অনলাইন

বাংলাদেশে চীনের প্রভাব রোধে ভারত কি পরিকল্পনা করছে?

২ আগস্ট ২০২০, রবিবার, ১০:১০ পূর্বাহ্ন

ভারতের বিশিষ্ট প্রতিবেশী নীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ভারত ভূষণ বাংলাদেশে চীনের প্রভাব রোধে ভারত কি পরিকল্পনা করছে এর গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন। সিনিয়র সাংবাদিক ভারত ভূষণকে অন্যতম বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেখা হয়। চীন, ভারত, বাংলাদেশ সম্পর্কের নানা মাত্রা নিয়ে গত ২৯শে জুলাই দি কুইন্টে বিস্তারিত ব্যাখা করেছেন।

ভারত আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য বৃদ্ধিতে নতুন প্রকল্প গ্রহণে উদ্যোগী হয়েছে । ভারত চলতি সপ্তাহে দশটি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ সরবরাহ করেছে বাংলাদেশকে । আর জুলাই মাসের গোড়ায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে মাল্টি মোডাল পরিবহন ব্যবস্থার আওতায় পণ্য আনা নেয়ার বিষয়ে একটা বড় অগ্রগতি ঘটেছে। এটা একটা উদ্বোধন। এই ঘটনাগুলো ঘটেছে বাংলাদেশ-চীনের সাফল্যজনক অর্থনৈতিক কূটনৈতিক প্রেক্ষাপটে।
চীন সম্প্রতি ৯৭ টি পণ্যের উপরে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ঘোষণা করেছে । এর বাইরে থাকছে শুধু মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্য । এটা কার্যকর করা হয়েছে ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে । চীন তার এই সিদ্ধান্ত চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরাট বাণিজ্য ঘাটতির দিকে নজর রেখে করা হয়েছে এবং মহামারীতে বাংলাদেশ যে দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়েছে, তা থেকেও তাকে একটা মুক্তি দেয়ার কথা তারা মনে রেখেছে। আর এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এমন একটা সময়ে যখন ভারত এবং চীন পূর্ব লাদাখে সামরিক অচলাবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। ঢাকা এখন অধিকতর বেইজিং এর কাছাকাছি। প্রায় এক দশক আগেই ভারত বিভিন্ন পণ্যে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দেশটিতে পরিবর্তন ঘটেছে । সময়ের ধারাবাহিকতায় ঢাকা এখন একটি অধিকতর বেইজিং ফ্রেন্ডলি দেশ হয়ে উঠেছে । যদিও একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চীনের ১৯৭৫ সালের শেষদিক পর্যন্ত সময় লেগে গিয়েছিল। সেই সময়টায় ভারতের দিক থেকে চীনের সুবিধাপ্রাপ্তি অনেকভাবে বেড়ে গিয়েছিল এবং সেই সময় থেকে চীনের যেমন অনেক অর্থনৈতিক শক্তি বেড়ে গিয়েছে। তেমনি তার পাশাপাশি ভারতের সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত যে সুবিধা, তাকে কাউন্টার করার পদক্ষেপ এতদিনে জোরদার করে নিয়েছে চীন।
চীন এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহদাতা । পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশই হচ্ছে চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানির গন্তব্য ।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন নিয়েছে । পাঁচটি মেরিটাইম পেট্রোল ভেসেল, ১৬টি ফাইটার জেট, ৪৪টি ট্যাংক এবং এন্টিশিপ, সারফেস টু সারফেস মিসাইল চীনের কাছ থেকে নিয়েছে।
এমনকি দেশটির প্রথম সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণ করছে চীন। এটি কক্সবাজারের পেকুয়ায় অবস্থিত।
২০১৫ সালে ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ভারতের বৃহত্তম বানিজ্য অংশীদারে পরিণত হয়।
২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর সফরকালে ঢাকা এবং বেইজিং এর মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে। বাংলাদেশ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বি আর আই-এর মধ্যে এনেছে । সেই থেকে তারা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাতাশটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই করেছে। এবং ঢাকাকে ওই প্রকল্পে যোগ দেয়ার জন্য ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২৬ মিলিয়ন ডলার বি আর আই এর জন্য এবং বাকি ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যৌথ উদ্যোগের জন্য ।
সুতরাং এই বিপুল পরিমাণ সহায়তা ভারতের বাংলাদেশকে দেয়া মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক প্যাকেজকে প্লান করে দিয়েছে।

বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব

বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জাপানি একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান যদিও ঢাকা মেট্রোরেল তৈরি করছে । কিন্তু তার বাইরে চীন দেশের সকল মেগা নির্মাণ প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করছে । ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ৪৯ % স্টেক ভারতকে টপকে দিয়ে চীন জয়লাভ করেছে। এবং অংশতঃ হলেও ভারতীয় চাপের কারণে কক্সবাজারের প্রস্তাবিত সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর চীনকে দেয়ার পরিকল্পনা বাংলাদেশ বাতিল করেছে । এই সমুদ্র বন্দরটি পায়রায় স্থানান্তর করা হয়েছে এবং সেখানে অর্থায়ন করবে ভারত। অবশ্য চীনা কোম্পানিসমূহ সমুদ্রবন্দরের ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের নির্মাণ কাজ পেয়েছে । চীনা হার্বার ইঞ্জিনীয়ারিং কোম্পানি প্রধান বন্দর অবকাঠামো তৈরি করবে । অন্যদিকে চীনের স্টেট ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি বন্দরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো তৈরির দায়িত্ব নেবে । এছাড়াও বন্দর সংশ্লিষ্ট আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাগত সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করার দায়িত্ব চীনা কোম্পানি পেয়েছে।এমনকি চীনা কোম্পানিগুলো বন্দরের টেলিকম হার্ডওয়ার এবং তা নিয়ন্ত্রণের নেটওয়ার্কের সর্ব বৃহত্তম সরবরাহকারী থেকে গেছে।

বাংলাদেশ আর নিজেদেরকে ইন্ডিয়া লকড বা ভারতবেষ্টিত ভাববে না

সরকার টু সরকার বিশেষ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে গড়ে উঠছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল । সেখানে চীনা ফার্ম গুলো মার্কিন শুল্ক হারকে টেক্কা দেবে। ওই চীনা কোম্পানিগুলো এর মাধ্যমে নতুন মার্কিন শুল্ক হারের অসুবিধা অতিক্রমে বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে । যেমনটা তারা করছে লাওস ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ায় ।
চট্টগ্রামের মীরসরাইতে গড়ে উঠছে স্পেশাল ইকোনমিক জোন। সেখানে চীনা কম্পানিগুলো বড় ধরনের বিনিয়োগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কুনমিঙ আয়রন এন্ড ষ্টীল কোম্পানি ইতিমধ্যেই প্রায় সোয়া দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে। ভূখন্ডগত একটা রুট তৈরির সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে কুনমিং পর্যন্ত একটা যোগাযোগ ওই পরিকল্পনার আওতায় রয়েছে । এটা হবে বাংলাদেশ -চীন -ভারত- মিয়ানমার কিংবা একে বলা হবে বিসিআইএম করিডোর।
ভারত এইসব পরিকল্পনায় নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইলেও, চীন চায়না-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোরকে বাংলাদেশ পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে পারে । উভয় দিক থেকে বাংলাদেশের পক্ষে তার রপ্তানি এর মাধ্যমে বাড়বে । এবং এর মধ্য দিয়ে চীনের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশ তখন আর নিজেকে ইন্ডিয়া বা ভারত বেষ্টিত বলে মনে করবে না।
উপরন্তু মিয়ানমার যখন রাখাইন সমস্যার সমাধান করে ফেলবে বাংলাদেশ তখন মিয়ানমারের পশ্চিমাংশে অবস্থিত কিয়াকপু গভীর সমুদ্র বন্দরে প্রবেশাধিকারের সুবিধা ভোগ করবে । ওই গভীর সমুদ্র বন্দর চীন তৈরি করেছে।

চীন কিভাবে বাংলাদেশে ভারতের 'সফট পাওয়ার' সুবিধাকে কাউন্টার করছে

চীন একইসঙ্গে বাংলাদেশ ভারতের সফট পাওয়ার সুবিধাকে কাউন্টার করছে। চীন বাংলাদেশি ছাত্রদের জন্য স্কলারশিপের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে । তারা অনেক ধরনের ম্যান্ডারিন লার্নিং সেন্টার খুলে দিয়েছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের উদ্বোধন করেছে । উভয় দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের বিনিময় সফর বেড়ে গিয়েছে । আন্তঃদেশীয় থিংকট্যাংক গুলোর মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে এবং উভয় দেশের মধ্যে মিলিটারি মেডিসিন এবং ক্রীড়া ক্ষেত্রে সম্পর্ক সম্প্রসারিত হয়েছে।চীন একইসঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে তার ব্যাপকভিত্তিক সিস্টার সিটি কর্মসূচি চালু করেছে এবং করোনা সংকটকালে বিপুল সংখ্যক মেডিকেল সরঞ্জামসহ চিকিৎসকদেরকে বাংলাদেশে প্রেরণ করেছে। আর এসবের অনেকটাই করা হয়েছে ব্যাপকভিত্তিক পাবলিসিটির মধ্য দিয়ে। ভারতও বাংলাদেশে মেডিকেল সহায়তা পাঠিয়েছে কিন্তু তা মিডিয়ায় তেমন গুরুত্ব পায়নি।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী , মিডিয়া এবং সিভিল সোসাইটির মধ্যে চীনের বিষয়ে ইতিবাচক ভাবমূর্তি থাকার কারণে ওই প্রচার অত্যান্ত গুরুত্ব পেয়েছে।

চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অবস্থান অভিন্ন। ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকারের চীনা সহায়তা দরকার তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এবং ভারতের প্রতি একটি কাউন্টার ব্যালেন্স সৃষ্টির জন্য ।
অন্যদিকে ভারতের কাছে কোণঠাসা হয়ে থাকা বিএনপি এ বিষয়টিকে দেখে তার কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বীকে যতোটা সম্ভব একটা ঝামেলার মধ্যে রেখে দেয়ার জায়গা থেকে।

প্রভাবশালী বাংলাদেশিরা চীনকে একমাত্র ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর হিসেবে দেখে থাকে।
ভারত তার সব ডিম আওয়ামী লীগের ঝুড়িতে রেখেছে। যা সংক্ষিপ্ত মেয়াদে সুবিধাজনক মনে হতে পারে তার জন্য। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে, আওয়ামী লীগের ত্রুটিপূর্ণ শাসনের দায়ভার সেকারণে তাকেই বহন করতে হবে। এটাই এইরকম সম্পর্কের পরিণতি। এবং তা সত্ত্বেও অনেকে দাবি করছেন যে, শেখ হাসিনার মন্ত্রীদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা নিশ্চিতভাবেই চীনপন্থী।বাংলাদেশি পর্যবেক্ষকরা মন্তব্য করেন যে, ভারত এবং চীনের কূটনীতিক স্টাইল এর মধ্যে একটা পার্থক্য সহজেই প্রতীয়মান হয়। আর সেটা হলো ভারতীয় কূটনীতি অনেকটা রাজা-প্রজার সম্পর্কের নীতি দ্বারা পরিচালিত। অন্যদিকে চীনের কূটনীতিটা একেবারেই আলাদা এবং সে কারণে সেটা অধিকতর গ্রহণযোগ্য।

যদিও এই সমীকরণটা দীর্ঘমেয়াদে বদলে যেতে পারে কিন্তু এখনো পর্যন্ত প্রভাবশালী বাংলাদেশিরা একটি বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে আরামদায়কভাবে বসবাসের জন্য একমাত্র ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর হিসেবে চীনকে বিবেচনা করে আসছেন।
বাংলাদেশে চীন যে প্রভাব বলয় তৈরি করেছে, তাকে নিউট্রাল করতে ভারত কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, সেটা তার কূটনীতির মধ্য দিয়ে সামনের বছরগুলোতে ফুটে উঠবে। সেটাই হবে তার প্রকৃত পরীক্ষা । তবে এটা বেশ স্পষ্ট যে ভারতের ক্ষুদ্র প্রতিবেশীরা ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নিচ্ছে এবং এটা করতে গিয়ে তারা যেটা করছে, এই দুই দেশের মধ্যে কোন এক দিকে ঝুঁকে না পড়ার নীতি গ্রহণ করছে। এর ফলে আপাতত ভারতের ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্য থেকে চীন সাফল্যজনকভাবে একটা বিশেষ সুবিধার অনুভূতি আদায় করে নিতেই সক্ষম হচ্ছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status