মত-মতান্তর

মূর্খের অনুকরণ: পরিণতি কী?

রুহুল আমিন রিপন

১ জুন ২০২০, সোমবার, ৬:২২ পূর্বাহ্ন

'অনুকরণ' শিক্ষার অন্যতম একটি মাধ্যম। একটু আগে যে পাখিছানা জন্ম নিল, সে অল্প কিছুদিনের মধ্যে মাকে অনুকরণ করে উড়তে শিখবে। অন্যদের অনুকরণে প্রথমবারের মতো গর্ভধারণ করা মা ইলিশটাও সমুদ্র ছেড়ে নদীতে যাবে ডিম পাড়তে। প্রাণিকূলের মতো মানবকূলও অনুকরণ করে শেখে, বেঁচে থাকে। শিশুকালে আমরা যখন কিছুই বুঝি না, বলতে পারি না, তখন থেকেই অনুকরণ করি। বাবামার বডি ল্যাংগুয়েজ (ভাবভঙ্গি) অনুকরণ করি, জবাব দেয়ার চেষ্টা করি।

তবে বাঙালি একটু বেশিই অনুকরণপ্রিয়। বানরের মত। গল্পটা জানেন আপনারা। তারপরও উল্লেখ করছি। 'গ্রামের এক টুপিওয়ালা। টুপি বানিয়ে ও বাজারে বিক্রি করে চলত তার জীবন। বাড়ী আর বাজারের মাঝখানে ছিল একটা বন। গাছে গাছে থাকতো অসংখ্য বানর। টুপিওয়ালা বানর ভয় না পেলেও এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত এবং সাথে একটা মোটা লাঠি রাখত।

একদিন বাজার যাওয়ার পথে ক্লান্ত হয়ে পড়ল টুপিওয়ালা। একটা বড় গাছের নীচে টুপির ব্যাগ একপাশে রেখে একটা টুপি মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো টুপিওয়ালা। তার ঘুম ভাঙে বানরের চেঁচামেচিতে। ব্যাগের দিকে তাকিয়ে তো তার চক্ষু ছানাবড়া। একটা টুপিও নেই ব্যাগে। টুপি নিয়ে খেলা করছে বানর।

লোকটি চিন্তা করলো কিভাবে টুপিগুলো ফেরত পাওয়া যায়। হঠাৎ তার মনে পড়ল, বানর খুব অনুকরণপ্রিয়। তাই টুপিওয়ালা মাথার নিচের টুপিটি নিয়ে একটু ঝাড়ামোছা করল। দেখলো বানরগুলো তাই করছে। সে এবার টুপিটা মাথায় দিলো। বানরগুলোও টুপি মাথায় দিলো। লোকটি এবার মাথা থেকে টুপি খুলে মাটিতে ছুঁড়ে মারলো। বানরগুলোও তার দেখাদেখি টুপি ছুঁড়ে মারল মাটিতে। লোকটি দ্রুত টুপিগুলো কুড়িয়ে ব্যাগে ভরে বাজারে গেলো।'
গল্পটার সারমর্ম বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। তার একটি হল, অনুকরণ সবসময় ভাল না।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়িয়ে রোগিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাপী পিপিই গাউন পরতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। তাদের অনুকরণে সাংবাদিক, পুলিশ, ব্যবসায়ী অনেকেই পিপিই পরছেন। কিন্তু কেউ জানেন না, কখন পিপিই পরতে হয়, কীভাবে পরতে হয়, পিপিই কার জন্য! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈজ্ঞানিক হিসাব নিকাশ করে বিভিন্ন ধরনের পিপিইর অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে ইউরিয়া সারের প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত পলিথিন থেকে শুরু করে নানান কিছু দিয়ে পিপিই তৈরি হচ্ছে। ফলে যাদের পরার কথা না তাদের অনেকেই পিপিই পরে অসুস্থ হচ্ছেন। যাদের বানানোর কথা না তারাও পিপিই বানাচ্ছেন। অর্থাৎ অনুকরণ সবসময় ভাল ফল দেয় না।
মনে রাখবেন, মুর্খের অনুকরণ আরও ভয়াবহ হতে পারে। এই গল্পটাও আপনারা জানেন। তারপরও উল্লেখ করছি। রাজা একবার ঘোষণা দিলেন, তিনি আহাম্মক দেখতে চান। উজির, নাজির, পাইক-পেয়াদা রাজ্যে নেমে পড়লেন আহাম্মকের সন্ধানে। কিছু সময় পর, তাদের চোখে পড়ল, নেংটি পড়া এক লোক হেসে হেসে অন্যদের সাথে কথা বলছে। পাইক পেয়াদার মনে হল, এর চেয়ে বড় আহাম্মক আর কে। ব্যাস! তাকে ধরে রাজদরবারে আনা হল। নেংটি পড়া 'আদিমানব' দেখে দরবারের সবাই লজ্জা পেলেন। কিন্তু রাজার সামনে হাসার সাধ্য কার! হাসি লুকাতে সবাই মুখে রুমাল চেপে ধরলেন। 'আদিমানব' ভাবল, এটাই বুঝি রীতি। অন্যদের অনুকরণে সে তার পরনের নেংটি খুলে মুখ চেপে ধরল।

শুরু থেকেই দেখছি, কর্মকর্তা লেভেলের (সরকারি/বেসরকারি) অনেকেই পিপিই পরে অফিস করছেন। অফিসে অফিসে এ নিয়ে রাজদরবারে মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যাদের পিপিই নেই, তারা পরছেন অস্বস্তিতে। আর যারা পরছেন তারা ট্রলের শিকার হচ্ছেন। অনেকে আবার ট্রল হওয়ার জন্য সগৌরবে নিজের ছবি সামান্যই যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

পিপিই কোন খেলনা না। মন চাইল ছেলে মেয়ের জন্য কিনে নিয়ে আসলেন। পিপিই একটা উচ্চপ্রযুক্তির স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্য। এটা সবাই বানাইতে পারে না। সবার পরার জন্যও না। এমনি পিপিই পরারও নিয়মকানুন আছে। পিপিই পরার কারণে আপনার মধ্যে বাড়তি জোশ আসতে পারে। সেই জোশে আপনি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়ও যেতে পারেন। সুতরাং সাবধান।

পিপিই পরে শুধু নিজেকে নিরাপদ রাখার ধারনা আপনার জন্য বুমেরাং হতে পারে। আপনার পিয়ন, ড্রাইভার, শ্রমিক থেকে শুরু করে আশপাশের সবাইকে নিরাপদ হওয়ার শিক্ষা দিন। সবাই যাতে নিরাপদে কাজ করতে পারে সে ব্যবস্থা নিন।

আপনি আমি যারা চাকরি করছি, অফিসে যাচ্ছি, সবার জন্য স্বাস্থ্যবিধি নির্ধারিত আছে। আমাদের মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। হাত পরিষ্কার রাখতে হবে। অপরিষ্কার হাতে নাক, মুখ, চোখ স্পর্শ করা যাবে না। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। গণপরিবহন এড়িয়ে চলতে হবে। হাটবাজারের মতো জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে। নিজেকে অসুস্থ মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

অনুকরণ, অনুসরণ, অনুধাবন। শব্দ তিনটা দেখতে প্রায়ই একই রকম। কিন্তু পার্থক্য অনেক। আপনারা সকলেই জানেন, অনুকরণ প্রবণতার কারণে বাঙলি জাতি তার সত্তা হারিয়ে ফেলেছে প্রায়। করোনার দিনগুলোতে আর অনুকরণ নয়। আসুন অনুধাবন করি। তারপর অনুসরণ করি।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status