মত-মতান্তর

করোনা: ভালোবাসার এপিঠ ওপিঠ

শামীমুল হক

৬ জুলাই ২০২০, সোমবার, ৯:৫৭ পূর্বাহ্ন

যান্ত্রিক এ যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন হয়েছে মানুষের মন। এ পরিবর্তন চোখের সামনে এনে দিচ্ছে আজব সব কাহিনী। বুকভরা ভালোবাসা এখন শুধুই অতীত। করোনাকালে ভালোবাসার অন্যরুপ হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে। দেখিয়েছে ভালোবাসার এপিঠ- ওপিঠ দুটিই। গর্ভধারিনী মা, জন্মদাতা পিতাকেও তাদের কলিজার টুকরা সন্তান দূরে ঠেলে দিয়েছে। ফেলে দিয়ে এসেছে জঙ্গলে। এমনকি জীবনসঙ্গী স্বামীও কম জাননি। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া পিতা-মাতাকেও সন্তান যাচ্ছে না দাফন করতে। এতো গেল একপিঠ। অপরপিঠে দেখা গেছে করোনা আক্রান্ত পিতাকে কোন কোন সন্তান পরম মমতায় আগলে রেখেছে। সেবা দিয়ে সুস্থ করে তৃপ্তির হাসি হেসেছে। শুধু তা-ই নয়। করোনা আক্রান্ত সন্তানকে হাসপাতালে কেউ ধরছেনা। কিন্তু পিতা জড়িয়ে ধরে পরম মমতায় অ্যাম্বুলেন্সে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যও দেখেছি আমরা। আবার মৃত সন্তানের লাশ কেউ ধরছেনা। এ অবস্থায় মা তার দুই হাতে তুলে নেন লাশ। নিয়ে যান কবরে। হৃদয় নাড়া দেয়ার এসব ঘটনা মানুষকে কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে।
করোনাকালে হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছে গত ১৩ ই এপ্রিল। এক নারীকে করোনা সন্দেহে জঙ্গলে ফেলে গেছেন তার স্বামী সন্তানরা। ওই দিন গভীর রাতে টাঙ্গাইলের সখিপুর জঙ্গলে ওই নারীকে ফেলে চলে যান তারা। জঙ্গলে ওই নারীর কান্নার শব্দ শুনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। পরে জানা যায়, ওই নারী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার বাসিন্দা। ইউএনও আসমাউল হুসনা লিজা খবর পেয়ে রাত দেড়টায় পুলিশ সদস্য ও মেডিকেল টিম নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ওই নারীকে উদ্ধার করে ইউএনও রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তার স্বামী-সন্তান গাজীপুরের সালনায় পোশাক কারখানায় কাজ করেন। ফেলে রেখে যাওয়ার সময় ওই নারীকে বলা হয়, পর দিন সকালে বাড়ি নিয়ে যাবে। স্বামী ও সন্তানের এমন ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
৬ জুন ঘটে যাওয়া ঘটনা আরও মর্মান্তিক। ওই দিন দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের পাশের রাস্তা থেকে ৫০ বছর বয়সী মনোয়ারা বেগম নামে একজনকে উদ্ধার করেন মেডিকেল ক্যাম্প পুলিশ। তাকে ভর্তি করা হয় করোনা ইউনিটে। খবর নিয়ে জানা যায়, তিন দিন আগেই মনোয়ারাকে রাস্তায় ফেলে রেখে যায় তার সন্তান। শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়ার পর সন্তান এ কান্ড করে। এই তিন দিন ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়ে ছিলেন তিনি। পরিবারের সঙ্গে মিরপুর কমার্স কলেজের পাশের একটি বস্তিতে থাকতেন মনোয়ারা। অথচ চিকিৎসকরা বলছেন কারো শ্বাসকষ্ট হলেই কোভিড আক্রান্ত ভেবে নেয়া ঠিক নয়। এছাড়া করোনা মহামারির মধ্যে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের প্রতি বেশি খেয়াল রাখার তাগিদ দেয়া হচ্ছে বার বার। এ সময়ে নিজের নাড়ী ছেড়া ধন সন্তান ও জীবন সঙ্গী স্বামী যদি এমন করতে পারে অন্যদের বেলায় তো তা হতেই পারে। এছাড়া মৃত্যুর পরও পিতা কিংবা মাতাকে দাফন করতে যায়নি সন্তান। এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। এখন যেন এগুলো গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম এ নিয়ে মানুষ ছিঃ ছিঃ করলেও এখন আর এ নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তবে, করোনা আক্রান্ত পিতার জন্য তিন সন্তানের যুদ্ধের খবর দেশ বিদেশের মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে। ভালোবাসার কাছে যে করোনাভাইরাস কিচ্ছু না, সেটা প্রমাণ করলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিন ভাই মাসুম, মারুফ ও মোস্তাক। ৭২ বছর বয়সী বাবার শরীরে ধরা পড়া করোনার বিরুদ্ধে এক মাসের লড়াই শেষে জয়ী হয়েছেন তারা। রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে আশুগঞ্জের বাসিন্দা ৭২ বছর বয়সী মতি মিয়া জ্বরে আক্রান্ত হন। দিন যায় আর মতি মিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। জ্বরের সঙ্গে যোগ হতে থাকে শ্বাসকষ্ট, কাশি বা শরীর ব্যথার মতো উপসর্গ। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে বাবাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন সন্তানরা।
দ্রুত মতি মিয়াকে ভর্তি করে করোনা সাসপেক্টেড ইউনিটে পাঠানো হয়। মতি মিয়ার বড় ছেলে মাহফুজুর মাসুম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, এই অবস্থা দেখে ডাক্তাররাও একরকম আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে সন্তন হিসেবে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াইটা চালিয়ে যেতে চেয়েছি। হাসপাতালে ভর্তির পর মতি মিয়ার করোনা পরীক্ষা করা হয়। দুই দিন পর ফলাফল আসে পজিটিভ। এরপরও সন্তানদের একবারের জন্য মনে হয়নি বাবাকে একা রেখে চলে যাবে। আর তাই তিন ভাই মিলে বাবাকে সাসপেক্টেড ইউনিট থেকে ট্রান্সফার করে করোনা ইউনিটে নিয়ে আসেন। রোজার ঈদের দিন থেকে হাসপাতালের ৯০২ নম্বর করোনা ইউনিটের ৪৯ নম্বর বেডে শুরু হয় তিন সন্তানের লড়াই। তিন ভাই নিয়ম করে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি দেন বাবার পাশে। বাবার প্রতি ভালোবাসা করোনাও দমাতে পারেনি তাদের। প্রায় এক মাস হাসপাতালের করোনা ইউনিটে এত রোগীর মধ্যে থাকায় তিন ভাই ধরেই নিয়েছিলেন তারাও হয়তো করোনায় আক্রান্ত হবেন। তিন ভাই-ই করোনার টেস্ট করেছেন। তিন ভাইয়েরই ফলাফল নেগেটিভ। বাবার ভালোবাসা যে সন্তনদের সঙ্গে আছে, তাদের তো করোনাভাইরাস ভয় পাবেই।
করোনাকালে এমন হাজারো ঘটনা হয়তো ঘটেছে। তবে ভালোবাসার দ্বি-রুপ দেখেছে বিশ্ব। পিতা- মাতার লাশ দাফনে সন্তানরা না এলেও দেশে এমন হাজারো স্বেচ্ছাসেবী এগিয়ে এসেছেন। তারা লাশ দাফন করেছেন। এ লাশ দাফন করতে গিয়েও অনেক জায়গায় বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কেউ কেউ। আবার কারো ভাগ্যে জুটেনি খাটিয়া। করোনা মানুষের মুখোশ খুলে দিয়েছে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নতুন পৃথীবিকে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status