প্রথম পাতা

মসজিদে বিস্ফোরণ নানা প্রশ্ন

বিল্লাল হোসেন রবিন, নারায়ণগঞ্জ থেকে

৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ৯:৩৮ পূর্বাহ্ন

ছবিঃ জীবন আহমেদ

এশার নামাজ সবে শেষ হয়েছে। মোনাজাতে ছিলেন মুসল্লিরা। হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। মুহূর্তে মসজিদে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। দগ্ধ মুসল্লিদের চিৎকার আর আর্তনাদ। বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। বাঁচাও বাঁচাও আওয়াজ। রক্তাক্ত ফ্লোর। ৬টি এসি, ফ্যান, থাইগ্লাস সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই বিস্ফোরণে। দগ্ধ হন মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, সভাপতিসহ অর্ধশতাধিক মুসল্লি। এ ঘটনায় রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আরো ১৯ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। শুক্রবার এশার নামাজের পর নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে এমন ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন সবাই। প্রথমদিকে মসজিদের এসি বিস্ফোরণে ঘটনাটি ঘটেছে বলে অনুমান করা হয়। পরে বলা হয়, গ্যাসের লিকেজ থেকেই এই বিস্ফোরণ। মসজিদ কমিটির সভাপতি অভিযোগ করেছেন, ৫০ হাজার টাকা না দেয়ায় গ্যাস পাইপের লিকেজ মেরামত করেনি তিতাসের লোকজন। এলাকাবাসীর কেউ কেউ বলছেন, নামাজের সময় বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। বিস্ফোরণের আগে আগে বিদ্যুৎ আসে। আবার কারো দাবি, বিদ্যুৎ যায়নি।

কেন এবং কী কারণে এমন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে নাকি নাশকতা হয়েছে তা তদন্ত করে দেখা হবে। স্থানীয় এমপি শামীম ওসমানও নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করে ঘটনার গভীরতম তদন্ত দাবি করেছেন। জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেছেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় তদন্তে গাফলতি পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তিনটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ওদিকে শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, ঢাকার অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), জেলা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স, তিতাসের শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ ও নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা প্রশাসন। জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম মানবজমিনকে বলেন, এটি একটি দুর্ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। তার পরও আমরা তদন্ত করছি। ঘটনাস্থল থেকে সিআইডি ফরেনসিক নমুনা সংগ্রহ করেছে। পুরো মসজিদটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য: মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণে মারা গেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহীম (৫০)। তিনি তার বড় ছেলে ফয়সালের সঙ্গে এশার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। ফয়সাল নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে একশ’ গজ দূরে যান। এরমধ্যে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। হঠাৎ তার বাবার কথা মনে পড়ে। দৌড়ে মসজিদের সামনে যান। ফয়সাল বলেন, ‘মসজিদের সামনে গিয়ে দেখলাম থাইগ্লাস ভেঙে আগুনের গোলা বের হচ্ছে। আগুনের গোলার সঙ্গে মানুষও বের হয়ে আসছে। দু’বার আগুনের গোলা বের হয়েছে। এরপর দেখি বাবাও রাস্তায় পড়ে আছেন। দাড়ি, চুল, কাপড় সব পুড়ে গেছে, কিছু নেই। দ্রত তাকে নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে ঢাকায়। তিনি বলেন, মসজিদের প্রধান ফটকের টাইলসের নিচেই গ্যাসের লিকেজ ছিল। আমরা সেজদা দিলেও ঘ্রাণ পেতাম। কয়েকবার অভিযোগ করা হয়েছে, তবে তিতাস কর্তৃপক্ষ পাত্তা দেয়নি।
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় মোক্তার হোসেন বলেন, রাত পৌনে ৯টার সময় তিনি মসজিদের পাশের একটি দোকানে সদাই কিনছিলেন। হঠাৎ মসজিদের ভেতর থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরুতে দেখেন। আগুনের তাপে তার মাথার চুলের কিছু অংশ পুড়ে যায়। কিছু সময়ের জন্য তিনি এ ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। এরপরই মসজিদের ভেতর থেকে আহতদের আর্তনাদ শুনতে পান তিনি। পরে স্থানীয়রা আহতদের সাহায্যে এগিয়ে যান।
টাকা না দেয়ায় তিতাস লিকেজ মেরামত করেনি: এদিকে বায়তুস সালাত জামে মসজিদের সভাপতি আবদুল গফুর অভিযোগ করে বলেন, ৫০ হাজার টাকা না দেয়ায় নারায়ণগঞ্জের তিতাস কর্মকর্তারা বাইতুস সালাত জামে মসজিদের গ্যাস পাইপের লিকেজ সংস্কার করেননি। শনিবার সকালে তিতাস গ্যাসের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এলে তাদের সামনেই এ অভিযোগ করেন আবদুল গফুর। তিনি বলেন, লিকেজের বিষয়ে তিতাস কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু ৫০ হাজার টাকা না দেয়ায় তারা এর সংস্কার করেননি। তবে মসজিদ কমিটি এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেনি। মৌখিকভাবে নারায়ণগঞ্জের তিতাস গ্যাস অফিসের কর্মকর্তাদের জানায়।

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আল মামুন ঘটনাস্থলে তদন্ত করতে এসে গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ দাবির বিষয়ে বলেন, তদন্ত কমিটি সার্বিক বিষয় নিয়ে কাজ করছে। যদি তিতাস কর্তৃপক্ষের কেউ এ বিষয়ে জড়িত থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থ্যা নেয়া হবে।
বিস্ফোরণের ঘটনায় গাফিলতি পেলে ব্যবস্থা- ডিসি: নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মসজিদের বিস্ফোরণের ঘটনায় কারো গাফিলতি থাকলে তদন্তপূর্বক অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর যারা মারা গেছেন তাদের প্রত্যেক পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। শনিবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘নিহতদের পরিবারকে দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা এবং আহত যারা আছেন তাদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার করে টাকা দেয়া হবে। এছাড়াও সরকার বা অন্য স্থানে থেকেও তাদের সহযোগিতা করার ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

সাংবাদিকদের প্রশ্নে ডিসি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এ ঘটনার অনেক কিছু জানা গেলেও প্রকৃত কারণ বের করতে পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত কমিটি করেছে। তদন্তে গাফিলতি পাওয়া গেলে অবশ্যই তাকে বা তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। সেক্ষেত্রে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না।’
জসিম উদ্দিন বলেন, ‘মসজিদের নিচে একটি গ্যাসের লাইন লিকেজ ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি। পরে সেখান থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এরপর তা মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়েছে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি।

পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি: এদিকে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা খতিয়ে দেখতে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পৃথক এ তিনটি কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, তিতাস গ্যাস এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন। ৪ সদস্যবিশিষ্ট ফায়ার সার্ভিসের কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমানকে। এ কমিটিকে ১০ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্মন, উপ-পরিচালক (অপারেশন্স) নুর হাসান ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ্‌ আরেফিন।
তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে বলে কোম্পানির নারায়ণগঞ্জ অফিসের ডিজিএম মফিজুল ইসলাম জানিয়েছেন। কমিটির প্রধান করা হয়েছে- তিতাস গ্যাসের ঢাকা অফিসের মহাব্যবস্থাপক আবদুল ওহাবকে।

এছাড়া এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক খাদিজা তাহেরী ববিকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে মসজিদের মেঝের নিচ দিয়ে তিতাস গ্যাসের লাইন গিয়েছে জানিয়ে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, মসজিদের মেঝের নিচ থেকে তিতাস গ্যাসের একটি লাইন গিয়েছে। মসজিদের ভেতর গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিস্ফোরণের সঠিক কারণ জানতে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
সারি সারি লাশ, জানাজা শেষে চোখের জলে স্বজনদের বিদায়: মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। একে একে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় মুসল্লিদের লাশ। স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে আশেপাশের পরিবেশ।

শনিবার বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ১২ জনের মরদেহ নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। একে একে সবার মরদেহ মাঠে রাখা হয়। জানাজা শেষে সবার মরদেহ দাফন করা হয়। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে এক শিশুর জানাজা শেষ হয়। পরে কেঁদে কেঁদে শিশুটিকে দাফনের জন্য নিয়ে যান স্বজনরা। এর আগে বিকাল থেকে একে একে নিহতদের মরদেহ ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকায় নিয়ে আসা হয়। ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বোমওয়ালার বাড়ির খেলার মাঠে নিহতদের জানাজার জন্য প্রস্তুত রাখা হয় অনেক খাটিয়া। গোসল ও জানাজা শেষে মরদেহ দাফনের জন্য প্রস্তুত করেন স্থানীয়রা।
এদিকে একসঙ্গে এতগুলো মানুষ মারা যাওয়ায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাদের মৃত্যুতে পুরো এলাকায় কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একই সঙ্গে শনিবার এলাকায় সব দোকানপাট ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status