গা করতে পারলে আমাদের অর্থনীতি স্বস্তির মধ্যেই রাখা সম্ভব হবে। সেজন্য লোকাল মার্কেটের দিকে নজর দিতে হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, এই মুহূর্তে আমরা বলতে পারি, তৈরি পোশাক শিল্প মার্চ-মে সময়ের খারাপ সময় কাটিয়ে আবার প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্রেতাদের সফলভাবে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এ কারণেই বাতিল হওয়া ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয় আদেশের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই ফিরে পাওয়া গেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, পোশাক খাত ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের কৃষি খাতও ভালো করছে। রেমিটেন্স আসছে। এই সবই অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ।
এফবিসিসিআই’র সভাপতি শেখ ফাহিম বলেন, বাংলাদেশের উৎপাদন খরচ কম। আর এসব বিষয় মিলিয়ে বাংলাদেশ অবশ্যই বিনিয়োগের একটি আকর্ষণীয় জায়গা। তিনি বলেন, আমরা বিনিয়োগে আগ্রহী বিভিন্ন দেশকে বলেছি, সব ধরনের সহযোগিতা করবো, বিনিয়োগ করুন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনার এই সময়ে প্রতিদিনই প্রবাসীরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে প্রবাসীরা ২৬০ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। গত বছরের জুলাইতে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন ১৫৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। এই হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিটেন্স বেড়েছে এক বিলিয়ন ডলারের মতো। গত জুন মাসে প্রবাসীরা ১৮৩ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন। জুন মাসে এটি ছিল রেকর্ড। তবে সেই রেকর্ড ভেঙে জুলাইতে ২৬০ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। রেমিটেন্স প্রবাহ অব্যাহতভাবে বাড়ার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৭.২৮৭ বিলিয়ন ডলারের সর্বোচ্চ রেকর্ড অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status