শেষের পাতা

যে মৃত্যুকে ঘিরে সিলেটে জল্পনা

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে

১০ জুলাই ২০২০, শুক্রবার, ৯:৪৩ পূর্বাহ্ন

সিলেটের একটি মৃত্যুকে ঘিরে অনেক জল্পনা। কেউ বলছেন হত্যা, কেউ বা আত্মহত্যা। দিন যতই যাচ্ছে, এই মৃত্যুকে ঘিরে ডালপালা আরো ততো মেলছে। মুখ খুলেছে পরিবারও। ঘটনাটিকে হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে সুষ্ঠু তদন্ত ও খুনিদের খুঁজে বের করার দাবি জানিয়েছেন মা। এনিয়ে তিনি সিলেটে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। এরপর থেকে পুলিশও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পুলিশ বলছে- ঘটনায় যদিও অপমৃত্যু মামলা হয়েছে, পুলিশ তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। যখনই সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মিলবে তখই হত্যা মামলায় রূপান্তর করে আসামি গ্রেপ্তার করা হবে। এদিকে- এ ঘটনার প্রতিবাদে সিলেটে ক্ষোভ বাড়ছে। গতকালও সিলেটে মানববন্ধন করে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন ছাত্র অধিকার সিলেট জেলা শাখার নেতারা। হাফেজ ইফজাল আহমদ। সিলেটের এমসি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি কোরআনে হাফেজ। মাদ্রাসায় পড়া শেষ করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভর্তি হন সিলেটের এমসি কলেজে। মেধাবী ছাত্র হিসেবেও পরিচিত। বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ঝিঙ্গাবাড়ি এলাকার কাপ্তানপুর গ্রামে। পিতৃহীন সংসারে ইফজালের আরো তিন ভাইয়ের সবাই মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। মা আছারুন নেছা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। হাফিজ ইফজাল বসবাস করতেন নগরীর উপশহরে তার বোনের বাসায়। ওই এলাকার ‘বি’ ব্লকের ১৮নং রোডের ৩নং বাসা ‘বাহার মঞ্জিল’র উপরের ফ্লাটে বড় বোন নাসিমা বেগমকে নিয়ে বাস করতেন তিনি। নাসিমা বেগমের স্বামী বসবাস করেন সৌদি আরবে। মূলত নাসিমা তার দুই ছেলেকে ভালো স্কুলে পড়ালেখা করাতে কানাইঘাট থেকে সিলেটে বাসা ভাড়া নিয়ে আসেন। এরপর থেকে ছোটো ভাই ইফজালকে সঙ্গে রাখেন। বাসা নেয়ার পর নাসিমার দেবর মিনহাজ আহমদও মাঝে-মধ্যে ওই বাসাতে এসে বসবাস করতেন। লকডাউনের আগে এক বছর তিনি ঢাকায় ট্রেনিংয়ে ছিলেন। সিলেট ফিরে নিজ বাড়িতেই চলে গেছেন। ঘটনা গত ২৫শে জুন। আগের রাতে হাফিজ ইফজাল আহমদ খাওয়া-দাওয়া করে নিজ কক্ষে ঘুমিয়ে পড়েন। পরের দিন সকালে বাসার নিচ তলার এক বাসিন্দা দেখেন ইফজালের লাশ পড়ে আছে। তিনি চিৎকার দিলে দৌঁড়ে যান নাসিমা বেগম। গিয়ে দেখেন তার ছোটো ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে। এরপর ঘটনাটি জানাজানি হলে পুলিশ যায়, ছুটে আসেন আত্মীয়-স্বজনও। পুলিশসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান- লাশের শরীরে আঘাতে চিহ্ন ছিলো। মাথায় গামছা ও কোমরে দড়ি বাধা ছিলো। এ কারণে অনেকেই ঘটনাটিকে হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করেন। ওদিকে- ইফজালের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের পর কানাইঘাটের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। ঘটনার পর ইফজালের চাচাতো ভাই, সম্পর্কে তালতো ভাই আবুল হোসেন বাদী হয়ে শাহপরান (রহ.) থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেন। এদিকে- থানায় অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হলেও হাফিজ ইফজালের সহপাঠিসহ আত্মীয়-স্বজন ঘটনাটিকে হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। চলে দোষারোপের খেলা। অনেকেই ঘটনার জন্য আত্মীয়-স্বজনকেই দায়ী করেন। এমসি কলেজের শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। এ কারণে পুলিশও হয়েছে সক্রিয়। ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনে পুলিশের একটি টিম কাজ শুরু করেছে। এদিকে- ঘটনার ১৩ দিনের মাথায় মুখ খুলেছেন ইফজালের মা। বুধবার তিনি সিলেটে এসে সংবাদ সম্মেলন করে তার ছেলের মৃত্যুর ঘটনাটি হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করেছেন। ইফজালের মা আছারুন নেছা দাবি করেন- তার ছেলে ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়নি। তাকে কে বা কারা হত্যা করেছে। ছেলের মৃত্যুর ১৩ দিন পরও মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি। আছারুন নেছার পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন নিহত ইফজালের আপন চাচাতো ভাই গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘সিলেট নগরীর উপশহর ‘বি’ ব্লকের ১৮নং রোডের ৩নং বাসা বাহার মঞ্জিলে আমার মেয়ের বাসায় থাকতো ইফজাল আহমদ। ঘটনার দিন সকালে ওই ভবনের নিচে তার লাশ পাওয়া যায়। দাফন-কাফন শেষে ২৬ তারিখে শাহপরান থানায় এনিয়ে একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়’। তিনি বলেন, ‘অনেকে দোষারোপ করছেন এবং বলছেন- ইফজালের পরিবার এখন পর্যন্ত মামলা করেনি কেন? আমার অন্য ছেলেরা প্রবাসে থাকার কারণে মেয়ের ভাসুর আবুল হোসাইনকে মামলা করার জন্য পাঠানো হয়েছিলো, সঙ্গে ছিলেন কানাইঘাট উপজেলার ৮নং ঝিংগাবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্বাস উদ্দিনসহ কয়েকজন। আবুল হোসাইন অপমৃত্যুর এই আবেদন দাখিল করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে ওনাকে যেভাবে বলে পাঠানো হয়েছিল থানায়, দেখা যায় অপমৃত্যু মামলায় আমাদের কথার কোনো প্রতিফলন নেই।’ তবে, এটাকে অপমৃত্যু বলে বিশ্বাস করতে চান না আছারুন নেছা। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। এখনো জানতে পারিনি আমার ছেলেকে কে বা কারা হত্যা করেছে।’ তিনি সুষ্ঠু ও অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে তার সন্তানের মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন করে খুনিদের চিহ্নিত করার দাবি জানান। বলেন, ‘অধিকতর তদন্তের স্বার্থে শাহপরান থানায় দায়েরকৃত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অথবা অন্য কোনো বিশেষায়িত সংস্থার কাছে হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছি।’ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ‘অপমৃত্যু’ মামলার বাদী আবুল হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন- ‘আমি হত্যা মামলা করতে চেয়েছিলাম। বারবার চেষ্টার পরও শাহপরান থানা পুলিশ হত্যা মামলা নিতে রাজি হয়নি। আর হত্যাকাণ্ড হওয়ার তো কথা না। কারণ- ইফজালের সঙ্গে কারো শত্রুতা নেই।’ এদিকে- সিলেটের শাহপরান (রহ.) থানার ওসি আব্দুল কাইয়ূম চৌধুরী মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘বাদীপক্ষ যেভাবে এজাহার দিয়েছেন সেভাবেই মামলা হয়েছে। পুলিশ তো পরিবারের কথার বাইরে যেতে পারেনা। এখন যেহেতু অপমৃত্যু মামলা হয়েছে পুলিশ পুরো ঘটনাটিই তদন্ত করছে। এটি হত্যাকাণ্ড হলে, কারো সম্পৃক্ততা থাকলে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে। আমরা তদন্তে আছি। এছাড়া ময়না তদন্ত রিপোর্টেও সব পরিস্কার হবে।’ মানববন্ধন: হাফিজ ইফজাল আহমদ হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও খুনিদের বিচারের দাবিতে গতকাল দুপুরে নগরীর চৌহাট্টাস্থ সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সিলেট জেলা শাখার উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে নগরীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে। এতে একাত্মতা পোষণ করে টিউশন সেবা সিলেট-বিভাগ। আব্দুল্লাহ আল মামুন সুজনের পরিচালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন- ছাত্র অধিকার পরিষদের বিভাগীয় যুগ্ম আহবায়ক নাজমুস সাকিব, এস এম মনসুর, এম.সি কলেজের যুগ্ম আহ্বায়ক বশির আহমদ, অংকুর দাস, রবিন আমহদ, কে এম ওয়ালিদ চৌধুরী, মুসা মিয়া, বেলাল আহমদ প্রমুখ। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, সম্পূর্ণ সুস্থ ও তরতাজা মেধাবী যুবক হাফিজ ইফজালকে কে বা কারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। ইফজাল হত্যার ১৪ দিন পেরিয়ে গেলেও ঘটনার কোনো কূল কিনারা হয়নি। এই হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করবেন না। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ইফজালের লাশের পাশেই রশি রাখা, দুর্ঘটনা হলে এখানে রশি আসবে কোথা থেকে? ইফজালের আম্মা সিলেট প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে ইফজালের হত্যার বিচার দাবি করেন। নিহতের লাশের প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় কাউন্সিলর সালেহ আহমদ সেলিম ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন- ইফজালের কোমরে রশি বাঁধা অবস্থায় তিনি দেখেছেন এবং তিনি সঠিক তদন্ত চান। দুই ছাদের মধ্যখানের সামান্য গ্যাপ দিয়ে কেউ লম্বা হয়ে নিচে পড়ে থাকবে এটা বিশ্বাসযোগ্য?
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status