অনলাইন

রম্য কথন

চেহারাটাই এমন

শামীমুল হক

২৫ মে ২০২০, সোমবার, ৯:৪৮ পূর্বাহ্ন

হিংসা-হানাহানি, সমালোচনা, আলোচনা আমাদের অঙ্গে যেনো মিশে গেছে। এই যে লকডাউন চলছে দেশে। দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে ছুটি। করোনা সংক্রমনরোধে নেয়া হয়েছে নানা ব্যবস্থা। এসব সিদ্ধান্ত নিয়েও দেশজুড়ে চলছে আলোচনা, সমালোচনা। কারণ কেউ কারো কথা শুনছেনা। মার্চে ছুটির শুরুতেই বাড়ি যাওয়ার ঢল নামে। এরপর ত্রাণ দেয়ার নামে ভাঙ্গা হয় সামাজিক দূরত্ব। গার্মেন্ট খুলার কথা বলে গ্রাম থেকে আনা হয় শ্রমিকদের। আবার ঈদে বাড়ি যাওয়ার দৃশ্য দেখে অবাক সবাই। আলোচনা সর্বত্র, বিষয়টি এভাবে না করে ওভাবে করলেই হতো। কেউই বুঝতে চায়না এবারের ঈদ অন্যবারের মতো নয়। আসলে সবাই নিজেই যেন পন্ডিত। সব কিছুতেই উল্টো সুরে কথা বলতে হবে। কেউ একটা ভাল কাজ করলেও শুরু হয় বিতর্ক। খারাপ কাজ হলেতো কথাই নেই। ওই যে গাধা বিক্রি করতে যাওয়া বাপ বেটার মতো।
এক বাবা ও ছেলে গাধা বিক্রি করতে যাচ্ছেন বাজারে। হাতে দড়ি, গাধার এক পাশে বাবা অন্য পাশে ছেলে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন তারা। তা দেখে লোকজন বলছে দেখ, দেখ বাপ বেটা কি বোকা। একজন গাধার পিঠে চড়ে গেলেই তো পারে। তা না করে দু’জনই হেঁটে যাচ্ছে। একথা শুনে বাবা-ছেলে দু’জনই লজ্জা পেলো। তারপর ছেলে বাবাকে বললো, বাবা তুমিই গাধায় চড়। আমি টেনে নিয়ে যাচ্ছি। এ অবস্থায় বাবা গাধায় চড়ে আর ছেলে হেঁটে রাস্তা চলছেন। কিছু দূর যাওয়ার পর লোকজন আবার বলছে, দ্যাখ দ্যাখ বুড়া হইছে তারপরও শখ মেটেনি। ছেলেকে হাঁটতে দিয়ে নিজে উঠেছে গাধায়। এ বয়সে নিজে তো অনেক শখ করেছে। তবুও শখ মেটেনি। দ্যাখ শখ কাকে বলে। লোকজনের এ আলোচনার মুখে বাবা গাধার পিঠ থেকে নেমে ছেলেকে গাধার পিঠে উঠাল। এখন ছেলে গাধার পিঠে আর বাবা দড়ি ধরে টানছে। এ অবস্থায় কিছু পথ যাওয়ার পর লোকজন আবার বলা শুরু করলো দ্যাখ দ্যাখ কেমন বেয়াদব ছেলে। নিজে গাধার পিঠে চড়ে যাচ্ছে । আর বুড়ো বাপটাকে দিয়ে দড়ি টানাচ্ছে। এমন বেয়াদব ছেলে জীবনেও দেখিনি বাবা। সমালোচনার মুখে ছেলেও নেমে গেলো গাধার পিঠ থেকে। সমালোচনা ও আলোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত বাবা-ছেলে মিলে গাধার পা বেঁধে কাঁধে করে নিয়ে গেলো বাজারে।
আসলে প্রতিবেশী একজন উপরে উঠে যাবে। তা হতে পারে না। যেভাবেই হোক তাকে ডাউন দিতে হবে। তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে তীব্র সমালোচনায় মেতে উঠতে হবে। এটাই এখন যেনো নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে প্রচলিত একটি গল্প চালু আছে মানুষের মুখে মুখে।
গ্রামের দরিদ্র পরিবারের এক ছেলে স্কুলে লেখাপড়া করে। ভালো ছাত্র, খুব ভালো ছাত্র। তা দেখে পার্শ্ববর্তী বিত্তশালী প্রতিবেশী হিংসায় জ্বলছে। দরিদ্র পরিবারের সন্তানটি ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তিও পেয়ে গেছে। তা দেখে প্রতিবেশির অবস্থা আরও কাহিল। এখন তিনি নেমেছেন সমালোচনায়। এখানে সেখানে বলে বেড়াচ্ছেন আরে বৃত্তি পেলেই কি, মেট্রিক পাশ করতে পারবে না। মেট্রিকও ভালোভাবে পাস করার পর প্রতিবেশী বলতে থাকলেন পাশ করেছে কিভাবে আমরা জানি না? নিশ্চয় নকল করে পাস করেছে। এদিকে দরিদ্র পরিবারের ছেলেটি অনেক কষ্ট করে লেখা পড়া চালিয়ে যেতে থাকলো। আইএ, অনার্সসহ মাস্টার্সও কমপ্লিট করেছে ইতমধ্যে। এ সময় এসে প্রতিবেশী বললেন, লেখাপড়া করেছে ঠিকই । কিন্তু চাকরি আর জুটবে না। কিন্তু না! লেখাপড়া শেষ হতে না হতেই চাকরিও পেয়ে গেলো। ভালো চাকরি। ক’বছরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারে দেখা দিল সুখ। ছনের ঘর থেকে হল ইটের দালান। এখন কি বলবেন প্রতিবেশী? না প্রতিবেশী এখনো বসে নেই। সর্বত্র বলে বেড়াচ্ছেন সব ঘুষের টাকা, ঘুষের। এই হলো অবস্থা।সামাজিক এ চিত্রের মতই এখন দেশের অবস্থা। যেমন এটা এখন ট্রেডিশনে পরিণত হয়েছে। শুধু কি বর্তমান সময়ে? না! সকল সময়েই এ অবস্থা। এ থেকে রেহাই পাওয়ার কোন পথ নেই?
ক’দিন আগে এক আড্ডায় আলোচনা হচ্ছিল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। রাজনীতির কথা উঠতেই সকলে একযোগে অনীহা প্রকাশ করল- এ বিষয়ে কোন কথা নয়। কথা হতে পারে না। একজন বললেন, ভারতের দিকে তাকাও দেখবে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের নেতারা এক টেবিলে বসে যায়।তারা আলোচনা করে কিভাবে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে। তা দেখে অবাকই হতে হয়। আর আমাদের দেশে কোন অনুষ্ঠানে এক দলের নেতা গেলে , অন্য দলের নেতাকে সোনার পালকি দিয়েও সেখানে নেয়া যাবে না। আর জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সবাই এক হবে! এটা তো শুধু স্বপ্নেই সম্ভব। বাস্তবে নয়। অন্যজন বললেন, তাহলে সবাই যেদিন এক টেবিলে বসবে সেদিন হয়তো আমরা এসব বিষয় থেকে মুক্তি পাবো। অন্যজন বললেন, না বন্ধু না এক টেবিলে বসার সম্ভাবনা কখনও নেই। আর নেই বলেই আমাদের সেই ট্রেডিশন থেকে বের হওয়াও সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই অবস্থা চলতেই থাকবে আজীবন। কারণ এটা আমাদের রক্তের সাথে মিশে গেছে ক্যান্সারের মতো। এ থেকে উত্তরণের কোনো ট্যাবলেট তৈরি হয়নি। কেউ চেষ্টাও করছে না। মনে পড়ল আমার একপরিচিত বন্ধুর কথা। সব সময় সে যেনো মন মরা হয়ে থাকেন। দেখলে খুব কষ্ট লাগে। সেদিন মুখ গোমরা করে বসে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি বন্ধু মন খারাপ? তার উত্তর না আমার চেহারাই এমন।
সত্যিই তার চেহারার মতো গোটা জাতির চেহারা এখন এমন হয়ে আছে। আলোচনা,সমালোচনা, হিংসা, নিন্দা অক্টোপাসের মত বাসা বেঁধেছে অন্তরে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status