এক্সক্লুসিভ

আর সরব হবে না কামরানের ‘ড্রয়িংরুম’

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

১৭ জুন ২০২০, বুধবার, ৮:১৩ পূর্বাহ্ন

বাসায় ঢুকলেই প্রথমে চোখ পড়বে ড্রয়িংরুমে। সরব এক ড্রয়িং রুম। সব সময় মানুষের গিজগিজ। নানা কাজে আসা মানুষের ভিড়। ড্রয়িং রুমে মধ্যমণি একজন। কখনো চেয়ারে হেলান দিয়ে, আবার কখনো স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বসে কথা শুনছেন মানুষের। মনোযোগ দিয়েই শুনছেন কথা। সব কথা শেষ হলে সংক্ষেপে সাজেশন। এতেই সন্তুষ্ট কাজে আসা মানুষ। কখনো কখনো  মোবাইল বের করে ফোন। নানা দপ্তরে এই ফোন। যার কাজ তার জন্যই সামনে রেখে ফোন করেন। অনুরোধ করেন। কাজটি যেনো করে দেন। কাজও হয়ে যায়। জগতের সব দুশ্চিন্তা নিয়ে কামরানের কাছে ছুটে আসা মানুষটি তখন বেরিয়ে যায় হাসিমুখে। এই ছিলেন সিলেটে সদ্য প্রয়াত হওয়া নেতা বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। এ কারণে সকাল হলেই মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠতো তার ড্রয়িংরুম। দুপুরের পর নানা অনুষ্ঠানে ডাক পড়তো কামরানের। কখনো দলীয় কর্মসূচি, আবার কখনো সরকারি মিটিংয়ে কিংবা বিয়ে সাদি, জানাজাতে। সব কিছুতেই হাসিমুখে উপস্থিত হতে কামরান। এ কারণে দুপুরের দিকটায় নিরব থাকতো তার ড্রয়িং রুম। আবার সন্ধ্যা হলেই মানুষের ভিড়। কামরান বসতে ড্রয়িং রুমে। এ কারনে কাজে ছুটে আসা মানুষেরা ভিড় করতেন। সিলেটের যে কোনো পথ ও মতের মানুষ জানে- সবার দরোজা বন্ধ হলেও কামরানের দরোজাটি বন্ধ নয়। এ কারণে ঘোর বিপদে পড়া মানুষজন তার কাছেই ছুটে যেতেন। কখনো কখনো অনেকেই ‘অযাচিত’ অনুরোধ নিয়ে যেতেন। ছেলের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যখন মামলা কিংবা পুলিশের গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন এমন পিতা-মাতাও নিয়ে যেতেন আব্দার। ছেলের জন্য যেনো একটু পুলিশে ফোন করেন। বিপদগ্রস্ত পিতা-মাতাকেও কামরান ফিরিয়ে দিতেন না। ফোন করতেন। আটক থাকা ব্যক্তিকে মারধোর না করতে অনুরোধ করতেন। আওয়ামী লীগের বিরোধী হলেও মাঝে মধ্যে কামরান এই কাজ করে দিতেন। এতে কম বিতর্কিত হননি তিনি। বিপদগ্রস্ত হয়ে তার কাছে ছুটে আসা মানুষকে তিনি কখনো ফিরিয়ে দিতেন না। প্রায়ই বলতেন- ‘অসহায় বিপদে পড়া সিলেটের মানুষ যাবে কোথায়। তারা শান্তি ও স্বস্তির জন্য ছুটে আসে। তাদের ফিরিয়ে দিলে আল্লাহর কাছে মাফ পাবো না।’ সোমবার মারা গেছেন সিলেটবাসীর প্রিয় মুখ কামরান। মহামারি করোনা তাকে কেড়ে নিলো সিলেটের মানুষের কাছ থেকে। এ কারণে শোকে কাদছে সিলেট। নগর ভবনেও চলছে তিন দিনের শোক। সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগও তিন দিনের শোক কর্মসূচি পালন করছে। নগরীর ছড়ারপাড়ের ৬৫ নং বাসাটি সবার পরিচিত। এই বাড়ি সিলেটের প্রিয় মানুষ কামরানের। তার কারণেই বাড়িটি সবার কাছে পরিচিত। সিলেট শহরের প্রায় সব মানুষই চেনেন বাড়ি। কামরানের দীর্ঘ রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল জীবনের কারণে বাড়িটি সবার কাছে প্রিয়। কামরান সব ভাইদের নিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস করতেন। ছায়ার মতো আগলে রেখেছেন সব ভাইকে। কখনো তিনি পিতার শূন্যতা অনুভব করতে দেননি। এই বাড়ির প্রবেশ মুখেই দু’তলা ঘর কামরানের। বাড়ির প্রধান ফটক খোলামেলা। কোনো গ্রিলের দরজা লাগানো হয়নি। যে কেউ সহজেই বাড়িতে ঢুকতে পারবে। স্বজনরা জানান- মাঝে মধ্যে তাদের কেউ কেউ কামরানের নিরাপত্তার স্বার্থে ফটকে গ্রিলের দরোজা লাগানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু কামরান এতে সায় দেননি। কামরান স্বজনদের জানিয়েছিলেন- ‘সিলেটের মানুষের জন্য কামরানের দরোজা সব সময় খোলা। ফটক লাগালে অনেকেই এসে ঢুকবে না। সুতরাং আমার দরোজা কারো জন্য কখনোই বন্ধ নয়।’ ভাইরা কিংবা পরিবারের লোকজন কেউই এতে আপত্তি তোলেননি। ফটকের পাশেই কামরানের ড্রয়িং রুম। ২০০৪ সালে সিলেট নগরীর গুলশানে এবং টিলাগড়ে একটি ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে কামরানের উপর পরপর দুই দফা গ্রেনেড হামলা হয়। ওই সময়ও কামরান তার বাড়ির ফটকে গ্রিলের দরোজা লাগাননি। সব সময়ই বলতেন- ‘সবাই আমার আপন, আমাকে কে মারতে আসবে। আর যদি মৃত্যু এভাবেই থাকে তাহলে মরবো, কেউ আটকাতে পারবে না।’  মঙ্গলবার দুপুরে বাড়ির ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই চোখে পড়লো নীরব ড্রয়িং রুম। বসা আছেন দু’জন ব্যক্তি। তারা স্বজন। রুম খালি এজন্য বসে আছেন। বাড়ির ভেতরও শূন্য। নীরব হয়ে পড়েছে পুরো বাড়ি। নিচ থেকেই আর্তনাদের সুর কানে আসছে। নিজ ঘরে বসে বড় ছেলে ডা. আরমান আহমদ শিপলু আর্তনাদ করছেন। বাবা, বাবা বলে চিৎকার করছেন। ঘুম থেকে উঠেছেন একটু আগে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই তিনি পিতার ঘরে ছুটে যেতেন। এখন আর কোথায় যাবেন। কার কাছে গিয়ে বসবেন। তার আর্তনাদ থামছিলো না। দেখেই বললেন- ‘আমি অভাগা সন্তান। বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না। আমার কোলে মাথা রেখে বিদায় নিলেন বাবা। কিছু বলে গেলেন না। হাসিমাখা মুখটি চিরতরে হারিয়ে গেলো। আমি এখন বাঁচবো কী করে।’ কামরানের স্ত্রী আসমা কামরান। স্বামীর মৃত্যুতে কোনো বাধাই মানছেন না তিনি। অঝোরে কাঁদছেন। গলার স্বর কমে এসেছে। ছেলের কান্না শুনে ছুটে আসলেন। ছেলে শিপলুকে বললেন- ‘বাবা এতিম হয়ে গেলে। এখন আর কে দেখবে তোমাদের।’ এমন আর্তনাদ কামরানের পুরো বাসাজুড়ে। ছবি ভালো বাসতেন কামরান। এ কারণে সিলেটের প্রায় সব ফটো সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাদা সংখ্যতা। কামরানের ড্রয়িং রুমে তাই ছবি বেশি। স্মৃতি হিসেবে তিনি সব ছবি ফ্রেম বন্দি করে রাখতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছবি বেশি। প্রয়াত নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ, স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, ইফতেখার হোসেন শামীম সিলেটের অনেক নেতার ছবি তার ড্রয়িংরুমে শোভা পাচ্ছে। এসব ছবি প্রায় সময়ই দেখতেন কামরান। ফিরে যেতেন অতীত স্মৃতিতে। মহামারি করোনাকালে তিনিও হয়ে গেলেন ছবি। চির দিনের জন্য ‘ছবি’ হয়ে সিলেটের নানা ধরনের মানুষের কাছে স্মৃতি হয়ে থাকবেন কামরান।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status