প্রথম পাতা

করোনা টেস্ট

প্রতারণার ফাঁদ রূপপুর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া

শামীমুল হক

১৫ জুলাই ২০২০, বুধবার, ৯:৩৩ পূর্বাহ্ন

ডা. আবু সাঈদ

রিজেন্টের শাহেদ, জেকেজি সাবরিনার পর এবার করোনা টেস্ট প্রতারণায় নাম এসেছে ডাক্তার সাঈদের। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান। পুরো নাম ডাক্তার আবু সাঈদ। এ নিয়ে পাবনার রূপপুর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত চলছে তোলপাড়। বেরিয়ে আসছে ডাক্তার সাঈদের আরো অনেক অজানা কথা। এ নিয়ে ঈশ্বরদী থানায় মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক প্রতারককে। এই মামলায় দুই নাম্বার আসামি সাঈদ। এ নিয়ে যখন চারদিকে সমালোচনার ঝড় তখনই ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা টেস্টের পিসিআর ল্যাব বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন সেখানে ঝুলছে তালা। বেসরকারি এ হাসপাতালের করোনা টেস্ট প্রতারণায় হতভম্ব সবাই।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের শ্রমিক-কর্মচারী হিসেবে চাকরি করতে হলে করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ সার্টিফিকেট জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এই বিষয়টিকে সুযোগ হিসেবে নেয় ডাক্তার সাঈদ ও তার সহযোগীরা। ঈশ্বরদীর পাকশী রূপপুরে মেডিকেয়ার নামের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক রূপপুর প্রকল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের করোনা টেস্ট করতে মাঠে নামে। রূপপুরে অবস্থিত মেডিকেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা নেয়ার অনুমতি দিয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ।
গত ১৭ই জুন কলেজটির অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নপত্রে তারা মেডিকেয়ারকে নমুনা নেয়ার অনুমতি দেয়। অথচ এমন অনুমতি দেয়ার এখতিয়ার নেই তাদের। এটা করা হয়েছে শুধুমাত্র টেস্ট প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিতে। আর ইতিমধ্যে নেগেটিভ সার্টিফিকেট দিয়ে প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। তথ্য প্রমাণ নিশ্চিত হয়ে অভিযান চালিয়ে করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণার অভিযোগে মেডিকেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বত্বাধিকারী আবদুল ওহাব রানাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রানা ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়নের চর রূপপুর নলগাড়ী গ্রামের জামাত আলীর ছেলে। গত ৮ই জুলাই রাতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বর্তমানে রানা জেলহাজতে রয়েছে। মামলায় রানা ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. আবু সাঈদ ও রানার সহযোগী সুজন আহমেদকে আসামি করা হয়।
ঈশ্বরদী থানার এসআই মো. ফিরোজ হোসেন এ মামলার বাদী। মামলায় বলা হয়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত ৫০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে গত ৬ই জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজে জমা দেয়া হয়।
সরকারি কোনো অনুমোদন না নিয়ে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা ও প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
নিয়মানুযায়ী, নমুনা সংগ্রহ ও রিপোর্ট প্রদান করবে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো। সিভিল সার্জনের অনুমতিতে সেগুলো নির্ধারিত পিসিআর ল্যাবে যাবে। রিপোর্টগুলোও সিভিল সার্জন কার্যালয় কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হবে।
কিন্তু এসব নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করেনি রূপপুর মেডিকেয়ার ক্লিনিক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। তারা অবৈধভাবে করোনার নমুনা সংগ্রহ ও মনগড়া রিপোর্ট দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক লাখ টাকা। মেডিকেয়ারের মালিক রানা করোনা পরীক্ষা করাতে প্রতিজনের কাছ থেকে
 ৫/৬ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। ভয়ঙ্কর তথ্য হলো-রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রকল্প এলাকার পাশেই একটি পরিত্যক্ত ইটভাটার মাঠে তাঁবু টানিয়ে বুথ স্থাপন করা হয়। নমুনা দানকারীদের মেডিকেয়ার ক্লিনিকের পক্ষ থেকে জানানো হতো, সংগ্রহ করা নমুনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা হবে। এরপর নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট আসতো অনলাইনে। সেই কপি প্রিন্ট করে দেয়া হতো। রিপোর্টগুলোতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষে চেয়ারম্যান ডা. আবু সাঈদের স্বাক্ষর রয়েছে।
এ ঘটনায় মামলা হওয়ার তিনদিন পর গত ১১ই জুলাই থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত পিসিআর ল্যাবে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ডা. মো. আবু সাঈদ সাংবাদিকদের বলেন, পিসিআর ল্যাবের প্রধান প্রফেসর জাকিউর রহমান এবং সমন্বয়কারী ডা. মো. আতিকুর রহমান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় পিসিআর ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
ওদিকে জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার রানা পুলিশকে জানিয়েছেন, নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পুলিশ বলেছে, প্রকৃতপক্ষে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার বিষয়টি সম্পূর্ণ সাজানো ছিল। মূলত রূপপুর প্রকল্পে শ্রমিক- কর্মচারী হিসেবে চাকরি করতে হলে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট জমা দেয়া বাধ্যতামূলক থাকায় মেডিকেয়ার ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে বিশাল বাণিজ্যের পরিকল্পনা করে। অভিযোগ পেয়ে ঈশ্বরদী থানা পুলিশ মেডিকেয়ারে অভিযান চালায়।
ঈশ্বরদী থানার ওসি শেখ মো. নাসির উদ্দীন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এই চক্রের অপর দুই সদস্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. আবু সাঈদ ও নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার নাটাবাড়ীয়ার আরশেদ আলী সরকারের ছেলে সুজন আহমেদের  সঙ্গে যোগসাজশ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ১৭০ শ্রমিকের করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে রানা। পরীক্ষাবাবদ প্রত্যেকের কাছ থেকে পাঁচ/ছয় হাজার টাকা করে ফি নেয়া হয়। ওসি জানান, ওই ক্লিনিক মালিককে গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আবদুল ওহাব রানা এবং সুজন আহমেদ বিভিন্ন কোম্পানির শ্রমিকদের করোনা পরীক্ষার জন্য রূপপুর ফটু মার্কেট এলাকায় একটি পরিত্যক্ত ইটভাটার মাঠে তাঁবু টাঙিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এই নমুনা তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। এরপর অনলাইনে রূপপুর মেডিকেয়ার ক্লিনিকের ঠিকানায় রিপোর্ট আসে। অনুসন্ধানে ৫০টি রিপোর্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাধ্যমে পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. আবু সাঈদ বলেন, ওই নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আসা ৫০ জনের নমুনা টেস্টের সঠিক রিপোর্ট আমরা ৬ই জুলাই পাঠিয়েছি। আমাদের জানা ছিল না প্রতিষ্ঠানটির সরকারি অনুমোদন নেই। ওদিকে মেডিকেয়ারের পরিচালক আরিফুল বারী কিরণ বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে আমরা করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টেস্টের ব্যবস্থা করি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status