বাংলারজমিন
বন্যা আর করোনায় ভালো নেই ওরা
১৪ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার, ৮:২১ পূর্বাহ্ন
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: দ্বিতীয় দফা বন্যায় চারদিকে পানি। আর করোনাভাইরাসের কারণে সীমিত চলাচল। এই দু’কারণেই কাজ নেই হাওর পাড়ের দরিদ্র মানুষের। দিন এনে দিন চালানো মানুষগুলো কী কষ্টে আছে তা বলা যাবে না। এই কথাগুলো জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার গাজিনগর গ্রামের কৃষক শাহ আলমের। কৃষক শাহ আলমের এই কথা হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের লাখো মানুষের। যারা সারা দিন পরিশ্রম করে সংসার চালান। বন্যায় পানিবন্দি হয়ে না খেয়েই দিন পার করছেন হাওর পাড়ের বাসিন্দারা। অভিযোগ আছে, বন্যার দু’দিন পার হলেও তাদের জন্য কোনো খাবারের ব্যবস্থা করেনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এমনকি তাদের কোনো খোঁজ-খবরও নেননি তারা। বন্যার্তদের মাঝে যে ত্রাণ সামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জেলার ১১টি উপজেলার সবক’টি হাওরে বন্যার পানি থৈ থৈ করছে। বসতঘর থেকে গোয়ালঘর সর্বত্র পানি ঢুকে পড়েছে। বাড়ির আঙিনায় ৫-৬ ফুট পানি। আবার হাওরের উত্তাল ঢেউয়ে কোনো কোনো বাড়ির উঁচু ভিটেমাটি ভেঙে যাচ্ছে। বসতভিটে রক্ষায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে দিচ্ছেন বাড়ির চারপাশে। ঘরের ভেতরে চৌকিতে কোনোরকমে দিনাতিপাত করছেন অনেকে। অনেকেই আবার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। এক একটি রুমে ভিন্ন পরিবারের লোকজন থাকায় করোনা নিয়েও চিন্তিত বন্যার্ত মানুষজন। দেখা গেছে, দুর্গম হাওর এলাকায় এখনো পৌঁছায়নি পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হাওর এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় দেখা দিয়েছে শুকনো খাবারের সংকট। আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় খেটে খাওয়া মানুষেরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন। ত্রাণই একমাত্র ভরসা তাদের। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার বসিয়া খাউরী গ্রামের গিয়াস উদ্দিন খান বলেন, বাড়ির পশ্চিম দিকে হাওর। বাতাস হলেও ঢেউ উঠে। ঢেউয়ের কারণে ভেঙে যাচ্ছে বসতবাড়ি। সদর উপজেলার মনমতের চর গ্রামের বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, আমার খামারে ৭০০ হাঁস ছিল। বন্যার পানিতে দু’শর মতো হাঁস পানিতে ভেসে গেছে। নিজের ঘরেরই চুলা জ্বলে না দুদিন ধরে। হাঁস-গরুরে খাবার দিবো কীভাবে। হাওরের দুর্ভোগের ছোঁয়া লেগেছে জেলা শহরেও। সুনামগঞ্জ, ছাতক ও দিরাই পৌরশহরের বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানি উঠেছে। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ৯০ ভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নৌকা চলাচল করে শহরের অধিকাংশ সড়কে।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নতুন পাড়া আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী পঙ্কজ তালুকদার বলেন, দু’দফা বন্যায় সবচেয়ে কষ্টে আছেন স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে। চারদিকে পানি থাকায় এই সমস্যায় পড়েছেন। তিনি আরো বলেন, নিচু এলাকায় রান্নাঘরে পানি উঠায় খাবার থাকা সত্ত্বেও রান্না করা যাচ্ছে না।
রৌমারীতে আবারো বন্যা
রৌমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: রৌমারীতে বন্যার ধকল কাটতে না কাটতেই আবারো বন্যা শুরু হয়েছে। গত ১ সপ্তাহে ভারিবর্ষণ ও ভারতীয় পাহাড়ী ঢলে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি হয়ে বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে ভারতের আসাম রাজ্যের ধুবরী জেলার মানকাচর থানাধীন কালো নদী দিয়ে পাহাড়ী ঢল সীমান্ত ঘেঁষা জিঞ্জিরাম নদীতে প্রবাহিত হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সীমান্তবাসী। এতে উপজেলার প্রায় শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নিমজ্জিত হয়েছে ৫ শতাধিক হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল। গতকাল সোমববার সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ও সংযোগ সড়কগুলো ভেঙে গেছে। এক বছর অতিবাহিত হলেও বাঁধ ও সংযোগ সড়কগুলো মেরামত করা হয়নি। ফলে কয়েক দিনের টানা ভারি বর্ষণে ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে ব্রহ্মপুত্র নদের ও জিঞ্জিরাম নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে দু’কুল উপচে বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করেছে। শনিবার সকাল থেকে বেড়িবাঁধের ভাঙা স্থান দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবেশ করছে। আগের বন্যার পানি কিছু শুকালেও হঠাৎ নতুন করে আবারো পানি বৃদ্ধি পেয়ে তলিয়ে গেছে বন্দবেড় ইউনিয়নের কুটিরচর, কান্দাপাড়া, টাঙ্গারীপাড়া, বাইশপাড়া, যাদুরচর ইউনিয়নের চাক্তাবাড়ি, দিগলেপাড়া, নতুনগ্রাম, ধনারচর নতুনগ্রাম, চরেরগ্রাম, হাট মোল্লাপাড়া, পাখিউড়া, রৌমারী সদর ইউনিয়নের ঠনঠনিপাড়া, ভুন্দুরচর, বারবানন্ধা, চুলিয়ারচর, চান্দারচর, নওদপাড়া, ব্যাপারীপাড়া, খাটিয়ামারী, রতনপুর, চরবামনেরচর, মোল্লারচর, শৌলমারী ইউনিয়নের বেহুলারচর, সুতিরপাড়, বোয়ালমারী, কলমেরচর, গয়টাপাড়া, চরশৌলমারী ইউনিয়নের ঘুঘুমারী, খেদাইমারী, চরখেদাইমারী, দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের ইটালুকান্দা, চরগয়টাপাড়া ও ছাটকড়াইবাড়ীসহ উপজেলার প্রায় ১১৫টি গ্রাম। এতে করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৮শ’ পরিবার। পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে পাট, তিল, তিশি, কাউন, চিনা, রোপা আমন, বীজতলাসহ প্রায় ৭শ’ হেক্টর জমির ফসল। বিপাকে পড়েছেন গৃহস্থালী মালামালসহ ছাগল, হাঁস, মুরগী ও গরু, মহিষ নিয়ে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল ইমরান বলেন, নতুন করে বন্যার পানি বৃদ্ধি হওয়ায় এলাকার অনেক ক্ষতি হবে। দিনমজুর ও কৃষকরা আগের বন্যার ধকল থেকে না উঠতেই আবারো বন্যা শুরু হলো। ইতিমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৬টি ইউনিয়নে ২৪ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
আবারো বাড়ছে ব্রহ্মপুত্রের পানি
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: উপর থেকে ঝরছে পানি, নিচেও পানি কাঁদছে বানভাসি। চোখের জল চোখেই শুকিয়ে যাচ্ছে বাড়ছে ব্রহ্মপুত্রের পানি। বন্যার পানি নেমে যেতে না যেতে আবারো পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সদ্য ঘরে ফেরা মানুষজন আবারো বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে বাঁধসহ বিভিন্ন স্থানে। দু’দুবার বন্যায় আক্রান্ত হলেও মেলেনি তাদের ভাগ্যে একমুঠো ত্রাণের চাল। ত্রাণ বিতরণেও উঠেছে নানা অভিযোগ। জানা গেছে, আবারো টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে (সমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত) ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৫১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সদ্য ঘরে ফেরা মানুষজন বাড়িতে ফিরতে না ফিরতে আবারো ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। আর সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত তলিয়ে যেতে শুরু করেছে নদীর তীরবর্তী এলাকাসহ বেশ কিছু এলাকা। ইতিমধ্যে বেশ কিছু গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। নিম্নাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী মানুষজন প্রায় এক সপ্তাহের অধিক সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে বাঁধসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে ঠাঁই নেয়ার পর সদ্য ঘরে ফিরতে না ফিরতে আবারো পানি বৃদ্ধির ফলে ঠাঁই নিতে শুরু করেছে ওয়াপদা বাঁধ ও উঁচু স্থানগুলোতে। ঠাঁই নিলেও সমস্যায় পড়েছে টানা বৃষ্টিতে। বাড়িতে পানি, ঘরে পানি, উপর থেকে পড়ছে পানি ফলে বিপাকে পড়েছে বানভাসীরা। কষ্টের উপর কষ্টে ঝড়ছে চোখের পানি। কষ্ট আর দুর্ভোগ নিয়ে দিন পার করলেও জোটেনি তাদের ভাগ্যে ত্রাণের চাল। রোববার সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় বৃষ্টিতে ভিজে রমনা খামার এলাকায় বাঁধে অস্থায়ী তাবু তৈরি করতে ব্যস্ত রওশনারা, আ. খালেকসহ অনেকের সঙ্গে কথা হতেই আবেগে জড়িয়ে পড়েন তারা। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ভাই গো হামার কি আর কেউ আছে প্রায় ১০দিন ঘরবাড়ি ছাড়ি বাঁধের রাস্তা থাকার পর বাড়ি ফিরেও থাকা হলো না। আবারো পানি বাড়িয়া ঘরবাড়ি তলিয়ে গেল, কি আর করার ফের আসা লাগলো রাস্তায়। এ সময় সাজু, আছিয়া, রওশনারাসহ আরো অনেকে অভিযোগ করেন- দু’দুবার পানিতে ঘরবাড়ি ডুবলো থাকতে হচ্ছে বাঁধের রাস্তায় কিন্তু কেউ আমাদের খবর নিলো না। এমনকি ভাগ্যে একমুঠো ত্রাণের চালও জুটলোনা। তারা আরো জানায়, তাদের হাতে এখন কোনো কাজ নেই করোনার সঙ্গে এখন আবার বন্যা তাদের বড় বিপাকে ফেলেছে। শুধু রমনা খামার এলাকা নয় রাজারভিটা, পুটিমারী, ভরটপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বাঁধসহ উঁচুস্থানে আশ্রয় নেয়া মানুষজন মানবেতর জীবন-যাপন করলেও কেউ খবর নেননি বলে তাদের অভিযোগ। অপরদিকে সরকারিভাবে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হলেও বিতরণ নিয়ে উঠেছে নানা অভিযোগ। প্রকৃত ব্যক্তিরা ত্রাণের বাহিরে থাকছে বলেও অভিযোগ বানভাসীদের। ইউপি চেয়ারম্যানরা জানান, ত্রাণ পরিমাণে অনেক কম তাই সবাইকে দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ ডব্লিউ এম রায়হান শাহ্ বলেন, ধারাবাহিকভাবে বানভাসীদের ত্রাণ দেয়া হবে। তিনি আরো জানান, ত্রাণে অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ধোবাউড়ায় বন্যায় অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত
ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি: ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত ৫টি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম। নেতাই নদীর ভাঙনের তীব্র স্রোতে বিধ্বস্ত হয়ে বিপর্যস্ত গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা। বসতবাড়িতে বন্যার পানি ওঠায় পানিবন্দি হয়ে অনেকেইে তাদের পরিবারের শিশু-বৃদ্ধ ও গবাদিপশু নিয়ে রয়েছে বিপাকে। বানের পানিতে ভেসে গেছে শ’ শ’ মৎস্যচাষির সোনালী স্বপ্ন। উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় আনুমানিক ৪১ হেক্টর জমির ফিসারী ও পুকুর তলিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন মৎস্যচাষিরা। কর্মহীন হয়ে চরম দুর্ভোগে পানিবন্দি অসহায় সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে করোনার কারণে সাধারণ শ্রমজীবীদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। আবার ঘরের ভিতর ঢুকছে পানি। এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের সংকট। বাড়িঘরে পানি ওঠায় গবাদি পশুর আশ্রয়স্থল নিয়ে বন্যাকবলিত মানুষেরা পড়েছেন মহা-দুর্ভোগে। গবাদি পশু নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, রণসিংহপুর, রানীপুর, গৌরীপুর, বহরভিটা, বেতগাছিয়া, উদয়পুর, ঘুঙ্গিয়াজুড়ি, রাউতিসহ প্লাবিত অর্ধশতাধিক গ্রামে চৌকির উপর মাচান বানিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন পানিবন্দি অসহায় মানুষেরা। এ নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ডেভিড রানা চিসিম বলেন, ধোবাউড়া উপজেলার পানিবন্দি মানুষদের জন্য আমরা খাবারের ব্যবস্থা করছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাফিকুজ্জামান বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে এবং বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
দুর্গাপুরে ঢলে একশ’ গ্রাম প্লাবিত
দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি: নেত্রকোনার দুর্গাপুরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। নিম্নাঞ্চলসহ কুল্লাগড়া, গাঁওকান্দিয়া, কাকৈরগড়া ও বাকলজোড়া বিরিশিরি ইউনিয়নের প্রায় ১শত গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, বিনষ্ট হয়েছে আমন ধানের চারা। এ নিয়ে গতকাল সোমবার বিকালে সরজমিনে দেখা গেছে. গত তিনদিনের টানা ভারীবর্ষণ আর ভারতের মেঘালয় থেকে আসা পানির কারণে গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নে প্রায় পনেরদিনের ব্যবধানে ফের বন্যা দেখা দিয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবন-যাপন করছে। ওই এলাকার নেতাই নদীর পানি প্রবল স্রোতে গ্রামে প্রবেশ করছে। এলাকায় কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় ওই ইউনিয়নের বন্দউষান, ভাদুয়া, জাকিরপাড়া, শ্রীপুরসহ প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কাকৈরগড়া ইউনিয়নের ঝাঞ্জাইল, খাঁপাড়া, পালপাড়া, তাতিরকোনা বরবাট্টা, মেকুরজানী সিদলী এলাকার প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাকলজোড়া ইউনিয়নেরও প্রায় ১৫টি গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া কুল্লাগড়া ইউনিয়নের কামারখালী, কাকরাকান্দা, মাধবপুর, বিপিনগঞ্জ এলাকাসহ প্রায় ৩০টি গ্রাম গ্লাবিত হয়েছে। ওইসব গ্রামের সবক’টি গ্রামীন সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা একবারে ভেঙে পড়েছে। চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বেশক’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গুজিরকোনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ভাদুয়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে হাটুপানি। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে বন্দউষান বাজার, স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা। এছাড়া পৌরশহরের কিছু অংশ নতুন করে প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে ইউএনও ফারজানা খানম বলেন, ওই এলাকার বেড়িবাঁধটি ভেঙে যাওয়ার খবর পেয়েছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জরুরিভিওিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
গঙ্গাচড়ায় ঘরবাড়ি বিলীন
গঙ্গাচড়া (রংপুর) প্রতিনিধি: ভারিবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৩০ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ১৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে ২ শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ। তলিয়েছে বীজতলা ও আমন ক্ষেত। উপজেলা প্রশাসন বানভাসিদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের দেয়া তথ্যমতে উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের চিলাখালচর, চরমটুকপুর, খলাইরচর, বিনবিনা, সাউদপাড়া, আলেকিশামত ও উত্তর কোলকোন্দ বাঁধের ধার ২ হাজার, নোহালী ইউনিয়নের বাগডোহরা, মিনার বাজার, চর নোহালী, বৈরাতী ও কচুয়ার ২ হাজার ৫শ’, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের শংকরদহ, চর ইচলী, বাগেরহাট, চর চল্লিশসাল, বাগেরহাট আশ্রয়ণ, কাশিয়াবাড়ি চরের ৩ হাজার, গজঘণ্টা ইউনিয়নের চর ছালাপাক, রামদেব, কামদেব, মহিষাশহরের ৩ হাজার, মর্নেয়া ইউনিয়নের তালপট্টি, নরসিংহ, ভাঙ্গাগড়া, কিসামত, মর্নেয়ার চর, আলাল চরের ২ হাজার ৫শ’, গঙ্গাচড়া ইউনিয়নের ধামুর বাঁধেরপাড়, গান্নারপাড়, বোল্লারপাড়ের ৩’শ ও আলমবিদিতর ইউনিয়নের পাইকান, হাজীপাড়া, ব্যাঙপাড়া এলাকার ৩শ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাগেরহাট এলাকার আনোয়ারুল, জিল্লুর রহমান, মতিয়ার রহমান, সাবিনা বেগম, আজিজুল ইসলাম জানান, গত রোববার রাত থেকে তিস্তার পানি বেড়ে বাড়ি ঘর তলিয়ে যাওয়ায় রান্নাবান্না করতে না পেরে শুকনো খাবার খেয়ে আছি। লক্ষ্মীটারী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান, তিনি রাত থেকে শংকরদহ ও বাগেরহাট এলাকার লোকজনকে নিয়ে ভাঙন রোধে কাজ করছেন। এছাড়া গত ৭ দিনে তিস্তার ভাঙনে তার এলাকায় শতাধিক পরিবার বিলীন হয়েছে।
ফেনীতে বাঁধ ভেঙে ১৫ গ্রাম প্লাবিত
ফেনী প্রতিনিধি: ফেনীতে ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা উজানের পানির ঢলে ফেনীর মুহুরী (মুহুরী-কহুয়া-সিলোনীয়া) নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৯ স্থান ভেঙে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে দুই উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি ও রাস্তাঘাট। ভেসে গেছে কয়েক শতাধক পুকুরের মাছ। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১৫টি গ্রামের হাজারো মানুষ। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন জানান, সোমবার সকাল ৬টায় মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ১ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে রোববার রাতে নদীর পানি বিপদ সীমার ১.৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। প্রবল পানির তোড়ে মুহুরী নদীর ফুলগাজী ও পরশুরাম অংশে অন্তত ৬টি স্থান ভেঙে যায়। এতে দুই উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের নিম্ন্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। ফুলগাজী সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম জানান, গত রোববার রাতে দিকে মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ফুলগাজীর উত্তর দৌলতপুরের ৩টি স্থানে ও কিসমত ঘনিয়া মোড়া গ্রামে ২টি স্থানে ভেঙে যায়। এতে উত্তর দৌলতপুর, বৈরাগপুর, সাহাপাড়া, উত্তর বরইয়া, ঘনিয়া মোড়া, কিসমত ঘনিয়া মোড়া, পূর্ব ঘনিয়া মোড়াসহ অন্তত সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অপরদিকে ফুলগাজী বাজারের পশ্চিম অংশে শ্রীপুর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে ফুলগাজী উপজেলা সদরের প্রধান সড়কও তলিয়ে গেছে। এতে ওইসব এলাকার পাঁচশতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পরশুরামের চিথলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন জানান, মুহুরী নদীর চিথলিয়া অংশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪টি স্থানে ভেঙে ছয়টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
রোববার রাতে দুর্গাপুরের কালাম মেম্বারের বাড়ির পাশে ও দক্ষিণ শালধর সাবেক চেয়ারম্যানের জহিরের বাড়ির পাশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দুইটি অংশ ভেঙে দক্ষিণ শালধর, মালিপাথর, পাগলীরকূল, দুর্গাপুর, রতনপুর, রামপুর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিতে উত্তর ধনীকুণ্ডা, মধ্যম ধনীকুণ্ডা, উত্তর শালধর, রাজসপুর, নোয়াপুরসহ আরো বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হতে পারে বলেও জানান।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, সোমবার সকালে ফেনী জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করবেন। এ সময় তিনি পানিবন্দি তিন শতাধিক মানুষের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করবেন। পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন আক্তার জানান, মুহুরী নদীর বাঁধের ভাঙনকবলিত অংশগুলো মেরামতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে তাগাদা দেয়া হয়েছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন জানান, মুহুরী নদীর বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশে পানি কিছুটা কমলে বাঁধ মেরামতে কাজ করা হবে। এছাড়া নতুন করে বাঁধের কোনো অংশে যেন ভাঙন না ধরে সে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নতুন পাড়া আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী পঙ্কজ তালুকদার বলেন, দু’দফা বন্যায় সবচেয়ে কষ্টে আছেন স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে। চারদিকে পানি থাকায় এই সমস্যায় পড়েছেন। তিনি আরো বলেন, নিচু এলাকায় রান্নাঘরে পানি উঠায় খাবার থাকা সত্ত্বেও রান্না করা যাচ্ছে না।
রৌমারীতে আবারো বন্যা
রৌমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: রৌমারীতে বন্যার ধকল কাটতে না কাটতেই আবারো বন্যা শুরু হয়েছে। গত ১ সপ্তাহে ভারিবর্ষণ ও ভারতীয় পাহাড়ী ঢলে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি হয়ে বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে ভারতের আসাম রাজ্যের ধুবরী জেলার মানকাচর থানাধীন কালো নদী দিয়ে পাহাড়ী ঢল সীমান্ত ঘেঁষা জিঞ্জিরাম নদীতে প্রবাহিত হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সীমান্তবাসী। এতে উপজেলার প্রায় শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নিমজ্জিত হয়েছে ৫ শতাধিক হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল। গতকাল সোমববার সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ও সংযোগ সড়কগুলো ভেঙে গেছে। এক বছর অতিবাহিত হলেও বাঁধ ও সংযোগ সড়কগুলো মেরামত করা হয়নি। ফলে কয়েক দিনের টানা ভারি বর্ষণে ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে ব্রহ্মপুত্র নদের ও জিঞ্জিরাম নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে দু’কুল উপচে বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করেছে। শনিবার সকাল থেকে বেড়িবাঁধের ভাঙা স্থান দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবেশ করছে। আগের বন্যার পানি কিছু শুকালেও হঠাৎ নতুন করে আবারো পানি বৃদ্ধি পেয়ে তলিয়ে গেছে বন্দবেড় ইউনিয়নের কুটিরচর, কান্দাপাড়া, টাঙ্গারীপাড়া, বাইশপাড়া, যাদুরচর ইউনিয়নের চাক্তাবাড়ি, দিগলেপাড়া, নতুনগ্রাম, ধনারচর নতুনগ্রাম, চরেরগ্রাম, হাট মোল্লাপাড়া, পাখিউড়া, রৌমারী সদর ইউনিয়নের ঠনঠনিপাড়া, ভুন্দুরচর, বারবানন্ধা, চুলিয়ারচর, চান্দারচর, নওদপাড়া, ব্যাপারীপাড়া, খাটিয়ামারী, রতনপুর, চরবামনেরচর, মোল্লারচর, শৌলমারী ইউনিয়নের বেহুলারচর, সুতিরপাড়, বোয়ালমারী, কলমেরচর, গয়টাপাড়া, চরশৌলমারী ইউনিয়নের ঘুঘুমারী, খেদাইমারী, চরখেদাইমারী, দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের ইটালুকান্দা, চরগয়টাপাড়া ও ছাটকড়াইবাড়ীসহ উপজেলার প্রায় ১১৫টি গ্রাম। এতে করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৮শ’ পরিবার। পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে পাট, তিল, তিশি, কাউন, চিনা, রোপা আমন, বীজতলাসহ প্রায় ৭শ’ হেক্টর জমির ফসল। বিপাকে পড়েছেন গৃহস্থালী মালামালসহ ছাগল, হাঁস, মুরগী ও গরু, মহিষ নিয়ে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল ইমরান বলেন, নতুন করে বন্যার পানি বৃদ্ধি হওয়ায় এলাকার অনেক ক্ষতি হবে। দিনমজুর ও কৃষকরা আগের বন্যার ধকল থেকে না উঠতেই আবারো বন্যা শুরু হলো। ইতিমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৬টি ইউনিয়নে ২৪ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
আবারো বাড়ছে ব্রহ্মপুত্রের পানি
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: উপর থেকে ঝরছে পানি, নিচেও পানি কাঁদছে বানভাসি। চোখের জল চোখেই শুকিয়ে যাচ্ছে বাড়ছে ব্রহ্মপুত্রের পানি। বন্যার পানি নেমে যেতে না যেতে আবারো পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সদ্য ঘরে ফেরা মানুষজন আবারো বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে বাঁধসহ বিভিন্ন স্থানে। দু’দুবার বন্যায় আক্রান্ত হলেও মেলেনি তাদের ভাগ্যে একমুঠো ত্রাণের চাল। ত্রাণ বিতরণেও উঠেছে নানা অভিযোগ। জানা গেছে, আবারো টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে (সমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত) ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৫১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সদ্য ঘরে ফেরা মানুষজন বাড়িতে ফিরতে না ফিরতে আবারো ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। আর সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত তলিয়ে যেতে শুরু করেছে নদীর তীরবর্তী এলাকাসহ বেশ কিছু এলাকা। ইতিমধ্যে বেশ কিছু গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। নিম্নাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী মানুষজন প্রায় এক সপ্তাহের অধিক সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে বাঁধসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে ঠাঁই নেয়ার পর সদ্য ঘরে ফিরতে না ফিরতে আবারো পানি বৃদ্ধির ফলে ঠাঁই নিতে শুরু করেছে ওয়াপদা বাঁধ ও উঁচু স্থানগুলোতে। ঠাঁই নিলেও সমস্যায় পড়েছে টানা বৃষ্টিতে। বাড়িতে পানি, ঘরে পানি, উপর থেকে পড়ছে পানি ফলে বিপাকে পড়েছে বানভাসীরা। কষ্টের উপর কষ্টে ঝড়ছে চোখের পানি। কষ্ট আর দুর্ভোগ নিয়ে দিন পার করলেও জোটেনি তাদের ভাগ্যে ত্রাণের চাল। রোববার সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় বৃষ্টিতে ভিজে রমনা খামার এলাকায় বাঁধে অস্থায়ী তাবু তৈরি করতে ব্যস্ত রওশনারা, আ. খালেকসহ অনেকের সঙ্গে কথা হতেই আবেগে জড়িয়ে পড়েন তারা। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ভাই গো হামার কি আর কেউ আছে প্রায় ১০দিন ঘরবাড়ি ছাড়ি বাঁধের রাস্তা থাকার পর বাড়ি ফিরেও থাকা হলো না। আবারো পানি বাড়িয়া ঘরবাড়ি তলিয়ে গেল, কি আর করার ফের আসা লাগলো রাস্তায়। এ সময় সাজু, আছিয়া, রওশনারাসহ আরো অনেকে অভিযোগ করেন- দু’দুবার পানিতে ঘরবাড়ি ডুবলো থাকতে হচ্ছে বাঁধের রাস্তায় কিন্তু কেউ আমাদের খবর নিলো না। এমনকি ভাগ্যে একমুঠো ত্রাণের চালও জুটলোনা। তারা আরো জানায়, তাদের হাতে এখন কোনো কাজ নেই করোনার সঙ্গে এখন আবার বন্যা তাদের বড় বিপাকে ফেলেছে। শুধু রমনা খামার এলাকা নয় রাজারভিটা, পুটিমারী, ভরটপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বাঁধসহ উঁচুস্থানে আশ্রয় নেয়া মানুষজন মানবেতর জীবন-যাপন করলেও কেউ খবর নেননি বলে তাদের অভিযোগ। অপরদিকে সরকারিভাবে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হলেও বিতরণ নিয়ে উঠেছে নানা অভিযোগ। প্রকৃত ব্যক্তিরা ত্রাণের বাহিরে থাকছে বলেও অভিযোগ বানভাসীদের। ইউপি চেয়ারম্যানরা জানান, ত্রাণ পরিমাণে অনেক কম তাই সবাইকে দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ ডব্লিউ এম রায়হান শাহ্ বলেন, ধারাবাহিকভাবে বানভাসীদের ত্রাণ দেয়া হবে। তিনি আরো জানান, ত্রাণে অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ধোবাউড়ায় বন্যায় অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত
ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি: ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত ৫টি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম। নেতাই নদীর ভাঙনের তীব্র স্রোতে বিধ্বস্ত হয়ে বিপর্যস্ত গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা। বসতবাড়িতে বন্যার পানি ওঠায় পানিবন্দি হয়ে অনেকেইে তাদের পরিবারের শিশু-বৃদ্ধ ও গবাদিপশু নিয়ে রয়েছে বিপাকে। বানের পানিতে ভেসে গেছে শ’ শ’ মৎস্যচাষির সোনালী স্বপ্ন। উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় আনুমানিক ৪১ হেক্টর জমির ফিসারী ও পুকুর তলিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন মৎস্যচাষিরা। কর্মহীন হয়ে চরম দুর্ভোগে পানিবন্দি অসহায় সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে করোনার কারণে সাধারণ শ্রমজীবীদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। আবার ঘরের ভিতর ঢুকছে পানি। এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের সংকট। বাড়িঘরে পানি ওঠায় গবাদি পশুর আশ্রয়স্থল নিয়ে বন্যাকবলিত মানুষেরা পড়েছেন মহা-দুর্ভোগে। গবাদি পশু নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, রণসিংহপুর, রানীপুর, গৌরীপুর, বহরভিটা, বেতগাছিয়া, উদয়পুর, ঘুঙ্গিয়াজুড়ি, রাউতিসহ প্লাবিত অর্ধশতাধিক গ্রামে চৌকির উপর মাচান বানিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন পানিবন্দি অসহায় মানুষেরা। এ নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ডেভিড রানা চিসিম বলেন, ধোবাউড়া উপজেলার পানিবন্দি মানুষদের জন্য আমরা খাবারের ব্যবস্থা করছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাফিকুজ্জামান বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে এবং বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
দুর্গাপুরে ঢলে একশ’ গ্রাম প্লাবিত
দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি: নেত্রকোনার দুর্গাপুরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। নিম্নাঞ্চলসহ কুল্লাগড়া, গাঁওকান্দিয়া, কাকৈরগড়া ও বাকলজোড়া বিরিশিরি ইউনিয়নের প্রায় ১শত গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, বিনষ্ট হয়েছে আমন ধানের চারা। এ নিয়ে গতকাল সোমবার বিকালে সরজমিনে দেখা গেছে. গত তিনদিনের টানা ভারীবর্ষণ আর ভারতের মেঘালয় থেকে আসা পানির কারণে গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নে প্রায় পনেরদিনের ব্যবধানে ফের বন্যা দেখা দিয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবন-যাপন করছে। ওই এলাকার নেতাই নদীর পানি প্রবল স্রোতে গ্রামে প্রবেশ করছে। এলাকায় কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় ওই ইউনিয়নের বন্দউষান, ভাদুয়া, জাকিরপাড়া, শ্রীপুরসহ প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কাকৈরগড়া ইউনিয়নের ঝাঞ্জাইল, খাঁপাড়া, পালপাড়া, তাতিরকোনা বরবাট্টা, মেকুরজানী সিদলী এলাকার প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাকলজোড়া ইউনিয়নেরও প্রায় ১৫টি গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া কুল্লাগড়া ইউনিয়নের কামারখালী, কাকরাকান্দা, মাধবপুর, বিপিনগঞ্জ এলাকাসহ প্রায় ৩০টি গ্রাম গ্লাবিত হয়েছে। ওইসব গ্রামের সবক’টি গ্রামীন সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা একবারে ভেঙে পড়েছে। চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বেশক’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গুজিরকোনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ভাদুয়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে হাটুপানি। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে বন্দউষান বাজার, স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা। এছাড়া পৌরশহরের কিছু অংশ নতুন করে প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে ইউএনও ফারজানা খানম বলেন, ওই এলাকার বেড়িবাঁধটি ভেঙে যাওয়ার খবর পেয়েছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জরুরিভিওিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
গঙ্গাচড়ায় ঘরবাড়ি বিলীন
গঙ্গাচড়া (রংপুর) প্রতিনিধি: ভারিবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৩০ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ১৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে ২ শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ। তলিয়েছে বীজতলা ও আমন ক্ষেত। উপজেলা প্রশাসন বানভাসিদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের দেয়া তথ্যমতে উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের চিলাখালচর, চরমটুকপুর, খলাইরচর, বিনবিনা, সাউদপাড়া, আলেকিশামত ও উত্তর কোলকোন্দ বাঁধের ধার ২ হাজার, নোহালী ইউনিয়নের বাগডোহরা, মিনার বাজার, চর নোহালী, বৈরাতী ও কচুয়ার ২ হাজার ৫শ’, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের শংকরদহ, চর ইচলী, বাগেরহাট, চর চল্লিশসাল, বাগেরহাট আশ্রয়ণ, কাশিয়াবাড়ি চরের ৩ হাজার, গজঘণ্টা ইউনিয়নের চর ছালাপাক, রামদেব, কামদেব, মহিষাশহরের ৩ হাজার, মর্নেয়া ইউনিয়নের তালপট্টি, নরসিংহ, ভাঙ্গাগড়া, কিসামত, মর্নেয়ার চর, আলাল চরের ২ হাজার ৫শ’, গঙ্গাচড়া ইউনিয়নের ধামুর বাঁধেরপাড়, গান্নারপাড়, বোল্লারপাড়ের ৩’শ ও আলমবিদিতর ইউনিয়নের পাইকান, হাজীপাড়া, ব্যাঙপাড়া এলাকার ৩শ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাগেরহাট এলাকার আনোয়ারুল, জিল্লুর রহমান, মতিয়ার রহমান, সাবিনা বেগম, আজিজুল ইসলাম জানান, গত রোববার রাত থেকে তিস্তার পানি বেড়ে বাড়ি ঘর তলিয়ে যাওয়ায় রান্নাবান্না করতে না পেরে শুকনো খাবার খেয়ে আছি। লক্ষ্মীটারী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান, তিনি রাত থেকে শংকরদহ ও বাগেরহাট এলাকার লোকজনকে নিয়ে ভাঙন রোধে কাজ করছেন। এছাড়া গত ৭ দিনে তিস্তার ভাঙনে তার এলাকায় শতাধিক পরিবার বিলীন হয়েছে।
ফেনীতে বাঁধ ভেঙে ১৫ গ্রাম প্লাবিত
ফেনী প্রতিনিধি: ফেনীতে ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা উজানের পানির ঢলে ফেনীর মুহুরী (মুহুরী-কহুয়া-সিলোনীয়া) নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৯ স্থান ভেঙে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে দুই উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি ও রাস্তাঘাট। ভেসে গেছে কয়েক শতাধক পুকুরের মাছ। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১৫টি গ্রামের হাজারো মানুষ। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন জানান, সোমবার সকাল ৬টায় মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ১ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে রোববার রাতে নদীর পানি বিপদ সীমার ১.৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। প্রবল পানির তোড়ে মুহুরী নদীর ফুলগাজী ও পরশুরাম অংশে অন্তত ৬টি স্থান ভেঙে যায়। এতে দুই উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের নিম্ন্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। ফুলগাজী সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম জানান, গত রোববার রাতে দিকে মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ফুলগাজীর উত্তর দৌলতপুরের ৩টি স্থানে ও কিসমত ঘনিয়া মোড়া গ্রামে ২টি স্থানে ভেঙে যায়। এতে উত্তর দৌলতপুর, বৈরাগপুর, সাহাপাড়া, উত্তর বরইয়া, ঘনিয়া মোড়া, কিসমত ঘনিয়া মোড়া, পূর্ব ঘনিয়া মোড়াসহ অন্তত সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অপরদিকে ফুলগাজী বাজারের পশ্চিম অংশে শ্রীপুর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে ফুলগাজী উপজেলা সদরের প্রধান সড়কও তলিয়ে গেছে। এতে ওইসব এলাকার পাঁচশতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পরশুরামের চিথলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন জানান, মুহুরী নদীর চিথলিয়া অংশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪টি স্থানে ভেঙে ছয়টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
রোববার রাতে দুর্গাপুরের কালাম মেম্বারের বাড়ির পাশে ও দক্ষিণ শালধর সাবেক চেয়ারম্যানের জহিরের বাড়ির পাশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দুইটি অংশ ভেঙে দক্ষিণ শালধর, মালিপাথর, পাগলীরকূল, দুর্গাপুর, রতনপুর, রামপুর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিতে উত্তর ধনীকুণ্ডা, মধ্যম ধনীকুণ্ডা, উত্তর শালধর, রাজসপুর, নোয়াপুরসহ আরো বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হতে পারে বলেও জানান।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, সোমবার সকালে ফেনী জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করবেন। এ সময় তিনি পানিবন্দি তিন শতাধিক মানুষের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করবেন। পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন আক্তার জানান, মুহুরী নদীর বাঁধের ভাঙনকবলিত অংশগুলো মেরামতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে তাগাদা দেয়া হয়েছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন জানান, মুহুরী নদীর বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশে পানি কিছুটা কমলে বাঁধ মেরামতে কাজ করা হবে। এছাড়া নতুন করে বাঁধের কোনো অংশে যেন ভাঙন না ধরে সে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।