প্রথম পাতা

প্রদীপের অপকর্মের প্রতিবাদ করে বছর ধরে কারাবন্দি সাংবাদিক

মোহাম্মদ ওমর ফারুক, টেকনাফ (কক্সবাজার) থেকে

১২ আগস্ট ২০২০, বুধবার, ৯:২৮ পূর্বাহ্ন

রাজধানীর মিরপুর, কক্সবাজার মডেল থানা ও টেকনাফ নিজের থানার পুলিশকে ব্যবহার করে স্থানীয় সাংবাদিক নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে সমালোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাসের বিরুদ্ধে। ফরিদুল মোস্তফা নামে স্থানীয় ওই সাংবাদিক গত বছরে ‘টেকনাফ থানায় টাকা না পেলে ক্রসফায়ার দিচ্ছে ওসি প্রদীপ’- শিরোনামে সংবাদটি প্রকাশ করেন। এরপরই সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান পুলিশ প্রশাসনের রোষানলে পড়েন। পরে  টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের পরিকল্পনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেন। এরপর থেকেই পুলিশি নির্যাতনে ভয়ে পালিয়ে বেড়ান ওই সংবাদকর্মী। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাবর আবেদন করলেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। ঢাকা মিরপুরের একটি বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। তখন ওসি প্রদীপ মিরপুর থানার পুলিশকে ব্যবহার করে তাকে টেকনাফে নিয়ে আসেন। এরপর তার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। তার চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
পরে তাকে কক্সবাজার মডেল থানার সহযোগিতায় ওই থানা এলাকার বাসভবনে অভিযান চালিয়ে ইয়াবা ও অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে জেলে পাঠানো হয়। এরপর থেকে তিনি কারাগারেই আছেন।
নির্যাতিত এ সাংবাদিক দৈনিক কক্সবাজারবাণী ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘জনতারবাণী ডটকমের’ সম্পাদক ও  প্রকাশক। প্রদীপের নির্যাতনে চোখ হারানোর অবস্থা তার। এই ঘটনার পর থেকে তাকে কোনো ধরনের চিকিৎসা না দেয়ার অভিযোগ করেছে পরিবার। যার কারণে চোখের আলো নষ্ট হওয়ার উপক্রম। ঘটনার সময় স্থানীয় কোনো সাংবাদিক বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেননি। কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তখন তারা কেউ ওসি’র বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাননি। তার বিরুদ্ধে সংবাদ করলেই নির্যাতন করতো এই ওসি। অভিযোগ রয়েছে, ওসি  প্রদীপের ক্ষোভের শিকার হয়ে ১১ মাস ধরে ৬টি মিথ্যা মামলা মাথায় নিয়ে কারাবাস করছেন ফরিদুল। তিনি এখন কক্সবাজার কারাগারে রয়েছেন। জানা গেছে, ওসি ও তার সহযোগীদের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ করায় গত বছরের ২১শে সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে ফরিদুল মোস্তফাকে ধরে টেকনাফ থানায় নিয়ে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালান প্রদীপ কুমার। সে সময় তার চোখে মরিচের গুঁড়া দিয়ে নির্যাতন করা হয়। এ ছাড়া তার হাত-পা ভেঙে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ফরিদুলকে নিয়ে কথিত অভিযানে গিয়ে কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়ায় বাড়ি থেকে গুলিসহ ২টি অস্ত্র, ৪ হাজার পিস ইয়াবা ও বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদের বোতল উদ্ধার  দেখায়  টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে কক্সবাজার মডেল থানা পুলিশ।
ফরিদুল মোস্তফার স্ত্রী হাসিনা আক্তার বলেন, গত বছরের ২১শে সেপ্টেম্বর মিরপুর-১ নম্বর সেকশনের শাহ আলীবাগের প্রতীক হাসনাহেনা বাসায় অভিযান চালিয়ে কথিত চাঁদাবাজির মামলায় ফরিদুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। মিরপুর মডেল থানা পুলিশের সহায়তায় টেকনাফ ও কক্সবাজার থানা পুলিশ এই অভিযানে অংশ নেয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদক সিন্ডিকেট, কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ঘুষ, দুর্নীতিসহ টেকনাফ থানা ও কক্সবাজার থানার ওসি’র বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশ করে আসছিলেন। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে গত বছরের ৩০শে জুন সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খানের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় একজনকে বাদী সাজিয়ে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করা হয়।
পুলিশি নির্যাতন ও সাজানো মামলা থেকে বাঁচতে ও নিজের পরিবারের জানমালের নিরাপত্তা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর গত বছরে ২৮শে জুলাই পৃথকভাবে মানবিক আবেদন করেন ফরিদুল। এসব আবেদন করার পরেও ওসি প্রদীপের কাছ থেকে বাঁচতে পারেননি তিনি। ফরিদুলের স্ত্রী হাসিনা আক্তার জানান, এতো আবেদনের করার পরেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা বা তদন্ত না করে উল্টো গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। ফরিদুল মোস্তফার স্ত্রী হাসিনা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, তার দুই ঘুমন্ত  ননদকে ওসি প্রদীপ কুমারের  নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল শারীরিক নির্যাতন ও শ্লীলতাহানি করে। আটকের ভয়ভীতি দেখিয়ে রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয় তাদের। এরপর নাটকীয়ভাবে ২টি অস্ত্র, ৪০০০ ইয়াবা ও ১১ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার দেখায় পুলিশ। তখন পুলিশ সদস্যরা ফরিদের বাসায় তালা লাগিয়ে দিয়ে চলে যান। ওই সাজানো অভিযানের ঘটনা দেখিয়ে একই দিন কক্সবাজার সদর থানায় অস্ত্র, ইয়াবা ও বিদেশি মদ উদ্ধার দেখিয়ে পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক ৩টি মামলা দায়ের করে। সাজানো মামলায় গ্রেপ্তারের তিনদিন পর সন্ধ্যা ৭টায় কঠোর গোপনীয়তায় গুরুতর জখম অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাকে জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ  দেন। সেই সময় প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানিয়েছেন, সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খানকে পুলিশ হেফাজতে লোমহর্ষক নিপীড়ন করায় সারা শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছিল।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কিছুটা সুস্থ হলেও এখনো তিনি তার একটি হাত ও একটি পা নাড়াচাড়া করতে পারছেন না। চোখে স্পষ্ট করে কিছু দেখতে পারেন না। বাম পাশের চোখটি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী। গ্রেপ্তারের আগে দায়ের করা চাঁদাবাজির মামলাসহ ৬টি মামলায় এখনো তিনি জেলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আর্থিক সংকটে পড়েছে তার পরিবারটি। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে তিন ছেলেমেয়ের। তিন সন্তান আর বৃদ্ধা মা নিয়ে চরম অভাব-অনটনে দিন কাটছে তাদের। সংসার চালাতে ও মামলার খরচের ঘানি টানতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন বসতভিটা। এমন ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে গত একবছরে কোনো সংবাদমাধ্যমে সংবাদ পর্যন্ত করতে সাহস হয়নি স্থানীয় সাংবাদিকদের।  
এদিকে কয়েকটি গণমাধ্যমে কথা বলায় ওই সা্‌ংবাদিকের বাড়িতে এসে এখনো অপরিচিত বিভিন্ন জন হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। তার স্ত্রী হাসিনা আক্তার বলেন, এসব থেকে কবে যে মুক্তি পাবো বুঝতে পারছি না। এখনো বিভিন্ন জন এসে আমাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। যাদের কাউকেই আমরা চিনি না। তারা বলে যাচ্ছেন, আমরা যেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলি।
মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় আরো ৩ জন আটক
টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, টেকনাফে সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন তিনজন আসামিকে আটক করেছে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর সদস্যরা। আটককৃতরা হচ্ছে- টেকনাফের বাহারছড়া মারিশবনিয়ার জালাল আহমদের পুত্র মো. আয়াছ উদ্দিন, নাজুর পুত্র মো. নুরুল আমিন, নজির আহমদের পুত্র  মো. নাজিমুদ্দিন। মঙ্গলবার ভোররাতে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর একটি দল তাদেরকে আটক করে। একই দিন বিকালে ধৃত আসামিদের কক্সবাজার আদালতে সোর্পদ করা হয়েছে। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) আব্দুল্লাহ  মোহাম্মদ শেখ সাদী।
উল্লেখ্য, গত ৩১শে জুলাই রাতে টেকনাফ বাহারছড়া  চেকপোস্টে তল্লাশির সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন  সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় হত্যা ও মাদক আইনে এবং রামু থানায় মাদক আইনে পৃথক ৩টি মামলা দায়ের করে। এ মামলায় নিহত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের সঙ্গে থাকা শাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা রানী দেব নাথকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। ৫ই আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ইন্সপেক্টর লিয়াকত, ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ৬ই আগস্ট বরখাস্ত ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতসহ ৭ আসামি কক্সবাজার সিনিয়র জুড়িসিয়াল আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status