মত-মতান্তর

বাংলাদেশ জার্নাল: হেমিলিয়নের বাঁশিওয়ালা

ডা: আলী জাহান

১২ জুন ২০২০, শুক্রবার, ৭:৫৩ পূর্বাহ্ন

১. জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডাক্তার মাহমুদ মনোয়ার (৪৩) আজ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। উনাকে নিয়ে আজ করোনা আক্রান্ত ডাক্তারদের মারা যাবার সংখ্যাটি ২৯ হলো। এ ২৯ জন ডাক্তার ছাড়াও করোনার উপসর্গ নিয়ে আরও ৫ জন ডাক্তার মারা গেছেন। মৃত্যুর মিছিল চলছে। এবং চলবে। থামার কোন লক্ষণ নেই। থামানোর কোনো আয়োজন নেই।

২. পথে-ঘাটে, হাসপাতালের বেডে, ফ্লোরে করিডোরে চিকিৎসাসহ এবং চিকিৎসা ছাড়া মানুষ মারা যাচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সে করে, গাড়িতে করে, রিক্সা সিএনজিতে করে রোগী নিয়ে আত্মীয়-স্বজন ঘুরছেন হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য। অধিকাংশ হাসপাতাল রোগী ভর্তি নিচ্ছে না। ফলাফল হচ্ছে রাস্তায় মারা যাওয়া। রাস্তায় সাধারণ লোকজন মারা যাচ্ছেন। সমাজের বিত্তবান মানুষ মারা যাচ্ছেন। একটি আইসিইউ বেডের জন্য হাহাকার করতে করতে যুগ্ম-সচিব পর্যায়ের লোক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন। নিজের ডাক্তার মেয়েও কিছু করতে পারছেন না।
এমন ঝুঁকির মধ্যে আছেন বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিক।আপনার যদি উঁচু তলায় আসা-যাওয়া না থাকে তাহলে ডায়াগনোসিস করার আগেই বাড়িতে বা রাস্তায় মরে যেতে হবে। এমন একটি মৃত্যুর জন্য আমাদের প্রস্তুতি খুব প্রয়োজন। আমরা প্রস্তুত আছি তো?

৩. পুরো বাংলাদেশ জুড়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও তিন হাজার ৪৭১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন ৪৬ জন। এ পর্যন্ত সারাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৯৫ জন। মৃতের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৯৫ জনে। এ সংখ্যা যে জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকবে সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কারণ হচ্ছে যে দানবকে আটকানোর জন্য যা করা প্রয়োজন তা আমরা করিনি এবং করছিনা। হেমিলিয়নের বাঁশিওয়ালা এসেছে। এই বাঁশির সুরে জনপদ যদি বিরানও হয়ে যায় তাতে আমাদের কিছু যায় আসে?

৪.ডাক্তার মনোয়ারের পরিবার হয়তো সরকারের ঘোষিত ৫০ লক্ষ টাকা পাবেন যেহেতু তিনি সরকারি ডাক্তার। বেসরকারী ডাক্তারদের কী হচ্ছে? প্রাইভেট হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে যে হাজার হাজার বেসরকারি ডাক্তার মানুষকে চিকিৎসা দিচ্ছেন তারা যদি করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাদের ব্যাপারে কি রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই?

৫. আপনি বা আমি যখন মারা যাবো তখন রাষ্ট্রের কাছে আমি শুধুই একটি সংখ্যা। কিন্তু পরিবারের কাছে আপনি তাদের পৃথিবী। আপনার মৃত্যু মানে একটি পরিবারের সব আয়োজন ধসে পড়া। আপনার চলে যাওয়া মানে তাদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসা। আপনার চলে যাওয়া মানে হচ্ছে ওই পরিবারের আজীবনের জন্য হাহাকার তৈরি করা। আপনি কি আসলেই কোন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন?

৬. মাসুম চৌধুরী একজন গার্মেন্টস মালিক এবং মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন আলোকিত মানুষ। ইকোটেক্স নামে তাঁর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রয়েছে। সে ফ্যাক্টরিতে উনার কর্মীসংখ্যা ১২ হাজার। সরকার যখন গার্মেন্টস গুলো খুলে দেয় তখন তিনিও তার ফ্যাক্টরির দরজা খুলে দেন। তবে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। গার্মেন্টস কর্মীরা যখন ফ্যাক্টরিতে ঢুকবে তখন পরস্পরের মধ্যে কমপক্ষে তিন ফুট ফাঁকা জায়গা থাকতে হবে। মাস্ক পরে প্রবেশ করতে হবে। ফ্যাক্টরির প্রবেশপথে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। প্রবেশপথের থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে প্রত্যেকের তাপমাত্রা নেয়া হচ্ছে। ফ্যাক্টরির ভেতরে সেলাই মেশিন গুলো কমপক্ষে তিন ফুট দূরে দূরে বসানো হয়েছে। আরেকটি কাজ করেছেন মাসুম চৌধুরী। তাঁর সকল গার্মেন্টসকর্মীর হেলথ ইন্সুরেন্স করেছেন একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাথে। তার কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বা গার্মেন্টস কর্মী করোনা অথবা অন্য কোন রোগে আক্রান্ত হলে নিদৃষ্ট হাসপাতাল এবং বীমা কোম্পানি আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাবে। ইন্স্যুরেন্সের বাদবাকি সুবিধাও রয়েছে। অভিনন্দন মাসুম চৌধুরী। আপনার মানবিক কাজটি একটি উদাহরণ হতে পারে।

৭. বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে ডাক্তারি চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন তাদের কেউ যদি আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাদের কোন ইন্সুরেন্স করা আছে? আমার ধারণা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশের কোন ইন্সুরেন্স নেই। একজন মাসুম চৌধুরী তাঁর গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য যা দিচ্ছেন তা আমাদের প্রাইভেট হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের মালিকেরা ডাক্তারদের দেবেন না? কেন দেবেন না?

৮. মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে যা করার তা তাদের নিজেদেরই করতে হবে। উপরতলার সিদ্ধান্তহীনতা, অসামর্থ্য এবং অস্থিরতা তাদের কিছুই দিচ্ছে না। মাঝখান থেকে মানুষ মারা পড়ছে।তাই সেই মৃত্যুর হাত থেকে কিছু কিছু এলাকায় মানুষ নিজস্ব কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।

৯. সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের একটি খবর সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে আমার চোখে পড়েছে। এলাকার বিভিন্ন বাজারে একটি সংস্থার পক্ষ থেকে বড় বড় বিলবোর্ড/পোস্টার লাগানো হয়েছে। করোনা রোগ সংক্রান্ত সতর্কতা বাণী এবং চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষকে সজাগ করার জন্য এগুলো ভূমিকা রাখছে। ৫৫ হাজার মানুষের ইউনিয়নে মেডিকেল সেন্টার থাকলেও কোন রেজিস্টার্ড ডাক্তার নেই। টেলিমেডিসিন সার্ভিস দেবার জন্য Bhadeswar Corona Medical Support ডাক্তারদের একটি টিম করা হয়েছে (ডাক্তাররা এলাকার বাইরে থাকেন)। তাঁরা এলাকার মানুষদের টেলিফোনে মেডিকেল উপদেশ দিচ্ছেন। ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রবেশপথে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে নিরাপদ হাত ধোয়া উৎসাহিত করার জন্য পানি এবং সাবানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এলাকার মানুষ খুব ভয়ে আছে। তাঁরা জানেন যে তাদেরকে কিছু করতে হবে। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। ইউনিয়নে এ পর্যন্ত ৮ জন করোনা রোগী ধরা পড়েছেন। এখনো কোন মৃত্যু হয়নি। স্থানীয় লোকজন চেষ্টা করছেন করোনা রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে।

১০. একটি কথা আবারও বলি। আপনার মৃত্যু সরকারের কাছে একটি সংখ্যা মাত্র। তবে আপনার মৃত্যু হতে পারে আপনার পুরো পরিবারের মৃত্যু। ভেতর থেকে জেগে উঠুন। নিজ উদ্যোগে নিজেদের বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসুন।গার্মেন্টস উদ্যোক্তা মাসুম চৌধুরীর মতো নিজের অধীনে থাকা মানুষগুলোকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। নিজের এলাকাকে রক্ষা করার জন্য সিলেটের ভাদেশ্বর ইউনিয়নের দিকে তাকাতে পারেন।

১৩. হেমিলিয়নের বাঁশিওয়ালাকে থামান। নাহলে জনপদ বিরানভূমি হয়ে যেতে পারে।আপনি আমি হয়ে যেতে পারি সরকারের একটি সংখ্যা কিন্তু পরিবারের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ। একবার চোখ বন্ধ করুন। কল্পনা করুন আপনার অবর্তমানে আপনার পরিবার কেমন থাকবে?

- - -
ইংল্যান্ডে কর্মরত বাংলাদেশি ডাক্তার
 [email protected]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status