এক্সক্লুসিভ

বর্ণ নয় কর্মই মুখ্য

১৭ জুন ২০২০, বুধবার, ৮:০১ পূর্বাহ্ন

গোটা বিশ্ব কোভিড-১৯ এর আক্রমণে বিপর্যস্ত। খোদ আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা ২ (দুই) মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা সোয়া লাখের অধিক। ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এরই মাঝে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আমেরিকা বর্ণবাদী সহিংসতায় উত্তাল। ্তুব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’   স্লোগানে মুখরিত। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, টরেন্টো সহ পৃথিবীর প্রধান প্রধান শহরগুলোতে। সহিংসতার মাত্রা এতোটাই ছাড়িয়েছে যে, নিউ ইয়র্ক, লস অ্যানজেলেস, ওয়াশিংটন, মায়ামি, শিকাগোর মতো ৪০ টি বড় শহরে কারফিউ জারি করতে হয়েছে। ২৫শে মে মিনিয়াপোলিস শহরে ডেরেক শেভিন  নামের এক পুলিশ সদস্য ৪৬ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হাঁটু দিয়ে টুঁটি চেপে হত্যা করে। ফ্লয়েড চিৎকার করে বলছিল ্তুআই কান্ট ব্রেথ’। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল জালনোট ব্যবহারের। ১৭ বছর বয়সের স্কুলছাত্রী ডার্নেলা ফ্রেজিয়ারের মুঠোফোনে ধারণকৃত ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন মুহূর্তেই স্ফুলিঙ্গের ন্যায় দানা বাঁধে। মর্মান্তিক এই দৃশ্যটি নাড়া দেয় আমেরিকা সহ গোটা বিশ্ব বিবেককে। ফলশ্রুতিতে ্তুআই কান্ট ব্রেথ’- স্লোগানই বর্ণবাদ বিরোধী প্রতিবাদের ভাষায় রূপান্তরিত হয়।
এ বছরের শুরুতেই আমেরিকায় আরও দুইজন কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ২৩শে ফেব্রুয়ারি জর্জিয়ায় আহমদ আরবেরিকে (২৫) গুলি করে হত্যা করে স্থানীয় দুই শ্বেতাঙ্গ গ্রেগরি ও তার ছেলে ট্র্যাভিস ম্যাকমাইকেল। ১৩ই মার্চ ক্যানটাকিতে লুইসভিলি মেট্রো পুলিশ ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা সন্দেহবশত ব্রেয়োনা টেলর (২৬) নামের এক মেয়েকে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তার ঘরের দরজা ভেঙে অন্তত ৮ টি গুলি করে হত্যা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ফ্লয়েড এ বছরের তৃতীয় বর্ণবাদী হত্যাকাণ্ড।
বর্তমান আমেরিকার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে আফ্রিকান দাসদের অমানবিক পরিশ্রম ও নির্যাতনের ইতিহাস। শিকলবন্দি আফ্রিকান কালোদের বহনকারী জাহাজটি ভার্জিনিয়া উপকূলে ভিড়েছিলো ১৬৬১ সালের ২৪শে আগস্ট। জীবনের সব ক্ষেত্রেই কালোদের বৈষম্যের শিকার হওয়া ছিল সাধারণ ঘটনা। এমনকি আইন করে বর্ণবাদকে টিকিয়ে রাখা ছিল ইতিহাসে নজিরবিহীন। ১৮৪৭ সালের ভার্জিনিয়া ক্রিমিনাল কোডের বিধান অনুযায়ী যদি কোনো শ্বেতাঙ্গ পড়ালেখার উদ্দেশে কোনো কৃষ্ণাঙ্গকে মুক্ত করে অথবা একত্রিত করে, তাহলে সে কারাবাস এবং জরিমানার সম্মুখীন হবে। এই বিধানের অধীনে মার্গারেট ডগলাস কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের শিক্ষাদানের অপরাধে জরিমানাসহ কারাভোগ করেন।
 ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার নেপথ্যে রয়েছে কালোদের অসামান্য অবদান। স্বাধীনতার ইশতেহারে দাসপ্রথা বিলুপ্তির অঙ্গীকার থাকলেও তা বাস্তবায়ন হতে সময় লেগেছে শতাধিক বছর।  আমেরিকান গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-১৮৬৫) মূল কারণ ছিল দাসপ্রথা বিলুপ্তির দ্বন্দ্ব। গৃহযুদ্ধে বিজয় লাভের পর আব্রাহাম লিঙ্কন কর্তৃক ১৮৬৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দাসপ্রথার অবসান ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর (১৮৬৫) মাধ্যমে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়। চতুর্দশ সংশোধনীর (১৮৬৮) মাধ্যমে কালোদের নাগরিকত্ব প্রদান এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর (১৮৭০) মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রদান আমেরিকার ইতিহাসে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এতসব সাংবিধানিক সংস্কারের পরেও বর্ণবাদের অস্তিত্ব আমেরিকার সর্বত্র বিদ্যমান। এর প্রকৃষ্ট নজির প্লেসি বনাম ফার্গুসন (১৮৯৬) ১৬৩ ট.ঝ. ৫৩৭ (১৯৯৬) মামলা। মামলার বাদী  প্লেসি ১৮৯০ সালের আইন অনুযায়ী শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত রেলে আরোহণ করার অপরাধে লুইজিয়ানার একটি আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত হন। সংক্ষুব্ধ প্লেসি আপিল দায়ের করলে আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত ইকুয়্যাল বাট সেপারেট’- নীতির ভিত্তিতে বর্ণবাদকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে।  
বর্ণবাদের এমন অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে দেশে দেশে বর্ণবাদ দূরীকরণের আন্দোলনের ইতিহাসও নাতিদীর্ঘ। মার্টিন লুথার কিং জুুনিয়র (১৯২৯-১৯৬৮) তার বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’- ভাষণে (১৯৬৩) প্রকাশ্যে কালোদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেন। তার সেই বক্তব্য আজও জগদ্বিখ্যাত । ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১৯৬৮ সালে তিনি নিজেও শ্বেতাঙ্গ আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রসঙ্গ এলেই নেলসন ম্যান্ডেলার নাম ভেসে ওঠে। তিনি বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অভিসংবাদিত নেতা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। আন্দোলনের অপরাধে দীর্ঘ ২৭ বছর (১৯৬২-১৯৯০) কারাভোগ করেন। রোবেন দ্বীপে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। স্থানীয়দের নিকট মাদিবা নামে পরিচিত এই মহান নেতার দীর্ঘ সংগ্রামের সুফল হিসেবে ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইসলাম পূর্ববর্তী সময়ে কালোদেরকেই মূলত দাস হিসেবে কেনাবেচা করা হতো। মানুষ হিসেবে তাদের ন্যূনতম কোনো অধিকার ছিল না। ্তুমানুষের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য আল্লাহ্‌র নিদর্শন’ (আল-কোরআন- ৩০:২২)। বর্ণের চেয়ে কর্মের গুরুত্বই অধিক।  ্তুআল্লাহ্‌র কাছে সেই উত্তম যার খোদাভীতি এবং পরহেজগারিতা বেশি’ (আল-কোরআন-৪৯:১৩)। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা:) তার সম্পদের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করেছেন নির্যাতিত দাসদের মুক্ত করার জন্য। হযরত বেলাল, আমির ইবনে ফুহাইরা, উম্মে উবাইস, জিন্নেরাহ্‌, আন-নাহদিয়্যাহ ও তার মেয়ে হিন্দিয়্যাহ (রা:) সহ অসংখ্য দাসদাসীদের তিনি মুক্ত করেন। তাঁর পিতার প্রশ্নের জবাবে হযরত আবু বকর (রা:) বলেন, আমি এ কাজ শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য করছি। রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্‌ (সা:) এর সঙ্গে একই উটের পিঠে আরোহণ করেছিলেন কালো বর্ণের ওসামা বিন যায়েদ (র:)।  সেদিন রাসূলুল্লাহ (সা:) এর সঙ্গে কালো বর্ণের আরো দু’জন সাহাবী ওসামা বিন যায়েদ (র:) ও বেলাল ইবনে রাবাহ (র:) কাবার অভ্যন্তরে প্রথম প্রবেশ করেন। ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (সা:) ঘোষণা করেন 'আজ থেকে সাদার উপর কালোর আর কালোর উপর সাদার কোনো মর্যাদা নেই, পরহেজগারিতাই শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে।'

মোহাম্মদ শিশির মনির: এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
যায়েদ বিন আমজাদ: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status