বাংলারজমিন

বাল্যবিয়ে থেকে বাঁচতে শিশু সামিয়ার আবেদন

সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি

২৮ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৬:১০ পূর্বাহ্ন

এক মাস পূর্বে বড় বোন মাদরাসায় পড়–য়া ছাত্রী সুমাইয়াকে (১৪) ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাল্য বিয়ে দিয়েছেন মা সাহানা বেগম। স্থানীয় লোকজন বাঁধা দিলে তাদেরকে দেয়া হয়েছে হুমকি ধামকি। দেখানো হয়েছে মামলার ভয়। খবরটি শুনে পাগল প্রায় প্রবাসী পিতা আবু ছায়েদ। এখন আমার মায়ের টার্গেট আমি (সামিয়া)। আমার বয়স মাত্র ১৩ বছর। টিঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে অনুুষ্ঠিত পিইসি পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়েছি। আমি সরাইল সদরের দি ব্লু বার্ড স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছি। বাল্য বিয়েতে রাজি না হওয়ায় আমার মা সাহানা বেগম আমার উপর শারীরীক ও মানসিক নির্যাতন করছেন। মুঠোফোনে আমার প্রবাসী পিতার সাথে মায়ের কথা কাটাকাটি হয়েছে। পিতার নির্দেশে আমি বিয়ে থেকে বাঁচতে চাচার বাড়িতে চলে এসেছি। আমি আর কোন উপায় দেখছি না। পুলিশ পাঠিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পুলিশ কেন জানি আমাকে শুধু দৌঁড়াচ্ছেন। তাই বাধ্য হয়ে সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে এ বিয়ে থেকে রক্ষা করার আবেদন করেছি। শিশু বয়সে বিয়ে নয়। আমি পড়তে চাই। আপনারা আমাকে বাল্য বিয়ে থেকে বাঁচান। উপরোল্লেখিত কথা গুলো উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের টিঘর গ্রামের প্রবাসী আবু ছায়েদের কন্যা শিশু শিক্ষার্থী সামিয়ার। সামিয়া বাল্য বিয়ে থেকে বাঁচতে গত বুধবার ইউএনও’র কাছে দেওয়া লিখিত আবেদন পত্রে এই বিষয় গুলো জানান।
অভিযোগপত্র, ভুক্তভোগী ও স্থানীয়রা জানায়, টিঘর গ্রামের আবু ছায়েদ দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে আছেন। তার স্ত্রী সাহানা বেগম সন্তানদের নিয়ে থাকেন গ্রামে। আগের বাল্য বিয়ের ঘটনায় স্বামীর সাথে মুঠোফোনে ঝগড়া হয়েছিল সাহানার। তখন সাহানা ক্ষুদ্ধ হয়ে স্বামীকে বলেছিল-‘তোর মেঝো মেয়েকেও আমি বিয়ে দিব। দেখি তুই আমার কি করতে পারছ? আর এ কথার বাস্তবায়ন ঘটাতেই সাহানা বেগম এখন তার শিশু কন্যা সামিয়ার বিয়ে ঠিক করেছেন। বর আরশ আলীর ছেলে রবিন মিয়া ()। বিষয়টি জেনে সামিয়া তার মাকে বাল্য বিয়ে না করার কথা জানায়। সাহানা উল্টো তার মেয়েকে এ বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। এতেও রাজি না হওয়ায় এক পর্যায়ে শিশু সামিয়ার উপর শারিরীক ও মানসিক অত্যাচার চালায়  অবহিত করে সামিয়া। আবু ছায়েদ সামিয়াকে নানা বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে চাচা- চাচীর আশ্রয়ে চলে যেতে বলেন। এখন সেখানেই আছে সামিয়া। কিন্তু মায়ের কৌশলের কাছে সামিয়া চাচার কাছেও শান্তিতে থাকতে পারছে না। থানা থেকে পুলিশ এনে সামিয়ার ইচ্ছার বিরূদ্ধে তাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সাহানা। বর্তমানে মানসিক ভাবে অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে স্কুলছাত্রী সামিয়া। সামিয়া জানায়, তার মা সাহানা যেকোন মুহূর্তে জোর করে নিয়ে আমার ও পিতার ইচ্ছার বিরূদ্ধে বিবাহ দিয়ে দিতে পারেন। তাই বাল্য বিয়ে থেকে রক্ষা পেতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেছে শিশু সামিয়া। আবেদনপত্রে সামিয়া আরো জানায়, এক মাস পর্বে সামিয়ার বড় বোন সুমাইয়া আক্তারকে (১৪) ইচ্ছার বিরূদ্ধে পিতার অজান্তে একই গ্রামের হারূন মিয়ার ছেলে রূবেল মিয়ার (২৩) কাছে বিয়ে দেন সাহানা। সুমাইয়া সৈয়দটুলা সুফিয়া করিম মহিলা মাদরাসায় হেদায়েতুন্নাহু শ্রেণির ছাত্রী ছিল। নিজের মেয়ের এই বাল্য বিয়ের খবর জেনেও পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলেন প্রবাসী ছায়েদ। সামিয়া জানায়, চুর ছেলের সাথে আম্মা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। আমি বাল্য বিয়েতে রাজি না। আব্বাও রাজি না। আমি পড়তে চাই। তাই আম্মা তার কিছু লোক ও পুলিশ দিয়ে আমাকে চাচাদেরকে হয়রানি করছেন। সাহানা বেগম সামিয়াকে হাতের কাছে না পেয়ে সরাইল থানায় অপহরণের একটি অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগটি নথিভুক্ত না হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার টিঘর গ্রাম থেকে ফায়জুল (৩০) ও ইয়াছিন (২০) নামের দুই ব্যক্তিকে আটক করে থানায় নিয়ে এসেছেন এস আই খলিলুর রহমান। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদেরকে আদালতে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের একাধিক ব্যক্তি বলেন, স্থানীয় ইউপি সদস্য লায়েছ মিয়া আগের বাল্য বিয়ে সম্পর্কে জেনেও চুপ ছিলেন। এখনকার বিষয়টাও জানেন। সামিয়ার মা সাহানা বেগম বলেন, মেয়েকে বাল্য বিয়ে দিব না। চাচারা জিম্মি করে ফেলেছেন। তাকে (সামিয়াকে) উদ্ধারের জন্য থানায় অভিযোগ দিয়েছি। আপনার স্বামী বলছেন- সামিয়া অপহরণ হয়নি। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। বাল্য বিয়ে দিতে সামিয়াকে হাতে নিতে চাচ্ছে সাহানা। এ কথার উত্তরে সাহানা বলেন,সামিয়ার বাবা একটা পাগল।  সামিয়ার সৌদী প্রবাসী বাবা  আবু ছায়েদ মুঠোফোনে হাঁউমাউ করে কেঁদে বলেন, আমাকে না জানিয়ে গোপনে আমার বড় মেয়েকে ডাকাতের কাছে বাল্য  দিয়েছে সাহানা। এ বিষয়ে ঝগড়া করে সে বাবার বাড়িতে চলে গেছে। আমার মেঝো মেয়ে সামিয়াকে আমি দেয়নি। আমার নিজের ঘরে সে থাকে খায়। আমি সামিয়াকে টাকা পয়সা দিচ্ছি। সাহানা এখন আরেক ডাকাতের কাছে আমার শিশু কন্যাটাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি দিচ্ছি না। আমার মেয়েকে কেউ অপহরণ করেনি। গত ২৪ মে এস আই খলিল স্যার ১২ জন পুলিশ নিয়ে গিয়ে আমার শিশু কন্যাটাকে দৌঁড়ায়ে এক কিলোমিটার পর্যন্ত নিয়েছেন। আমার স্ত্রী অন্যের প্ররোচণায় আমার ভাইদের বিরোদ্ধে অযথা ৫টি মামলা করেছে। তার পিছনে কিছু লোক আছে। তারা এ গুলো করাচ্ছেন আর টাকা কামাই করছেন। আমার জীবনটা সাহানা শেষ করে দিচ্ছে। আপনারা দয়া আমার করে কন্যা শিশু ও আমাকে বাঁচান। অপহরণের অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই মো. খলিলুর রহমান বলেন, অপহরণের বিষয়টি শতভাগ সত্য। অভিযোগটি কবে হয়েছে? অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে কিনা? কয়জনকে গ্রেপ্তার করেছেন? এমন সব প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না। অভিযোগের কপি আমার কাছে নেই। সবকিছু ওসি স্যারে বলতে পারবেন। আমরা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া মিডিয়ার সাথে কথা বলতে পারি না।  উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এস এম মোসা সামিয়ার আবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহন করব।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status