প্রথম পাতা

গ্লোব বায়োটেকের ‘ভ্যাকসিন’ নিয়ে নানা প্রশ্ন

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

১৫ জুলাই ২০২০, বুধবার, ৯:৩১ পূর্বাহ্ন

করোনার এই মহামারি থেকে মুক্তি খুঁজছে বিশ্ববাসী। এ ভাইরাসটির নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি দুনিয়াতে। তাই মুক্তির পথ হিসেবে দেশে দেশে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রতিযোগিতা। কিছু দেশে ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কারের দাবিও তুলেছে ইতিমধ্যে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও করোনার টিকা আবিষ্কারের দাবি করে আলোচনায় এসেছে গ্লোব বায়োটেক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এ নিয়ে দেশে এবং বিদেশে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ভ্যাকসিন কিংবা ড্রাগ আবিষ্কারের পর তার পূর্ণাঙ্গ ডাটা, ট্রায়াল সম্পন্ন করে, আন্তর্জাতিক জার্নালে রিপোর্ট প্রকাশের পর আবিষ্কারের দাবি করা হয়ে থাকে। কিন্তু গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের বেলায় সেগুলো অনুপস্থিত। এমনকি তারা একটি ভ্যাকসিন ডেভেলপ করে ‘এনিমেল ট্র্রায়াল’ সম্পন্ন করলো কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী কোনো প্রতিষ্ঠানকে জানানোর বা অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। অথচ ঢাকঢোল পিটিয়ে মিডিয়াকে জানিয়েছে। এসব অস্পষ্টতার কারণেই প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাকসিন আবিষ্কার নিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রটোকল অনুযায়ী এখনো তারা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) কোনো অনুমতি নেয়নি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আবিষ্কারের অনেক ধাপ থাকে। অনুমোদন নিতে হয়। নানা নৈতিক বিষয় থাকে। প্রথমে থিওরি, এরপর ল্যাবে কাজ হয়। এখন যদিও প্রযুক্তি দিয়ে কাজ হচ্ছে ল্যাবে। তারপর কিছু প্রাণীর ওপর কাজ করতে হয়। কয়েকটি ধাপের মধ্যে শূন্য পর্যায়ে ২/৪ জন সুস্থ মানুষের ওপর পরীক্ষা করা হয়। প্রথম ধাপে ১০ থেকে ১৫ জন সুস্থ মানুষের ওপর পরীক্ষা করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে একটু বড় স্কেলে ৫০ থেকে ১০০ জন রোগীর ওপর ট্রায়াল হয় এবং ভ্যাকসিন বা ওষুধের ডোজ দেয়া হয়। তৃতীয় ধাপে ৩০ থেকে ৫০ হাজার রোগীর ওপর কাজ করতে হয়। নানা গ্রুপের, বয়সের এবং বিভিন্ন দেশ মিলে তা হতে পারে এটি। নিরাপদ কি-না তাও দেখতে হয়। এরপর ঔষধ প্রশাসনের শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন নিয়ে বাজারজাত করতে হয় চতুর্থ ধাপে। যদি এ ধাপে ওষুধের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তাহলে বাজার থেকে তা তুলে নিতে বলা হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। টিকা বা ভ্যাকসিন হচ্ছে ভাইরাসের কোষে ঢুকিয়ে দেয়া। যা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা  নেবে। কোষে থেকে যুদ্ধ করবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসটির জিন সিকোয়েন্স বা জীবন রহস্য নিয়ে বিভিন্ন দেশ কাজ করছে। গ্লোব বায়োটেক প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকার মর্ডানা সংস্থার ম্যাসেঞ্জার আরএনএ (রোগের বংশ বিস্তারের সংকেত নিয়ে) কাজ করছে। যা এক প্রকার ধার করা জিনিস বলে তারা মনে করেন। গ্লোব বায়োটেকের অভিজ্ঞতাও কম। তারা মাত্র তিনটি খোরগোশের ওপর কাজ করেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, এটা একটা উদ্ভাবনের প্রাথমিক পর্যায়। এটাকে এখনো আবিষ্কার বলা যাবে না। তারা কোনো পাবলিকেশনও করেনি। শুধু মিডিয়াকে জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজিস্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহারা বানু  মানবজমিনকে বলেন, আবিষ্কারের কতগুলো ধাপ রয়েছে। গ্লোব বায়োটেকের আবিষ্কারের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এনিমেলের ওপর করতে হয়। তখন গ্রহণযোগ্য একটি মাত্রা থাকে। এরপর মানুষের ওপর পরীক্ষা করতে হয়। নৈতিক বিষয় থাকে। তাদের এটা একটা উদ্ভাবনের প্রাথমিক পর্যায়। এটাকে এখনো আবিষ্কার বলা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন,  নতুন কোনো কিছু আবিষ্কার করতে কয়েক বছর সময় লাগে। গ্লোব বায়োটেকের টিকা আবিষ্কারের বিষয়টি একটি দাবি। আবিষ্কার বলা যাবে না। তাদেরকে অনেক ধাপ যেতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের ইমার্জিং প্যাথোজেনস ইনস্টিটিউটের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহনূর হোসাইন। বর্তমানে ফ্লোরিডায় গবেষণা করছেন। বাংলাদেশে গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দাবি প্রসঙ্গে তিনি মানবজমিনকে বলেন, ভ্যাকসিন আবিষ্কার নয়। ভ্যাকসিন ডেভেলপ বা তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং বায়ো প্রোসেস ডেভেলপমেন্ট এই দু’টি করার মতো সক্ষমতা বাংলাদেশের এই কোম্পানির পক্ষে সম্ভব নয়।
গ্লোব বায়োটেকের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের প্রধান ড. আসিফ মাহমুদ মানবজমিনকে বলেন, আমরা এ বিষয়ে বিতর্কে যাবো না। আমাদের টার্গেট সফল হওয়া। সফলতার মধ্য দিয়েই বিতর্কের বা প্রশ্নের জবাব মিলবে। আসলে আমরা কাজ শুরু করার পর প্রাথমিকভাবে এটা নিয়ে সফল হয়েছি।
ওদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, তারা আমাদেরকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। নথিভুক্ত হয়নি। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য তাদেরকে অনুমোদন নিতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী তারা বিষয়টি অফিসিয়ালি চিঠি দিয়ে আমাদের জানাবে। এরপর আমরা সেটা দেখবো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status