এক্সক্লুসিভ
সরাইলে করোনাজয়ী ৬ জনের গল্প
মাহবুব খান বাবুল, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে
৩০ জুন ২০২০, মঙ্গলবার, ৮:১০ পূর্বাহ্ন
এক মাসেরও অধিক সময় করোনার সঙ্গে লড়াই করে সরাইলে জয়ী হয়েছেন ৬ জন। এদের মধ্যে ৩ জন পুরুষ ও ৩ জন মহিলা। যুদ্ধকালীন সময়ের নানা গল্প তাদের স্মৃতিতে আছে এবং থাকবে অনন্তকাল। চিকিৎসকের পরামর্শে কাটানো তাদের দৈনন্দিন চলাফেরা ও পরিচ্ছন্নতার গল্প সকলেরই জানা প্রয়োজন। কখনো ভয়। কখনো সাহসিকতা। সব মিলিয়েই লড়েছেন তারা। করেছেন কঠোর পরিশ্রম। স্বীকার করেছেন ত্যাগ। তাদের শেষ কথা একটাই- ভয় পেলে করোনাকে জয় করা কঠিন। করোনা জয়ী ৬ ব্যক্তিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন নির্বাহী কর্মকর্তা এএসএম মোসা ও ইউএইচও ডা. মো. নোমান মিয়াসহ হাসপাতালের নমুনা সংগ্রহকারী টিমের সদস্যরা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সরাইল উপজেলা কমপ্লেক্সে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদেরকে জানানো হয়েছে শুভেচ্ছা। হাসপাতাল ও আক্রান্ত ব্যক্তিরা জানান, আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকেই ভয় পেয়ে গেছেন। আবার অনেকে সাহসের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই লড়াই করেছেন। পিতা-মাতা, স্বামী শিশুসন্তানকে ফেলে একা জীবন-যাপন করেছেন আইসোলেশনে। কেউ হাসপাতালে। আবার অনেকে বাড়িতেই হোম আইসোলেশনে থেকেছেন। আইসোলেশনে করেছেন স্বাস্থ্য বিধি সহ নানা নিয়ম-কানুন পালনের যুদ্ধ। বাঁচার লড়াইয়ে তাদের কেউই অলসতা করেননি। শাহবাজপুর গ্রামের সৌরভ পাল (৩০)। অল্প কয়েকদিন হয়েছে বিয়ে করেছেন। লাখাই উপজেলায় বাংলাদেশ কৃষিব্যাংক মুড়াকুড়ি শাখায় চাকরি করেন। গত ১২ই মে তার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। স্বজনরা ভেঙে পড়লেও ঘাবড়ে যাননি সৌরভ পাল। সৌরভ পাল বলেন, আমি জানতাম আমাকে সচেতন হতে হবে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে লড়াই চালিয়ে গেলে করোনা কিছুই করতে পারবে না। তাই করেছি। সম্পূর্ণ আলাদা একটি কক্ষে এক মাসেরও অধিক সময় কাটিয়েছি। আমি কখনো ভয় পায়নি। মনে সাহস রেখেছি। চিকিৎসকের পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। ঘুম থেকে উঠেই হালকা কুসুম গরম পানির ভাব নিয়েছি। নিয়মিত সেই পানি পান করেছি। ওষুধ সেবন করেছি সময়মতো। প্রত্যেকদিন পরনের কাপড় ধৌত করেছি। বিছানার চাদর বালিশসহ সবকিছু পরিষ্কার রেখেছি। একটু পরপর জীবাণুনাশক ছিটিয়েছি। ওয়াশরুম খুব ভালো করে পরিষ্কার রেখেছি। প্রোটিনযুক্ত খাবার বেশি খেয়েছি। প্লেট গ্লাস এগুলো নিয়মিত সাবান দিয়ে ধৌত করেছি। আমার ভেতরে কখনো করোনার কাছে পরাজিত হতে হবে এমন চিন্তা আসেনি। জয়ী আমি হবোই। এ মানসিকতা কাজ করেছে। করোনা ভয়ে ভেঙে পড়লে হবে না। করোনায় আক্রান্ত হলে অবশ্যই সাহসের সঙ্গে লড়াই করে যেতে হবে। একই গ্রামের সাহারা বেগম (৫৫)। ৪ ছেলে ও ২ কন্যা সন্তানের জননী তিনি। মাঝে-মধ্যে এলাকায় ধাত্রীর কাজ করেন। করোনা জয়ী সাহারা বলেন, আক্রান্তের খবরে ভেঙে পড়েছিলাম। কারণ শুনেছি বয়স্করা করোনার ধাক্কা সামলাতে পারে না। ছেলেরা সাহস দিয়েছে। নিয়ম মেনে ওষুধ খেয়েছি। এক সময় ভয় কেটে গেছে। আজকে খুবই ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে নতুন পৃথিবী পেয়েছি। আরেক যোদ্ধা সরাইল সদরের দেওয়ান হাবলি গ্রামের মোছা. হোসনা খাতুন (৫৪)। তিনি বলেন, করোনার চেয়ে মানুষের সমালোচনায় বেশি ভয় পেয়েছি। একা একটি কক্ষে থেকেছি। সকল নিয়ম সঠিকভাবে পালন করেছি। সন্তানরা সেবা শুশ্রূষা করেছে। একাধিকবার কোরআন খতম করেছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছি। এক সময় ভেতরের ভয়টা উধাও হয়ে গেছে। পরে শুধু সময় গুনেছি। আজ ঈদের মতো আনন্দ লাগছে। নিজ সরাইল গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য মো. জিতু মিয়া (৫৪) আক্রান্তের খবর পান ২৩শে মে। ২৪শে মে আক্রান্ত হয়ে পড়েন উনার স্ত্রী লাভলী ইসলাম (৪৮)। এক পরিবারে দুইজন আক্রান্ত হওয়ায় সন্তানসহ অন্য স্বজনরাও ভেঙে পড়েছিলেন। দু’জনই চলে যান হোম আইসোলেশনে। স্বাস্থ্য বিধি ও নিয়মের মধ্যে চলে তাদের দিন যাপন। তারা বলেন, চারদিক থেকে আসা মৃত্যুর খবর আমাদেরকে কাঁপিয়ে তুলতো। না জানি কোন সময় আমাদের মৃত্যুটা হয়ে যায়। এমন সব ভাবনা প্রথমদিকে আমাদের কুরে খেত। সপ্তাহ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর শরীর পাতলা অনুভব হতে লাগল। ভীতিও কাটতে শুরু করলো। তখন সাহস বেড়ে গেল। ভাবলাম এ লড়াইয়ে হারলে চলবে না। জয়ী আমাদের হতেই হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত জীবন-যাপন আমাদেরকে সুস্থ করে তুলেছে। আমরা চিকিৎসকদের কাছেও ঋণী। একই গ্রামের বাসিন্দা মো. নূরুজ্জামান (৩০) বলেন, আক্রান্তের খবরে প্রথমে অনেক ভয় পেয়েছি। আর আশপাশের লোকজনের কথাবার্তা ও আচরণে মন আরো বেশি খারাপ হয়েছিল। তবে চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও আমাদের নিয়মানুবর্তিতার কারণে আল্লাহ্ রহমত করেছেন। আল্লাহ্র কাছেও আমরা শুকরিয়া জানাই। সকলকে যেন আল্লাহ্ করোনা ভাইরাস থেকে হেফাজত করেন। করোনার শুরুর দিকে আক্রান্ত হয়েছিলেন তেরকান্দা গ্রামের গৃহবধূ শামীমা বেগম। তিনিও দীর্ঘদিন জেলা শহরের আইসোলেশনে থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এ পর্যন্ত সরাইলে মোট আক্রান্ত ৪৬ জন। আর সুস্থ হয়েছেন ৭ জন। সরাইল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ও করোনা নিরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ কমিটির লিডার ডা. আনাস ইব্নে মালেক বলেন, দীর্ঘ ৩ মাস ধরে করোনা রোগী শনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহের কাজ করছি। কাজটি যদিও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। জীবন বাজি রেখেই করে যাচ্ছি। আবার করোনা রোগীদের সেবাও দিচ্ছি। আজ ৬ জন রোগীকে সম্পূর্ণ করোনামুক্ত ঘোষণা করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। পেছনের সকল কষ্ট আজ ভুলে গেছি। আরো ভালো লাগছে তাদের করোনা জয়ের গল্প শুনে। এ যোদ্ধাদের অনুসরণ অনুকরণ করলে ইনশাআল্লাহ্ করোনা আমাদের কিছু করতে পারবে না।