শেষের পাতা

সিলেটে যে কারণে খুন পরিবহন শ্রমিক নেতা রিপন

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

১৬ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৯ পূর্বাহ্ন

সিলেটের ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক নেতা রিপনকে খুনের পরিকল্পনা করা হয় ঘটনাস্থলের অদূরে বরইকান্দিতে। আর সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সিএনজি অটোরিকশাযোগে খুনিরা চলে আসে বাবনা মোড়ে। রিপন যখন তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিলেন তখন সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে আসা খুনিরা তার ওপর হামলা চালায়। এরপর তারা ওই সিএনজি অটোরিকশায় করে বরইকান্দি দিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনার ৫ দিন পর গতকাল গ্রেপ্তার হওয়া সিএনজি অটোরিকশাচালক তারেক আহমদ পুলিশের কাছে এই তথ্য জানিয়েছে। একই সঙ্গে সে আদালতেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পুলিশকে তারেক জানায়, ‘দক্ষিণ সুরমার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ইজাজুল, রিমু ও মুন্না সহ কয়েকজন তাকে অনেকটা জোরপূর্বক বরইকান্দি থেকে নিয়ে আসে। এরপর তারা যখন হামলা করছিলো তখন তিনি দৃশ্যটি দেখছিলেন। এরপর সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে সে চলে যায়। সন্ত্রাসীদের হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল বলে জানায় সে। দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি আক্তার হোসেন গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাতে পুলিশ বরইকান্দি এলাকা থেকে খুনিদের বহনকারী সিএনজি অটোরিকশাচালক তারেক আহমদকে আটক করেছে। তার কাছ থেকে খুনের ঘটনার অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। সে আদালতেও জবানবন্দি দিয়েছে। এখন আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। সিলেটের পরিচিত শ্রমিক নেতা ইকবাল আহমদ রিপন। বাড়ি সিলেট নগরীর খোজারখলা এলাকায়। তিনি সিলেট জেলা ট্রাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। কয়েক মাস আগে তিনি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। তিনি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ট্যাঙ্কলরি শ্রমিকদের নানা সমস্যার বিষয়ে সোচ্চার হন। শ্রমিকদের প্রধান সমস্যা ছিল চাঁদাবাজি। যমুনা অয়েল কোম্পানির ডিপো হচ্ছে খোজারখলা এলাকায়। পাশেই রেলওয়ের সম্পত্তি। ওই এলাকায় ট্যাঙ্কলরি দিয়ে তেল বিভিন্ন জায়গায় বিক্রির জন্য নেয়া হয়। ট্যাঙ্কলরি শ্রমিকদের নানাভাবে নির্যাতন করতো স্থানীয় সন্ত্রাসীদের একাংশ। ওই সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে এলাকায় ইয়াবার হাট গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে ক্রাইম জোন দক্ষিণ সুরমার অন্যতম একটি ক্রাইমস্পটে পরিণত হয়েছিলো যমুনা অয়েল ডিপো এলাকার আশপাশ। অনেকটা নির্জন এলাকার কারণে চিহ্নিত অপরাধীরা ওই এলাকায় রোজই আড্ডা দিতো। শ্রমিকরা প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর নেমে আসতো নির্যাতন। ট্যাঙ্কলরি শ্রমিকদের কাছ থেকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিয়মিত চাঁদাবাজি করতো চিহ্নিত সন্ত্রাসী ইজাজুল, রিমু ও মুন্না। ইকবাল আহমদ রিপন নতুন সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর তিনি এই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এবং শ্রমিকরা কাউকে চাঁদা দেবে না বলে জানিয়ে দেন। এসব নিয়ে গত তিন মাসে যমুনা অয়েলের ডিপো এলাকায় শ্রমিকদের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের উত্তেজনা চলছিলো। এসব উত্তেজনার মধ্যেই গত ১০ই জুন রাতে এক ট্যাঙ্কলরি শ্রমিককে মারধর করে প্রায় ৩ লাখ টাকা লুটে নেয় ইজাজুল, রিমু ও মুন্না সহ কয়েকজন। ওই দিন শ্রমিকরা প্রতিরোধ গড়লেও অস্ত্রের কারণে তাদের দমাতে পারেনি। ঘটনার পর রোকেয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক ইউনূস মিয়া বাদী হয়ে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় মামলা করেন। শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রিপনই এতে উৎসাহিত হয়ে মামলা করান। এদিকে মামলা দায়ের করার পর রিপনকে ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছিলো সন্ত্রাসীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও স্ট্যাটাস দিয়ে হুমকি দেয়া হয় বলে শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন। হুমকির কারণে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে রিপন দক্ষিণ সুরমা থানায় জিডি দায়ের করেছিলেন। এবং ওই জিডিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন তার প্রাণনাশের আশঙ্কা রয়েছে। এরপরও দক্ষিণ সুরমা পুলিশ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এদিকে রেলওয়ের সম্পত্তি ব্যবহার নিয়ে ট্যাঙ্কলরি শ্রমিকদের সঙ্গে বিরোধ চলছিলো স্থানীয় রেলওয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। গত ২৯শে জুন জমি ব্যবহার নিয়ে রেলওয়ের কর্মচারীর সঙ্গে ট্যাঙ্কলরি শ্রমিকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ ঘটনায় রেলওয়ের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় প্রধান আসামি হয় ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল আহমদ রিপনকে। দুটি মামলায়ই রিপন সহ শ্রমিকদের প্রায় ১৯ জন সদস্য আদালতে হাজির হয়ে ১লা জুলাই জামিন নেন। ওদিকে রেলওয়ের কর্মকর্তা আকবর হোসেন মজুমদারের ওপর হামলার ঘটনায় আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলো রেলওয়ের সিবিএ নেতারা। ফলে সিলেট জেলা ট্যাঙ্কলরি শ্রমিকদের সঙ্গে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি রেলওয়ের কর্মচারীদের বিরোধ চলছিলো। এই অবস্থায় গত ১০ই জুন রাতে সন্ত্রাসী ইজাজুল, রিমু, মুন্না সহ কয়েকজন হামলা চালিয়ে খুন করে শ্রমিক নেতা রিপনকে। সিলেট জেলা ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আজিজ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, খুনের ঘটনায় স্থানীয় সন্ত্রাসী ও রেলওয়ের শ্রমিকরা এক হয়ে গিয়েছিলো। ইন্ধন ছিল রেলওয়ে কর্মকর্তাদের। এ কারণে মামলায় আসামি করা হয়েছে রেলওয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। তিনি বলেন,  ফেসবুকে যখন হত্যার হুমকি দিয়েছিলো সন্ত্রাসীরা তখন রেলওয়ের কর্মচারীরা সেটি নিজেদের উদ্যোগে প্রচার করেছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ঘটনায় সকলের সমর্থন এবং অংশগ্রহণ ছিল। এদিকে শ্রমিক নেতা আকবর হোসেন রিপন হত্যার পর দক্ষিণ সুরমা থানার অফিসার ইনচার্জ খাইরুল ফজল বরইকান্দি এলাকার নোমান আহমদ ও সাদ্দাম আহমদকে ঘটনার দিনই গ্রেপ্তার করেন। আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশ সক্রিয় থাকলেও এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তুমুল বিতর্ক দেখা দিলে পুলিশ ওসি খায়রুল ফজলকে বদলি করে তার স্থলে ওসি আক্তার হোসেনকে নতুন ওসির দায়িত্ব দেয়া হয়। ঘটনার পর নিহত রিপনের স্ত্রী ফারজানা বেগম তমা বাদী হয়ে ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার আসামিরা হলো- বরইকান্দি গ্রামের ফরিদের ছেলে ইজাজুল, ফারুক মিয়ার ছেলে রিমু, আব্দুল করিম মনজ্জিরের ছেলে মুহিবুর রহমান মুন্না, মৃত আসদ্দর আলীর ছেলে মোস্তফা, মৃত বশির মিয়ার ছেলে মিন্টু, লিলু মিয়ার ছেলে সেবুল, চান মিয়ার ছেলে কাইয়ুম, ফারুক মিয়ার ছেলে বদরুল, মৃত ফরিদ মিয়ার ছেলে ইসমাইল, বরইকান্দি গ্রামের মৃত কবির মিয়ার ছেলে নোমান, রেলওয়ের সিলেট বিভাগীয় প্রকৌশলী আকবর হোসেন মজুমদার, বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগ নেতা ও রেলস্টেশনের সিনিয়র কর্মকর্তা মতিন ভুঁইয়া ও  রেলওয়ের ওয়ার্কার সুপারভাইজার শহিদুল হক। এদিকে রিপনের খুনিদের গ্রেপ্তার দাবিতে পুলিশকে আরো এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। বঙ্গবীর রোডের পিরোজপুরস্থ সংগঠনের কার্যালয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ)  সোহেল আহমদ ও দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি আক্তার হোসেন সিলেট বিভাগীয় ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন।  বৈঠকে প্রশাসনের অনুরোধের প্রেক্ষিতে শ্রমিকরা আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত ধর্মঘট স্থগিত ঘোষণা করেন। তবে শ্রমিকদের অন্যান্য আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। এ সময় বক্তব্য রাখেন- সিলেট বিভাগীয় ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. মনির হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক  মো. আব্দুল আজিজ। উপস্থিত ছিলেন, সংগঠনের সহ-সভাপতি কাউছার আহমদ, সহ-সাধারণ সম্পাদক সোহেল আহমদ, অর্থ সম্পাদক মো. ইকবাল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক মো. আলমগীর হোসেন, প্রচার সম্পাদক মো. গোলাপ খান, লাইন সম্পাদক কবির খান, কার্যকরী সদস্য বশির মিয়া, আব্দুল জলিল সহ শ্রমিক নেতৃবৃন্দ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status