বাংলারজমিন
শ্যামনগরে স্বেচ্ছাশ্রমে চলছে বাঁধ মেরামত: সুপেয় পানির জন্য হাহাকার
জাহিদ সুমন, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) থেকে
২৮ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১২:১১ অপরাহ্ন
দেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম উপজেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগরে সুপার সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে একের পর এক ভেঙেছে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছে শ্যামনগরের সব কয়টি ইউনিয়ন। এতে পানিতে ভাসছে উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার ৫ ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। দিনে দুইবার ডুবছে আর দুইবার জাগছে উপকূলবাসি। ২০ মে বুধবার কয়েক ঘণ্টার তাণ্ডবে উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরকে তছনছ করে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। যত দিন গড়াচ্ছে, পরিস্থিতি ততই ভয়াবহতায় রূপ নিচ্ছে। শুধুমাত্র গাছপালা ভেঙে পড়া এবং বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে যাওয়ার মধ্যেই ক্ষয়ক্ষতি সীমাবদ্ধ নেই। ওইদিন প্রাথমিকভাবে মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা একেবারেই বিকল হয়ে পড়েছিল। সেসব পরিষেবা যত স্বাভাবিক হচ্ছে, ক্ষয়ক্ষতির সামগ্রিক চিত্রটাও ধীরে ধীরে সামনে আসছে। সুন্দরবনের বাইরে সাতক্ষীরাসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘর সমেত সর্বস্ব হারিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছেন অনেক মানুষ। ভেসে গেছে শতশত মাছেরঘের ও কাঁকড়ার খামার। ফসলের ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। সুন্দরবনের কোলে শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, কাশিমাড়ি ও রমজানগর ইউনিয়নে ঘূর্ণিঝড়ের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। হাজার হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানে। পানির তোড়ে ভেসে গেছে বাড়িঘর। পানি যেখানে উঠতে পারেনি, সেখানে আবার ঝড়ের দাপটে উড়ে গেছে অসংখ্য কাচাবাড়ির চাল। এরআগে ২০০৯ সালে আইলার সময়ও একই অবস্থা দেখা দিয়েছিল এসব এলাকায়। সেইসময় রিং বাঁধ নির্মাণ করে পানি আটকানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়, কিন্তু বেড়িবাঁধ নির্মাণের সেই পরিকল্পনা আটকে আছে প্রায় ১০টি বছর। এ অভিযোগ স্থানীয়দের। এদের মধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা তাদের মাছের খামার রক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। চরম খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে উপকূলজুড়ে। সেখানে কোথাও কোথাও একবুক পর্যন্ত পানি জমেছে। বহু বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পর আটদিন কেটে গেলেও, এখনও ভাঙা বাঁধের মেরামত হয়নি। সেখানে প্রচুর গাছপালা ভেঙে পড়েছে। পানির তোড়ে ভেসে গেছে বহু বাড়িঘর ও দোকানপাট। তার মধ্যেই ত্রিপল খাটিয়ে কোনও রকমে মাথা গুঁজে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। এই সমস্ত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। তবে ত্রাণ কম বলে অভিযোগ আসছে অনেক এলাকা থেকেই। ত্রাণ কাজে নেমেছে অনেক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক সংগঠন। এদিকে দুর্গত এলাকায় সুপেয় পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। গবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন উপকূল। ফলে জ্বলছে না বিদ্যুতের আলো, ঘুরছে না পাখা। নলকূপগুলো রয়েছে পানির নিচে। রাস্তাগুলোর উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে জোয়ার-ভাটা। রাস্তাগুলো ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। আম্পানের আটদিন অতিবাহিত হলেও ভাঙন কবলিত বাঁধ বাধা যায়নি। বরং নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছে মেডিকেল টিমের সদস্যরা।এদিকে,সাতক্ষীরার উপকূলের অনেক ইউনিয়নে মানুষের বাড়ি ঘরে মধ্যে এখনও জোয়ার-ভাটা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে না পেয়ে অধিকাংশ এলাকার হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণে নেমে পড়েছে। কিন্তু নদীতে প্রবল জোয়ার থাকায় বাঁধ টেকানো যাচ্ছে না। এক পাশের বাঁধ দিয়ে বাড়ি ফিরতেই আরেক পাশে ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জানা যায়, মঙ্গলবার ভোর থেকে বেলা ১২টায় সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া ৩ কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ ৮ হাজার জনগণকে সাথে নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম নির্মাণ করে বাড়ি ফিরতেই প্রবল জেয়ার সেটা ভেঙে আবারও লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এদিকে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালী ও কাশিমাড়ি ইউয়িনের ঘোলা এলাকার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ নির্মাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।শ্যামনগরের গাবুরা গাইনবাড়ি এলাকার আব্দুল হাসান বলেন, এলাকার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গ্রামের ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষ যেয়ে ৭ঘন্টা কাজ করে বাঁধ দিয়ে বাড়ি ফিরতেই আবারও নতুন করে আরো তিন জায়গায় ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বুড়িগোয়ালিনী এলাকা থেকে আব্দুল হালিম জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের দিন দাতিনাখালী এলাকায় পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। সেখান থেকে আজ পর্যন্ত নদীর সাথে লোকালয়ের জোয়ার-ভাটা চলছে। পানিউন্নয়ন বোর্ডের কোন খবর নেই। আমাদের নিজেদের বাঁচা নিজেদের বাঁচতে হবে। তাই স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত করি। সম্পূর্ণ এলাকা এখনও মেরামত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু নরম মাটিতে বাঁধ খুব বেশি শক্ত হচ্ছে না। পানির চাপে আবার ভেঙে যাচ্ছে। উপকুলীয় এলাকায় কয়েকটি সংগঠন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।